কিশোরেরা বড় হচ্ছে, বেরিয়ে পড়ছে বিশ্বজয়ে

ফুটবলার ঋতুপর্ণা চাকমার হাতে কিশোর আলোছবি: প্রথম আলো

ঋতুপর্ণা চাকমার ভক্ত আমরা সবাই। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের মাঠে ওর জোড়া গোলের দৃশ্য চোখে লেগে আছে। কিন্তু যদি প্রশ্ন করি, ঋতুপর্ণার স্কুলের নাম কী? কেউ কি বলতে পারবেন? হ্যাঁ। রাঙামাটির ঘাগড়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়।

এই স্কুল থেকেই উঠে এসেছেন ঋতুপর্ণা চাকমা, মনিকা চাকমা, রুপনা চাকমা, আনাই মোগিনী, আনুচিং মোগিনীসহ ৮ থেকে ১০ জন জাতীয় ফুটবলার।

এখনো ওই স্কুলের শিক্ষার্থীরা পড়ার পাশাপাশি ফুটবল প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। কিন্তু অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। এ বছর জুলাই মাসে খবর এল, আবাসিক শিক্ষার্থীদের খাদ্যসংকট। আগে চাল আসত জেলা প্রশাসন থেকে, আর আসছে না। কিশোর আলো খোঁজখবর নিয়ে কিশোর আলো ডট কমে সেই খবর প্রকাশ করল।

শুধু তা–ই নয়, ৪০০ কেজি চাল কিশোর আলোর উদ্যোগে পৌঁছে দেওয়া হলো ওই স্কুলে।

কিশোর আলোর একটা বৃত্তি আছে। কলসিন্দুর গ্রামের ৩৪ জন কিশোরী ফুটবলারকে প্রতি মাসে বৃত্তি দেয় কিআ।

কিশোর আলোর মাসিক আড্ডায় উপস্থিত এক কিশোর
ছবি: প্রথম আলো

কিআর জন্মদিনে

কিআর ঢাক খানিকটা পিটিয়ে নেওয়া গেল। কিআর জন্মদিনে বোধ হয় তা খুব অপ্রাসঙ্গিক শোনাল না।

আজ কিশোর আলোর ১২ বছর পূর্ণ হলো। ২০১৩ সালের অক্টোবরে কিআর প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল। কিশোর আলো প্রকাশের পেছনের ভাবনাটা ছিল শিশু-কিশোরদের জগৎটাকে বড় করা; যাতে তারা অনেক বড় স্বপ্ন দেখে। ভালো ফল করতে হবে, ক্লাসের পড়া মন দিয়ে শিখতে হবে, কিন্তু এটাও বলতে হবে, ‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে’! কিশোর আলোর স্লোগান, ‘আমার পৃথিবী অনেক বড়’। বই পড়তে হবে, কাগজের বই, হাতে নিয়ে। শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, বাইরের বই। কবিতা পড়তে হবে, গান, খেলাধুলা, বিতর্ক-বক্তৃতা, পরিবেশ ক্লাব, বিজ্ঞান ক্লাব, অ্যাডভেঞ্চার—নানা কিছুর মধ্য দিয়ে কিশোরেরা তাদের দিগন্তকে বড় করবে, বড় মানুষ হবে, ভালো মানুষ হবে, দেশকে ভালোবাসবে।

প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বের হয় কিশোর আলো পত্রিকা। আর কিশোর আলো ডট কমে প্রতিদিন নতুন নতুন কনটেন্ট প্রকাশিত হয়। কিশোর আলো কার্যালয়ে মাসে একবার বসে কিআড্ডা। কিশোর আলোর আছে বুক ক্লাব, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি ক্লাব। ১২ বছর আগে ১৪ বছরের যে কিশোর ভীরু পায়ে এসেছিল কিশোর আলোর মাসিক সভায়, আজ সে ২৬ বছরের টগবগে যুবক, নেতৃত্ব দিচ্ছে বড় কোনো স্বপ্ন আর উদ্যোগের। কিশোর আলোয় আসত একজন কিশোরী। মালিহা জেরিন সারনী। কিশোর আলোর পাতায় ওর ছবি ছাপা হয়েছিল। নিউইয়র্কে গেছি, সারনীর সঙ্গে দেখা। তখনো সে শিক্ষার্থীই। বাঙালি লেখকদের এক আড্ডায় এসে সে যোগ দিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। সে বলল, নিউইয়র্কের নতুন জীবনে দারুণ ভালো করছে সে, একটা অফিসে যোগ দিয়েছে, তরুণতর হয়েও সে ওই অফিসের ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের নেতা। ওর কথা শুনে আমার লেখক–বন্ধুরা বিস্মিত। একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমেরিকায় নতুন এসেছ, তুমি এত স্মার্ট হলে কী করে?’ সারনী জবাব দিয়েছিল, ‘আমি তো কিশোর আলোর ভলান্টিয়ার ছিলাম। কিশোর আলো আমাকে স্মার্ট করেছে।’

কিআ কার্নিভ্যালে কিশোর-কিশোরীরা
ছবি: প্রথম আলো

কুড়িগ্রাম থেকে এসেছিল শস্য সরকার সংঘ (১৪), আর ওর ভাই শঙ্খচিল সরকার শব্দ (৮), কিশোর আলোর ঢাকা অফিসে দেখতে। কত যে প্রশ্ন ওদের। এ রকম আসে অনেকেই, চট্টগ্রাম থেকে, সিলেট থেকে, ঝিনাইদহ থেকে। প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে আসে ওরা—আহসান হাবীবের উপন্যাসের শেষটা কেন এমন, শিবব্রত বর্মন আবার কবে লিখবেন, আদনান মুকিত কি ফার্মের মুরগির নতুন অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে আসবেন। ইসমাইল আরমান স্যার কি অয়ন জিমিকে বাংলাদেশে আনবেন? মেহেদী হক কি নতুন কমিকস দিচ্ছেন? এই সব প্রশ্ন করা এখন আরও সহজ হয়েছে। কারণ, মাসিক কিআড্ডা এখন কিআ কার্যালয়ে তো হয়ই, অনলাইনেও হয় প্রতি মাসে। এতে দেশ ও বিদেশ থেকে শিশু-কিশোরেরা যোগ দেয়। ‘অ্যানিমে সংখ্যা করুন না!’ চিঠি আসে, মেইল আসে। ‘আমার ছোট ভাইয়ের জন্য আমি কিআ আগে পড়তে পারি না। একটা শিশু আলো বের করুন।’ লিখে পাঠায় রংপুর থেকে প্রযুক্তা অক্ষর।

১২ বছর আগে যে ছিল শিশু পাঠক, আজ সে তরুণ, ১২ বছর আগে যে ছিল কিশোর পাঠক, আজ সে যুবক। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে কিশোর আলোর পাঠকেরা। কেউবা ডাক্তার হয়েছে, কেউবা কম্পিউটারবিদ, কেউ শিক্ষক, কেউবা প্রকৌশলী, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ ঢুকেছে করপোরেট জবে। যে যেখানেই থাকুক, যা–ই করুক, তারা একটুখানি এগিয়ে থাকবে মানবিকতায়, দেশপ্রেমে এবং নেতৃত্বের গুণে—এই আমাদের প্রত্যাশা।

ঋতুপর্ণার স্কুলে হোস্টেল সংস্কার চাই

ঋতুপর্ণা এখন ভুটানে। দুদিনের জন্য এসেছিলেন ঢাকায়। তাঁর জন্য সুখবর হলো, তাঁদের স্কুলে আবার প্রশাসন থেকে চাল দেওয়া শুরু হয়েছে। ইউএনও দিয়েছেন এক টন। সামনে জেলা প্রশাসনও দেবে। তবে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ান বলছেন, আরেকটা সাহায্য দরকার। স্কুলের হোস্টেল বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত। হোস্টেলটার সংস্কার লাগবে। আশা করি, সরকার দ্রুতই ব্যবস্থা নেবে।

কিশোর আলোর ১২তম জন্মবার্ষিকী আমরা নানাভাবে উদ্‌যাপন করব। কিশোর আলো অনলাইন, পত্রিকা, ফেসবুক পেজ আর গ্রুপে যুক্ত থাকো, সব খবরই পাবে। আর এই উপলক্ষে সবাইকে জানাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

আনিসুল হক: সম্পাদক, কিশোর আলো