টেইলর সুইফটের কনসার্টের কারণে কি সত্যিই ভূমিকম্প হয়
২০২৩ সালের জুলাই মাসের এক সুন্দর রাত। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল শহরের খোলা আকাশের নিচে লুমেন ফিল্ড অ্যারেনায় ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ অপেক্ষা করছে। ঝলমলে পোশাক আর হাতে তৈরি বিশেষ টুপি পরে আসা মানুষগুলোর উত্তেজনা ছিল চোখে পড়ার মতো। হঠাৎ করেই কনসার্ট অ্যারেনার আলো নিভে গেল। ঘড়ির বিশাল প্রজেকশন টিক টিক করে উল্টো দিকে গুনতে শুরু করল। এরপর টেইলর সুইফট যখন মঞ্চে এলেন, তখন উন্মত্ত জনতা আনন্দে চিৎকার করে লাফাতে শুরু করল।
এই ৭০ হাজার মানুষের লাফানোর উচ্ছ্বাসের কারণে কী হয়েছিল জানো? ২ দশমিক ৩ মাত্রার একটি ভূমিকম্প। বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবার এমন ঘটনার নাম দেওয়া হলো ‘সুইফটকোয়েক’ (SwiftQuake)।
সবকিছু প্রস্তুত ছিল। ২০২৪ সালের ২৮ জুন, শুক্রবার রাতে টেইলর সুইফটের ডাবলিনের কনসার্ট শুরু হলো। মঞ্চে ছোটখাটো কারিগরি ত্রুটি থাকলেও, সুইফটিদের উন্মাদনা ছিল দেখার মতো।
কিন্তু হাজার হাজার মানুষের লাফানো কি সত্যিই ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে? ডাবলিনের একদল গবেষক এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করলেন। তাঁরা দেখতে চাইলেন, টেলর সুইফটের কনসার্টটি বিজ্ঞান শেখানোর একটি মজার মাধ্যম হতে পারে কি না। তাঁদের গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি একটি ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সায়েন্স এডুকেশনে প্রকাশিত হয়েছে। সেই গবেষণায় তাঁরা জানিয়েছেন, কনসার্টে আসা দর্শকদের লাফালাফির কারণে সত্যিই ভূমিকম্পের মতো একটি ঘটনা ঘটেছিল তখন।
ডাবলিন ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের বিজ্ঞানীরা টেইলর সুইফটের কনসার্টের আগে এক মজার বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রস্তুতি নেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল কনসার্টের কারণে মাটিতে কম্পন কতটা হয়, তা মাপা। গবেষকদের একটি দল স্টেডিয়ামের আশপাশে বিভিন্ন দোকান ও বাড়িতে ৪২টি সাইসমোমিটার স্থাপন করেন সে জন্য। সাইসমোমিটার হলো এমন একটি যন্ত্র, যা ভূমিকম্পের মতো মাটির যেকোনো কম্পন রেকর্ড করতে পারে। এতগুলো যন্ত্র বসানোর কারণ ছিল, তাঁরা শুধু একটি নির্দিষ্ট স্থানের কম্পন না মেপে পুরো স্টেডিয়ামের চারপাশের মাটির কম্পনের একটি বিস্তারিত ডেটা পেতে চেয়েছিলেন।
এই গবেষণায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল স্থানীয়দের অংশগ্রহণ। এলাকার অনেক বাসিন্দা এই প্রজেক্টে আগ্রহ দেখান এবং কয়েক সপ্তাহের জন্য নিজেদের বাড়িতে সাইসমোমিটার বসানোর অনুমতি দেন। এতে করে সাধারণ মানুষও একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার অংশ হলেন। গবেষক এলিয়েনর ডান জানতেন যে টেইলর সুইফটের উন্মাদ ভক্তদের যুক্ত করতে পারলে গবেষণাটি আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাবে। তাই তিনি #SwiftQuakeDublin হ্যাশট্যাগ ও একটি লোগো তৈরি করেন, যা ভক্তদের কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। এই উদ্যোগের ফলে প্রজেক্টটি খুব দ্রুতই অনলাইন এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সুইফট যখন ‘শেক ইট অফ’ গানটি গাইছিলেন, তখন দুটো আলাদা জায়গা থেকে ভূমিকম্পের সংকেত রেকর্ড করা হচ্ছিল। একটি জায়গা ছিল ডাবলিনের বাইরে এবং আরেকটি ছিল স্টেডিয়াম থেকে প্রায় ৬০ মাইলেরও বেশি দূরে।
সবকিছু প্রস্তুত ছিল। ২০২৪ সালের ২৮ জুন, শুক্রবার রাতে টেইলর সুইফটের ডাবলিনের কনসার্ট শুরু হলো। মঞ্চে ছোটখাটো কারিগরি ত্রুটি থাকলেও, সুইফটিদের উন্মাদনা ছিল দেখার মতো। ‘লাভ স্টোরি’ থেকে ‘ব্ল্যাঙ্ক স্পেস’ প্রতিটি গানের সঙ্গে ছিল চিৎকার ও লাফ। ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষ স্টেডিয়ামে চারপাশে উপস্থিত হয়ে এক নতুন রেকর্ড তৈরি করেন তখন। এই বিশাল জনসমুদ্রের মাঝে এসেছিলেন বিখ্যাত গায়িকা স্টিভি নিক্সও।
কনসার্ট শেষ হওয়ার পর গবেষকদের দলটি কনসার্টের রাতের ডেটা সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করেন। তাঁদের বিশ্লেষণে সবচেয়ে বেশি কম্পন দেখা যায় ‘লাভ স্টোরি’ গানটির শেষের দিকে। গানের শেষ কোরাসের ঠিক আগে, যখন টেইলর সুইফট গাইছিলেন, তখন উন্মত্ত জনতা সবচেয়ে বেশি লাফিয়ে উঠেছিল। সেই মুহূর্তেই সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পের ঘটনাটি রেকর্ড করা হয়।
গবেষকদের কাছে সবচেয়ে বড় অবাক করা বিষয় ছিল অন্য একটি ঘটনা। তাঁরা যখন আয়ারল্যান্ডের জাতীয় ভূমিকম্প নেটওয়ার্কের (আইএনএসএন) ভূমিকম্প মাপার যন্ত্রগুলোর ডেটা দেখছিলেন, তখন অবিশ্বাস্য একটি জিনিস দেখতে পান তাঁরা। সুইফট যখন ‘শেক ইট অফ’ গানটি গাইছিলেন, তখন দুটো আলাদা জায়গা থেকে ভূমিকম্পের সংকেত রেকর্ড করা হচ্ছিল। একটি জায়গা ছিল ডাবলিনের বাইরে এবং আরেকটি ছিল স্টেডিয়াম থেকে প্রায় ৬০ মাইলেরও বেশি দূরে। অর্থাৎ প্রায় ৫০ হাজার ভক্তের লাফালাফির কম্পন ৬০ মাইলেরও বেশি দূর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
দর্শকেরা ৩০৬টি ভিডিও জমা দেন, যা বিজ্ঞানীদের জন্য এক বাস্তব ডেটা উৎস হিসেবে কাজ করে। এই গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলগুলো দ্রুতই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
গবেষকেরা তাঁদের এই গবেষণায় সাধারণ মানুষকে আরও বেশি যুক্ত করতে কনসার্টে আসা দর্শকদের কাছে তাদের নিজস্ব ভিডিও পাঠানোর অনুরোধ করেন। যাতে দেখা যায় ঠিক কোন সময়ে স্টেডিয়ামের কোথায় কী ঘটেছিল। দর্শকেরা ৩০৬টি ভিডিও জমা দেন, যা বিজ্ঞানীদের জন্য এক বাস্তব ডেটা উৎস হিসেবে কাজ করে। এই গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলগুলো দ্রুতই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে ৪০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই বিষয়ে জানতে পারে।
একটা বড় প্রশ্ন থেকেই যায়। টেইলর সুইফটের কনসার্টে হওয়া এই কম্পনগুলোকে কি সত্যিই ভূমিকম্প বলা যাবে? আসলে, ভূবিজ্ঞানীদের মতে, এটিকে পুরোপুরি ভূমিকম্প বলা যায় না। কারণ, সাধারণত ভূমিকম্প হয় মাটির নিচে টেকটোনিক প্লেট সরে যাওয়ার কারণে। কিন্তু এখানে মাটির কম্পন হয়েছিল হাজার হাজার মানুষের লাফালাফির কারণে। তাই এটিকে মানুষের তৈরি কম্পন বা ‘সুইফটকোয়াক’ বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত। তাই ভূমিকম্প না হলেও, এটি নিঃসন্দেহে একটি অবিশ্বাস্য বৈজ্ঞানিক ঘটনা হিসেবে ইতিহাসে থেকে যাবে।