ঋতুপর্ণারা যে স্কুল থেকে উঠে এসেছেন, সে স্কুলেই নেই খাবার আর খেলার সরঞ্জাম
নারী ফুটবলার ঋতুপর্ণা চাকমার মতো হতে চায় ছোট্ট জয়তা চাকমা (১৩)। নানা প্রতিকূলতার পরও জয়তা দৃঢ়প্রত্যয়ী—ঋতুপর্ণার মতো হতে হবেই। এক বছর আগে সে যোগ দিয়েছে ফুটবল প্রশিক্ষণ দলে। জয়তা চাকমা রাঙামাটি সদর উপজেলা বন্দুকভাঙা ইউনিয়নের মবাছড়ি গ্রাম থেকে ফুটবল প্রশিক্ষণ নিতে এসেছে। এসেছে দীপা চাকমাও। দীপার বাড়ি বান্দরবানের থানচি উপজেলার বলিবাজারে। দীপা হতে চায় জাতীয় দলের আরেক ফুটবলার মনিকা চাকমার মতো। শুধু জয়তা ও দীপা নয়, ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে অনুশীলন করছে ২৫ জন মেয়ে।
এখন ফুটবলই তাদের ধ্যানজ্ঞান। ফুটবলের কারিগরখ্যাত প্রতিষ্ঠান রাঙামাটির ঘাগড়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়। আবাসিক এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন বুনছে। ফুটবল অনুশীলনের পাশাপাশি তারা ঘাগড়া বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের পেছনে তিনটি টিনশেড কক্ষে গাদাগাদি করে তারা থাকে। নিজেদের রান্না নিজেরাই করে। সময় পেলে ফুটবল নিয়ে মাঠে নামে তারা। তাদের কোচ শান্তিমনি চাকমা। এই মাঠে ঋতুপর্ণা চাকমা, মনিকা চাকমা, রুপনা চাকমা, আনাই মোগিনী, আনুচিং মোগিনীসহ ৮ থেকে ১০ জন ফুটবলার জাতীয় দলে খেলেছেন। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ঘাগড়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ থেকে তৈরি হচ্ছে ফুটবলার।
৯ জুলাই বিকেলে এই স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, মাঝারি ও ভারী বৃষ্টি হওয়ায় কদিন ধরে খেলতে পারছে না ফুটবলাররা। ২৫ জন মেয়ের মধ্যে আছে মাত্র ১১ জন। রান্নার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। অন্যরা ছুটি কাটাচ্ছে নিজেদের বাড়িতে।
ঋতুপর্ণা চাকমা, মনিকা চাকমা, রুপনা চাকমাদের কোচ শান্তিমনি চাকমা অনুশীলন পরিচালনা করেন। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলপাগল শান্তিমনি চাকমা। স্কুলের পাশেই তাঁর বাসা। কোচিংয়ের পাশাপাশি ব্যবসাও করেন। অভিজ্ঞ এই কোচ জানালেন পাহাড়ের এই নারী ফুটবল দলের পেছনের কথা। তখন ২০১১ সাল। বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য আশপাশের উপজেলা ও জেলায় যেতে হতো। সে সময় যে মেয়েটির খেলা মনে ধরত, তাকেই সিলেক্ট করতেন শান্তিমনি ও বীরসেন চাকমা। বীরসেন তখন মগাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
২০১১ সালে শান্তিমনি চাকমাকে মগাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দলটি গঠনের দায়িত্ব দেন তৎকালীন প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমা। সে বছর বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টে দলটি জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়। তখন থেকে বীরসেন চাকমা অন্য স্কুল থেকে আসা দলের ভালো মেয়ে আনা শুরু করা হয়। একপর্যায়ে খাগড়াছড়ি থেকে মনিকা চাকমা, আনাই মোগিনী, আনুচিংসহ কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে আসা হয়। পরে ঋতুপর্ণা চাকমা, রুপনা চাকমাসহ শক্ত একটি দল গঠন করা হয়। দলটি ২০১৬ সালে স্কুল–মাদ্রাসা গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়। সেখান থেকেই শুরু।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নানা সংকটের মধ্যে স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে এ স্কুলের মেয়েরা। সারা দিন ফুটবল, লেখাপড়া নিয়ে তাদের চিন্তা। তার পাশাপাশি নিজেরা রান্না করে চলে খাবার তৈরি। অথচ তাদের দরকার নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার ও খেলার সরঞ্জাম। এসব নিয়ে চরম সংকটে রয়েছেন তাঁরা। সীমিত হলেও ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল প্রথম আলো। পত্রিকাটির ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গড়ে তোলা নারী ফুটবল তহবিল থেকে অনন্য এই স্কুলটিকে দুই লাখ টাকার চেক দেওয়া হয়েছিল। প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ানের হাতে ১৫ জানুয়ারি ২০২৩–এ চেক তুলে দিয়েছিলেন কিশোর আলোর সম্পাদক আনিসুল হক। কিন্তু সংকট কাটেনি এখনো।
শান্তিমনি চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, এখন ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ে আবাসিক হলে আছে ২৫ জন মেয়ে। তাদের মধ্যে তিন-চারজন খুবই ভালো। তার মধ্যে জয়তা চাকমা মেয়েটি সবচেয়ে ভালো। তাকে যদি আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাহলে তার জন্য জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া কঠিন হবে না। তাদের পুষ্টিকর খাবার ও খেলার সরঞ্জামের সংকট রয়েছে বলে তিনি জানান।
ঘাগড়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্ষার সময় মেয়েদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। আমাদের বিদ্যালয়ের নিচতলায় ঘাগড়াছড়াটি পানি বেড়ে গেলে তলিয়ে যায়। কিছুদিন আগে ভারী বৃষ্টি হওয়ায় তাদের ঘরটি তলিয়ে যায়। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন থেকে মেয়েদের চাল সহায়তা দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে চাল শেষ হয়েছে। জেলা প্রশাসনে খোঁজখবর নেওয়া হলে সেখানেও চাল নেই। সরকারি চাল বরাদ্দ আসতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। এখন কী করব, কিছু বুঝতে পারছি না।’
তবে এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কঠোর অনুশীলন করে যাচ্ছে জয়তা-দীপা চাকমারা। তাদের চোখে স্বপ্নপূরণের প্রত্যয়।