মাইনক্রাফট কেন এত জনপ্রিয়

বিশ্বজুড়ে তুমুল জনপ্রিয় গেম মাইনক্রাফট (Minecraft)। ছোট-বড় সবার কাছেই গেমটির জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। আপাতদৃষ্টে সাধারণ ব্লকের এই গেম কেন এত জনপ্রিয়? কীভাবে তৈরি হলো ‘মাইনক্রাফট জেনারেশন’?

মাইনক্রাফটের দুনিয়া একেবারেই আলাদা। মাইনক্রাফট মূলত একটি থ্রি–ডি স্যান্ডবক্স গেম। এই গেমে খেলোয়াড়েরা ব্লক ব্যবহার করে যেকোনো কিছু তৈরি করতে পারে। স্যান্ডবক্স গেমে কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা শেষ নেই। খেলোয়াড়েরা চার কোনাবিশিষ্ট ব্লক ভেঙে জিনিসপত্র সংগ্রহ করে। তারপর ব্লকগুলো নতুন করে সাজিয়ে বাড়িঘর, রাজপ্রাসাদ, দুর্গ, শহর, এমনকি যন্ত্রও তৈরি করতে পারে।

মাইনক্রাফটের দুটি প্রধান মোড আছে। একটা হলো সারভাইভাল মোড (Survival Mode)। এখানে খেলোয়াড়দের নতুন পৃথিবী ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হয়, জোগাড় করতে হয় সম্পদ, জিনিসপত্র তৈরি করতে হয়, দানবদের মতো প্রাণীদের (মব) সঙ্গে লড়াই করতে হয় ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। এখানে বিভিন্ন ব্লক ভাঙতে পরিশ্রম করা লাগে। প্রয়োজন হয় নির্দিষ্ট সরঞ্জামের। নিজেদের বাঁচাতে সংগ্রহ করতে হয় খাবার। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম তৈরি করতে হয় বেঁচে থাকার জন্য।

আরও পড়ুন

একনজরে

মুভির নাম: দ্য মাইনক্রাফট মুভি, পরিচালক: জারেড হেস, লেখক: ক্রিস বোম্যান, জারেড হেস ও রামি রসোম, ধরন: অ্যাডভেঞ্চার, ফ্যান্টাসি, কমেডি, লাইভ-অ্যাকশন প্রকাশকাল: এপ্রিল, ২০২৫, ব্যাপ্তি: ১ ঘণ্টা ৪১ মিনিট, আইএমডিবি রেটিং: ৫.৬/১০

মাইনক্রাফটের সারভাইভাল মোডের কঠিন একটি সাব–ক্যাটাগরি হলো ‘হার্ডকোর মোড’। যারা নিজেদের টিকে থাকার ক্ষমতাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পরীক্ষা করতে চায়, এই মোড তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। হার্ডকোর মোডে শুধু একটি জীবন থাকে। যদি একবারও মারা যাও, তাহলে তৈরি করা পুরো বিশ্বটি চিরতরে মুছে যায়। আর সেই বিশ্বে ফিরে যাওয়া যায় না। হার্ডকোর মোড সাধারণ সারভাইভাল মোডের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা দেয় খেলোয়াড়দের।

দ্বিতীয়টি হলো ক্রিয়েটিভ মোড (Creative Mode)। এই মোডে খেলোয়াড়দের কাছে থাকে অসীম ব্লক আর ওড়ার ক্ষমতা। ফলে তারা নিজেদের কল্পনাকে কাজে লাগিয়ে ইচ্ছেমতো যেকোনো কিছু তৈরি করতে পারে। মাইনক্রাফটে নানা রকম ভার্চ্যুয়াল প্রাণীও আছে। যার মধ্যে কিছু প্রাণীকে শিকার করে খেতে বা পোষ মানাতে পারে খেলোয়াড়েরা। এদের মধ্যে ‘মুশরুম’ নামের একটি লাল-সাদা গরুর মতো প্রাণী আছে, যা এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়ায়।

২০২৩ সালের ‘মাইনক্রাফট লাইভ ২০২৩’ ইভেন্টে মোজাং স্টুডিওর প্রধান হেলেন চিয়াং জানান, সুইডেনের ভিডিও গেম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘মোজাং স্টুডিও’র তৈরি মাইনক্রাফট ৩০ কোটির বেশিবার বিক্রি হয়েছে। এর মাধ্যমে মাইনক্রাফট বিশ্বে প্রথমবারের মতো ৩০ কোটির বেশি বিক্রি হওয়া ভিডিও গেমের রেকর্ড গড়েছে। ২০১১ সালে বাজারে আসার এক যুগ পরও গেমটি গেমারদের কাছে নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে।

মাইনক্রাফটের পৃথিবীটা কল্পনার চেয়ে অনেক বড়। মাইনক্রাফটের পৃথিবী প্রায় ছয় কোটি ব্লক চওড়া এবং ছয় কোটি ব্লক লম্বা। এর মোট আয়তন প্রায় ৩ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন বর্গব্লক। যদি মাইনক্রাফটের প্রতিটি ব্লককে এক মিটার লম্বা ও এক মিটার চওড়া ধরা হয়, তাহলে এই পৃথিবী প্রায় ৬০ হাজার কিলোমিটার চওড়া ও লম্বা। মাইনক্রাফটে সর্বোচ্চ ৩২০ ব্লক উঁচু পর্যন্ত কিছু তৈরি করা যায়। আর মাইনক্রাফটের দুনিয়াটার যদিও শেষ আছে, তবু এটা এতটাই বিশাল যে বেশির ভাগ খেলোয়াড়ের কাছে এটাকে প্রায় অসীম বলেই মনে হবে। কেননা এর শেষ খুঁজে পাওয়া বা সবটা ঘুরে দেখা প্রায় অসম্ভব।

মাইনক্রাফটের পৃথিবীটা বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করা। এসব এলাকাকে বলা হয় ‘বায়োম’ (Biome)। এক বায়োম থেকে আরেক বায়োমে ঢুকলেই সেখানকার পরিবেশ ও প্রকৃতি পুরোপুরি বদলে যায়। গেমটির কিছু পরিচিত বায়োম হলো মরুভূমি, সমতল ভূমি, পাহাড়ি এলাকা, বন, নদী আর সাগর।

বায়োমগুলোর মধ্যেও আবার ছোট ছোট ভাগ অর্থাৎ উপ-অঞ্চল বা সাব-বায়োম আছে। যেমন সাগরের মধ্যেই উষ্ণ পানির সাগর, বরফে ঢাকা সাগর বা গভীর সাগর দেখা যায়। বনের ভেতরেও আছে ফুল, ম্যানগ্রোভ থেকে শুরু করে দানব গাছের বন। সব মিলিয়ে মাইনক্রাফটের জাভা সংস্করণে মোট ৬৪টি বায়োম আছে।

আরও পড়ুন

নানা ধরনের জীবজন্তু বাস করে বায়োমগুলোয়। যেমন লামা শুধু পাহাড়ি এলাকায় দেখা যায়। আর মেরু ভালুক পাওয়া যায় বরফে ঢাকা সাগরে। অন্যদিকে গরু আর মুরগি প্রায় সব বায়োমেই দেখতে পাওয়া যায়।

মাইনক্রাফট গেমে সবচেয়ে মজার কাজগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘মাইনিং’। মানে মাটি খুঁড়ে সম্পদ জোগাড় করা। মাইনক্রাফটের মাটির নিচে থাকা খনিগুলোয় তামা, লোহা, সোনা আর হীরার মতো মূল্যবান জিনিস পাওয়া যায়। এগুলো বের করে আনার জন্য মাটির গভীরে খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়। এই কাজ যেমন মজার, তেমনি বেশ রোমাঞ্চকরও। কারণ, খনির প্রতিটি ধাপে মৃত্যুর ঝুঁকি লুকিয়ে থাকে।

খনির গভীরে লুকিয়ে আছে আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভা। মাইনিং করার সময় অসাবধানতাবশত একবার যদি লাভায় পা পড়ে যায়, তাহলে আর রক্ষা নেই; সঙ্গে সঙ্গে পুরো শরীরে আগুন ধরে যায়।

তবে এই বিপজ্জনক লাভারও একটি দারুণ ব্যবহার আছে। লাভার ওপর পানি ছিটিয়ে দিলে তা শক্ত, কালো পাথরে পরিণত হয়। যার নাম ‘অবসিডিয়ান’ (Obsidian)। কুড়াল ব্যবহার করে এই শক্তিশালী অবসিডিয়ান ব্লকগুলো ভাঙা যায়। যখন ১০টি বা এর বেশি অবসিডিয়ান ব্লক সংগ্রহ করে তা দিয়ে একটি বাক্স তৈরি করা হয়, তখন একটি বেগুনি রঙের পোর্টাল খুলে যায়। এই পোর্টাল ব্যবহার করেই মাইনক্রাফটের রহস্যময় ‘নেদার’ দুনিয়ায় প্রবেশ করা যায়। এভাবে একেকটি ব্লক সংগ্রহ করে যাওয়া যায় একেক পোর্টালে।

তবে মাইনক্রাফট গেমে দুটো বস আছে। ‘বস’ হলো এমন কিছু দানবীয় প্রাণী বা মব (Mob) যারা অত্যন্ত শক্তিশালী ও আক্রমণাত্মক। এরা খেলোয়াড়ের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই বসদের পরাজিত করা মাইনক্রাফট গেমের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। মাইনক্রাফটে মূলত দুটি প্রধান বস রয়েছে। এন্ডার ড্রাগন (Ender Dragon) ও উইদার (Wither)। যদিও ওয়ার্ডেন (Warden) ও এল্ডার গার্ডিয়ানের (Elder Guardian) মতো আরও কিছু শক্তিশালী মব আছে। মবদের মধ্যে মাইনক্রাফটে ক্রিপার (Creeper) হলো অন্যতম পরিচিত ও কুখ্যাত। মাইনক্রাফটের আইকনিক চরিত্র হয়ে উঠেছে এই ক্রিপার।

উইকিপিডিয়া তো আমরা সবাই চিনি। সেখানে সব তথ্য পাওয়া যায়। মাইনক্রাফটের বিশাল দুনিয়ার সব খবর ও তথ্যের জন্য তেমনি রয়েছে মাইনক্রাফট উইকি (minecraft.wiki)। যেটাকে বলা হয় মাইনক্রাফট গেম–সম্পর্কিত সব তথ্যের এক বিশাল অনলাইন বিশ্বকোষ বা এনসাইক্লোপিডিয়া। মাইনক্রাফটের ব্লক, আইটেম, ক্রাফটিং টেবিল, ক্রাফটিং রেসিপি, মব আর নিয়মকানুনও অগণিত। কোনো নতুন খেলোয়াড় বা অভিজ্ঞ গেমার যে–ই হোক না কেন, যেকোনো তথ্যের জন্য মাইনক্রাফট উইকিই তার প্রথম যাওয়ার জায়গা।

আরও পড়ুন

ইউটিউবের অন্যতম জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর জিমি ডোনাল্ডসন, যাঁকে সবাই চেনে ‘মিস্টার বিস্ট’ নামে। ইউটিউব যাত্রার শুরুর দিকে মাইনক্রাফট নিয়ে ভিডিও তৈরি করতেন তিনি। তাঁর ভিডিওগুলোয় খেলোয়াড়দের বিভিন্ন মজার ও ব্যয়বহুল মাইনক্রাফট চ্যালেঞ্জ দিতেন, যা দর্শকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

মাইনক্রাফটের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার পেছনে ইউটিউবের বেশ কিছুটা ভূমিকা রয়েছে। মিস্টার বিস্ট, পিউডিপাইদের মতো অসংখ্য কনটেন্ট ক্রিয়েটর মাইনক্রাফট গেমের ভিডিও তৈরি ও লাইভ স্ট্রিমিং করতেন। এই কনটেন্ট নির্মাতারা গেমের বিভিন্ন দিক, যেমন জটিল নির্মাণ কৌশল, সারভাইভাল অ্যাডভেঞ্চার, নতুন আপডেট ও মজার চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কাজ করতেন। এর ফলে মাইনক্রাফট কেবল একটি খেলা না থেকে একটি বিশাল ডিজিটাল কমিউনিটিতে পরিণত হয়েছে। তৈরি হয়েছে মাইনক্রাফট জেনারেশন।

আরও পড়ুন

এতক্ষণ মাইনক্রাফটের গেমের দুনিয়া নিয়ে কথা বলছিলাম। যেখানে সবকিছুই ব্লক দিয়ে তৈরি। গেমের খেলোয়াড়দের কথা ভেবে ওয়ার্নার ব্রোস এবার তৈরি করেছে দ্য মাইনক্রাফট মুভি (The Minecraft Movie)। মুভিতেও গেমের মতোই একটি ব্লকের দুনিয়া তৈরি করা হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে দুর্দান্ত ক্লাইম্যাক্স।

লাইভ-অ্যাকশনে ভরপুর সত্যিকারের অভিনেতারা মাইনক্রাফটের সেই ব্লকের পরিবেশে অভিনয় করেছেন। মুভিটার পরিচালক জারেড হেস। যিনি নেপোলিয়ন ডায়নামাইট ও নাচো লিব্রের মতো দারুণ কমেডি মুভি বানিয়েছেন। অভিনয় করেছেন অ্যাকোয়াম্যানখ্যাত জেসন মোমোয়া, কমেডিয়ান জ্যাক ব্ল্যাকসহ একঝাঁক তারকা। তবে মজার বিষয় হলো, অভিনেতা জ্যাক ব্ল্যাক শুটিং চলাকালে তাঁর ছেলের সঙ্গে প্রায় ১০০ ঘণ্টা মাইনক্রাফট খেলেন।

দ্য মাইনক্রাফট মুভি শুধু গেমারদের জন্য নয়। যারা মাইনক্রাফট তেমন বোঝে না বা জানতে চায় এর বিশাল দুনিয়া সম্পর্কে, তারাও এই মুভির অ্যাডভেঞ্চারে মুগ্ধ হবে। তবে মাইনক্রাফট জেনারেশনের বেশির ভাগ কমিউনিটি বলেছে, তারা মাইনক্রাফট পছন্দ করে তবে দ্য মাইনক্রাফট মুভি তাদের ভালো লাগেনি। যারা নতুন কিছু দেখতে পছন্দ করো, তাদের কাছে বেশ ভালো লাগতে পারে।

আরও পড়ুন