হীরকরহস্য

অলংকরণ: আরাফাত করিম

বাড়ি থেকে বেরোতেই চোখ চলে গেল ওপর দিকে। অবাক কাণ্ড...তুষার পড়ছে! দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় বিচিত্র দৃশ্যই বটে!

অভিভূত হয়ে গেলাম। আশপাশে কেউ নেই, নিশ্চিত হয়ে জিব বের করে মুখে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম ইতস্তত ওড়া তুষারফলকগুলো। পার্কার চেইন টেনে দিয়েছি চিবুক পর্যন্ত।

একটু পরে গেটে তালা মারতে যাচ্ছি, অবাক হলাম পুলিশ ক্রুজারটিকে লৌহফটকের সামনে এসে থামতে দেখে।

এগিয়ে গেলাম পার্শ্বফটক খুলে।

নেমে এল গাড়ির কাচ।

হাসলাম ড্রাইভিং সিটে বসা পুলিশ চিফের উদ্দেশে। ‘হ্যাপি ক্রিসমাস ইভ (বড়দিনের আগের সন্ধ্যা), চিফ!’

হাসিটা ফিরিয়ে দিলেন না তিনি। ভীষণ কুঁচকে রয়েছে ঝোপের মতো ভ্রুজোড়া। গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘তোমার জন্য শুভ হতে পারে জন, কিন্তু আমি আছি গুরুতর সমস্যায়!’

‘কী ব্যাপার, আঙ্কেল?’ সিরিয়াস হয়ে গেলাম।

জোরে জোরে চিবুক ডললেন ভদ্রলোক। ‘খোয়া গেছে কুপারদের ঐতিহাসিক হিরে!’

‘কীহ্!’ চাপা দিতে পারলাম না চিত্কারটা।

এ অঞ্চলের অন্যতম পুরোনো ও বিত্তশালী পরিবার কুপাররা। উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় অয়েল রিগ এবং দক্ষিণে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা থেকে বিস্তর পয়সা করে পরিবারটি। তিন দশক আগে কোনো এক বড়দিনে স্ত্রীকে হিরে বসানো নেকলেস উপহার দিয়েছিলেন অ্যালবার্ট কুপার। কথিত রয়েছে, জগদ্বিখ্যাত অলংকারটি একসময় ছিল জনৈক রেলরোড ব্যারনের স্ত্রীর সম্পত্তি। ইংল্যান্ডের রানির জীবন বাঁচানোর পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন ব্যারন কণ্ঠহারটি। উঁচু, খাড়া পাহাড়ের ওপর থেকে মহারানির উন্মত্ত ঘোড়া ঝাঁপিয়ে পড়ে, ঠিক সেই মুহূর্তে জানোয়ারটির নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হন দুঃসাহসী ব্যারন।

‘এ মুহূর্তে আমার সব ডেপুটিই ব্যস্ত রয়েছে অন্য কাজে।’ বললেন চিফ হ্যাটফিল্ড, তা ছাড়া মনে হলো, পুলিশি তদন্তের চেয়ে বেশি কাজে দেবে এখন বিখ্যাত গোয়েন্দার বুদ্ধির ঝিলিক। দু-চারটি কেসে সাফল্য পাওয়ায় লজ্জা দিলেন অফিসার।

খানিক বাদেই উঠে বসলাম ক্রুজারে। পাহাড়ি রাস্তায় ছুটে চলল সিডনি হ্যাটফিল্ডের অফিশিয়াল বাহন। অসময়ে বেরোচ্ছি বলে কিঞ্চিৎ বিরক্ত আম্মু। আগামীকালের আয়োজনের জন্য এ সময় তাকে আমার সাহায্য করার কথা।

কিছুক্ষণ পর অভিজাত এলাকায় প্রবেশ করলাম আমরা। রকমারি আলোকসজ্জা আলিশান বাড়িগুলোর ভেতরে-বাইরে।

দীর্ঘ, চক্রাকার ড্রাইভওয়ে ধরে এগিয়ে পেল্লায় এক ম্যানশনের সামনে গাড়ি পার্ক করলেন হ্যাটফিল্ড। পা বাড়ালাম আমরা সদর দরজার দিকে। প্রশস্ত সিঁড়ি ভেঙে উঠে ঘণ্টি বাজাতে দরজা খুলে দিল গোমড়ামুখো খানসামা।

‘শুভ সন্ধ্যা।’ অভ্যর্থনা জানাল ক্লান্ত স্বরে, ‘ডাইনিং রুমে রয়েছেন মিসেস কুপার। আসুন, আমার সঙ্গে।’

বিলিয়ার্ড রুম আর পাঠকক্ষ পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি অনুজ্জ্বল হলওয়ে ধরে, ঢুকে পড়লাম বাঁ দিকের শেষ দরজা দিয়ে।

আগুন জ্বলছে ফায়ারপ্লেসে। লো ভলিউমে তখনো বাজছে বড়দিনের সংগীত।

বিরাট টেবিল ডাইনিংয়ের মাঝামাঝি। এঁটো প্লেট, প্লাস, রুপার ছুরি-চামচ এখনো পড়ে রয়েছে টেবিলে। একমাত্র টেবিলের মাঝখানটায়, প্ল্যাটারে পরিবেশিত ফ্রুটকেকটিই দেখছি স্পর্শ করা হয়নি। চেহারা–সুরত সুবিধার নয় বলেই হয়তো!

গাঢ় নীল সাটিনের গাউন আর কনুই পর্যন্ত লম্বা একই রঙের দস্তানা পরা বছর পঁয়ত্রিশের এক মহিলা ঝুঁকে রয়েছেন বয়স্ক আরেকজনের ওপর, সান্ত্বনা দিচ্ছেন তাঁকে। চেহারার মিল দেখে মনে হয় মা-মেয়ে। নাকে রুমাল চেপে ফোঁত ফোঁত করছেন বয়সী মহিলাটি। নীলাভ মখমলের ড্রেস আর বিশাল চুড়ো করা চুলে সাজিয়েছেন নিজেকে। কোলের ওপর ছোট এক পমেরেনিয়ান কুকুর। ঘেউ ঘেউ করে উঠল আমাদের দেখে। বিশালদেহী মালকিন ধমক দিতে নিরস্ত হলো।

নিজের পরিচয় দিয়ে আমার দিকে তাকালেন মিস্টার হ্যাটফিল্ড। ‘আর এ হচ্ছে আমার সহকারী জন ডিউক।’

‘আমি বলছি, কোথায় খুঁজতে হবে!’ কোনো ভূমিকা ছাড়াই কথা বলে উঠলেন গাউন পরিহিতা, ‘স্রেফ হানা দিন বন মানচিনির আস্তানায়। নির্ঘাত পেয়ে যাবেন ওখানে...যদি না এরই মধ্যে অন্য কোথাও পাচার করে দিয়ে থাকে!’

নতুন করে অশ্রু গড়াল প্রৌঢ় মহিলার গাল বেয়ে। ‘ওসব অলক্ষুনে কথা মুখে আনিস না, সামান্থা!’ ডুকরে উঠলেন তিনি।

নোটপ্যাড আর কলম চলে এসেছে পুলিশ চিফ ক্যাপ্টেন সিড হ্যাটফিল্ডের হাতে। ‘কে এই বন মানচিনি?’

‘শিল্পী বলে নিজেকে!’ তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন সামান্থা, ‘আসলে দাগি আসামি!’

‘তা-ই?’ অভ্যাসবশে চোয়াল ডলছেন চিফ, ‘কই, পুলিশের খাতায় এ নাম দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না!’

‘নিশ্চয়ই পরিচয় ভাঁড়িয়েছে!’ জোর দিয়ে বললেন ভদ্রমহিলা, ‘আমার তো ধারণা, প্ল্যান-প্রোগ্রাম করেই এসেছে এখানে লোকটা। হিরের লোভে টার্গেট করেছে বাড়িটাকে।’

‘পার্টিতে এসেছিলেন নাকি?’ আন্দাজে ঢিল ছুড়লাম।

দীর্ঘ, চক্রাকার ড্রাইভওয়ে ধরে এগিয়ে পেল্লায় এক ম্যানশনের সামনে গাড়ি পার্ক করলেন হ্যাটফিল্ড। পা বাড়ালাম আমরা সদর দরজার দিকে।

‘নাহ্।’ নাক টানলেন প্রৌঢ়া, ‘দাওয়াত করেছিলাম অবশ্য; কিন্তু বলল, ভিড়ভাট্টা নাকি পছন্দ নয়। দুপুরেই চলে গেছে।’ ফায়ারপ্লেসের ওপর ঝুলন্ত প্রমাণ সাইজের এক তৈলচিত্রের দিকে তর্জনী তাক করলেন তিনি। ছবিতে এক ভদ্রলোক, মিস্টার কুপারই হবেন, দাঁড়িয়ে রয়েছেন সহধর্মিণীর পাশে। শিকারের পোশাক পরনে। মিসেস কুপারের শরীরে নীলচে এই মখমলটিই। রাজকীয় হিরের হার শোভা পাচ্ছে গলায়। ‘ওটার কাজ করছিল।’ ব্যাখ্যা করলেন, ‘আজই ছিল শেষ দিন।’

‘গত সপ্তাহেই শেষ হয়ে যেত।’ কথা জোগালেন ভদ্রমহিলার কন্যা, ‘নেকলেসটা আঁটো লাগছিল আম্মুর। পেইন্টিংয়ে ওটার কাজই বাকি ছিল মানচিনির। একপর্যায়ে ভেঙে গেল কবজাটা। পার্টিতে পরার ব্যাপার ছিল, সে কারণে কাজ চালানোর মতো মেরামত করে দিতে পারবে আপাতত, দেখে বলল কারিগর। গতকালই ফেরত এসেছে ওটা দোকান থেকে।’

‘কখন খেয়াল করলেন, গায়েব হয়ে গেছে জিনিসটা?’ ক্যাপ্টেনের প্রশ্ন।

‘অনেক কাজ ছিল আজ।’ পোষা কুকুরের মাথা চুলকে দিচ্ছেন কুপার পরিবারের কর্ত্রী, ‘রাঁধুনি আর চাকরবাকর থাকলেও নিজে হাত লাগাই, যতটা পারি।’

‘সব সময় বলি আমি আম্মুকে: অস্থির হয়ো না অত।’ আবার খেই ধরলেন কন্যা, ‘যার যা কাজ, তাকেই করতে দাও সেটা। না, শুনবে না!’

‘মিসেস কুপার,’ মুখ খুললাম আবার, ‘সারা দিন কী কী করলেন আজ, বলবেন একটু দয়া করে? বন মানচিনি চলে যাওয়ার পর থেকে রত্নহার উধাও হওয়ার ব্যাপারটা টের পাওয়া পর্যন্ত সবই বলুন এক এক করে।’

ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিলেন মহিলা। ‘যতক্ষণ মানচিনি ছিল, যথাস্থানেই ছিল নেকলেসটা। কারণ, ওটাই তার আঁকার বিষয়। বিকেল পাঁচটায় ম্যান্টলের ওপর ঝোলানো হয় পেইন্টিংটা, পার্টি শুরু হয় সন্ধ্যা ছয়টায়। এতটাই দৌড়ের ওপর ছিলাম যে ছবির জন্য সিটিং দেওয়ার পর কাপড় পাল্টানোর সময় পর্যন্ত পাইনি! শুধু একটা অ্যাপ্রোন চড়িয়েছিলাম কাপড়ের ওপর। ওই অবস্থাতেই কিচেনে সেঁধোলাম তাড়াহুড়ো করে। আপসেট ছিলাম ফ্রুটকেকটা তখনো তৈরি হয়নি বলে। ফ্রুটকেক ছাড়া কি পার্টি জমে? কাজেই আর দেরি না করে শুরু করলাম বানানো। হ্যাপা তো কম নয়! বাদাম, ফল...আরও কত কী যে লাগে! সচরাচর লোকে কেকটেক বানিয়ে ফ্রিজে রেখে দেয় সপ্তাহের পর সপ্তাহ। আমি আবার পারি না এটা। যেদিন বানাব, সেদিন পরিবেশন করাটাই রীতি আমার।’

‘আসল কথায় এসো, আম্মু!’ দীর্ঘশ্বাস চাপলেন মিস সামান্থা।

‘আসছি, বাছা।’ বোকাটে হাসি দিলেন কুপার গিন্নি, ‘হ্যাঁ...যা বলছিলাম। ব্যস্ততায় সরগরম ছিল বাড়ি, বিশেষ করে রান্নাঘরটা। এমনকি ব্রোকারের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ সারতে সারতেও মিক্সচার ঢালতে হয়েছে প্যানে! এ ছাড়া স্টাফদের ফরমাশ দেওয়া...অ্যালবার্টের টাই বেঁধে দেওয়া...কাপড়ে যাতে ময়লা না লাগে, সেদিকটা খেয়াল রাখা—সবকিছুই সামলাতে হয়েছে নিজেকে।’

‘তো, টের পেলেন কখন, লাপাত্তা গয়নাটা?’ শুধাই আমি।

ঘটনাটা মনে পড়ে যাওয়ায় কেঁপে উঠল মহিলার ঠোঁটজোড়া। ‘পার্টি শেষ দিকে তখন। এ সময় নিচু স্বরে জানতে চাইল অ্যালবার্ট, কেন খুলেছি নেকলেসটা। শুনে তো অজ্ঞান হওয়ার দশা আমার! অনেক চেষ্টায় স্বাভাবিক করেছি নিজেকে। অতিথিদেরও বুঝতে দিইনি কিছু। ওদের শরীর তল্লাশি করানোর প্রশ্নই ওঠে না! ডেকে এনে অপমান করার শামিল হতো ওটা। সবাই বেরিয়ে গেলে সারা বাড়ি খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করল কর্মচারীরা...।’

তক্ষুনি দড়াম করে খুলে গেল দরজা! হুড়মুড় করে কামরায় প্রবেশ করলেন মিস্টার অ্যালবার্ট কুপার।

পাগলের মতো চেঁচামেচি জুড়ল আবার সারমেয়। লাফ দেওয়ার উপক্রম করছে মনিবানির কোল থেকে।

একা আসেননি কুপার। পেছন থেকে শার্টের কলার পাকড়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে হাজির করেছেন ঢ্যাঙা এক যুবককে। বেচারার একটা হাত মুচড়ে নিয়ে গেছেন পেছনে।

‘অ্যালবার্ট!’ আঁতকে উঠলেন ওঁর মিসেস। উত্তেজিত প্রাণীটিকে জাপটে ধরে রেখেছেন বুকের সঙ্গে, ‘করছ কী এসব? ছেড়ে দাও বেচারিকে!’

‘বললেই হলো?’ গর্জন ছাড়লেন ভদ্রলোক, ‘একবার যখন পাকড়াও করতে পেরেছি, হাওয়া হতে আর দিচ্ছি না বদমাশটাকে!’

ছাড়া পাওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করছে যুবকটি। মলিন পোশাক আর আলুথালু চেহারা সুবিচার করছে না লোকটির প্রতি।

অতএব পুলিশের বড়কর্তাকেই উদ্যোগী হতে হলো। ‘পেয়েছেন নেকলেসটা?’

‘তা পাইনি।’ জবাব এল, ‘তবে থানায় নিয়ে গিয়ে আচ্ছামতো টাইট দিন ছোকরাকে, ঠিক ঠিক বেরিয়ে আসবে! মানচিনি ব্যাটা এ বাড়িতে এসে চেহারা দেখানোর আগে তিরিশ বছর ধরে নিরাপদেই ছিল ডায়মন্ডগুলো। এবার বলুন, সন্দেহের তিরটা কার দিকে যাচ্ছে!’

চোখাচোখি হলো সিডনি আঙ্কেলের সঙ্গে।

‘কোনো আইডিয়া, জন?’

‘কে এই পুঁচকে ছোড়া?’ নিখাদ বিস্ময় অ্যালবার্ট কুপারের কণ্ঠে।

পায়ে পায়ে হেঁটে গেলাম ডাইনিং টেবিলের উদ্দেশে। ছুরি-চামচ ছাড়াই হাত বাড়ালাম কেকটির দিকে। কুপার পরিবার, অভিযুক্ত মানচিনি, আইনের রক্ষক—সবার দৃষ্টি বিদ্ধ করছে আমাকে।

নরম, আঠালো ফ্রুটকেকটির খাবলা খাবলা তুলে নিয়ে ফেলতে লাগলাম পাশের খালি প্লেটে।

শেষমেশ যা আশা করছিলাম, পেয়ে গেলাম সেটি। বিজয়ীর হাসি হেসে মাথার ওপর তুলে ধরলাম ইংল্যান্ডের রানির স্মৃতিবিজড়িত কণ্ঠহার!

‘কী করে আন্দাজ করলে, কেকের মধ্যেই রয়েছে জিনিসটা?’ সেই তখন থেকে হাসি এ কান-ও কান হয়ে রয়েছে ক্যাপ্টেনের।

স্মিত হেসে চাইলাম বাসার সামনে দাঁড় করানো ক্রুজারটির জানালা দিয়ে। তুষার ঝরছে এখনো। শুভ্রতার মাঝে ঝিলিক দিচ্ছে রুপালি জ্যোত্স্না। হিরের দ্যুতি ছড়াচ্ছে যেন।

‘অনুমান নয়, ডিডাকশন।’ খোলাসা করি আমি, ‘কবজায় সমস্যা ছিল নেকলেসটার...একসঙ্গে অনেক কাজ করতে হচ্ছিল মিসেস কুপারকে। কখন যে গলা থেকে খুলে পড়ে গেছে ওটা, টেরই পাননি ভদ্রমহিলা।’