লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারির গঠনে ছোট পরিবর্তন করে আগুনের ঝুঁকি দূর করা সম্ভব হবে, নতুন গবেষণা
তোমার পকেটে থাকা স্মার্টফোন থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক গাড়ি, এমনকি আকাশে ওড়া বিমান, কোথায় নেই লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি? এই ব্যাটারি ছাড়া এখন আমাদের জীবন কল্পনা করা যায় না। কিন্তু এই সুবিধার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর ঝুঁকি। সঠিকভাবে ব্যবহার না হলে কিংবা সামান্য ত্রুটি ঘটলেই এই ব্যাটারিতে হুট করে আগুন ধরে যেতে পারে। কখনো কখনো এই আগুন হতে পারে মৃত্যুর কারণ।
লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির ভেতরে থাকে দাহ্য ইলেকট্রোলাইট। এটি একধরনের তরল রাসায়নিক দ্রবণ, যা বিদ্যুৎপ্রবাহে সাহায্য করে। ব্যাটারিতে ছিদ্র হলে, অতিরিক্ত চার্জ, খুব বেশি গরম বা উৎপাদনজনিত ত্রুটিতে এই ইলেকট্রোলাইট স্বাভাবিক থাকে না। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাটারির ভেতরে শুরু হয় ভয়ংকর এক প্রতিক্রিয়া, যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন ‘থার্মাল রানঅ্যাওয়ে’। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ব্যাটারির তাপমাত্রা কয়েক শ ডিগ্রিতে পৌঁছে আগুন ধরে যেতে পারে।
বিশেষ করে বিমান চলাচলে এই ঝুঁকি মারাত্মক। বিমানে থাকা অসংখ্য ব্যাটারিচালিত যন্ত্র আর ছোট জায়গা—দুটি বিষয় মিলে আগুন লাগলে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য বলছে, শুধু ২০২৪ সালেই যাত্রী ও পণ্যবাহী বিমানে ব্যাটারি-সংক্রান্ত ৮৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ঘটেছে আরও ৩৮টি ঘটনা। দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে একটি এয়ারবাস উড়োজাহাজে আগুন লাগার ঘটনাও সম্ভবত একটি পাওয়ার ব্যাংক থেকেই শুরু হয়েছিল।
এই ঝুঁকি শুধু আকাশেই নয়। ঘরে ঘরে ই-বাইক, ই-স্কুটার আর পাওয়ার টুলসের ব্যাটারি থেকেও আগুন লাগার ঘটনা বাড়ছে। যুক্তরাজ্যের এক জরিপে দেখা গেছে, অর্ধেকের বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি থেকে আগুন বা বিস্ফোরণের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে।
এ সমস্যার সমাধানে বিশ্বজুড়ে গবেষণা চলছে। তবে বেশির ভাগ সমাধানে দেখা গেছে, পুরো ব্যাটারি উৎপাদনপদ্ধতি বদলে ফেলতে হবে। কিন্তু হংকংয়ের চায়নিজ ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক দেখিয়েছেন, খুব ছোট পরিবর্তন করে ব্যাটারির এই ঝুঁকি দূর করা সম্ভব হবে।
ইউয়ে সান নামের এক গবেষকের নেতৃত্বে তাঁরা ব্যাটারির নকশায় একটি নতুন ধরনের ইলেকট্রোলাইট প্রস্তাব করেছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এতে ব্যাটারির মূল কাঠামো বদলাতে হচ্ছে না। শুধু ইলেকট্রোলাইটের রাসায়নিক উপাদান পাল্টালেই কাজ হবে।
এই নতুন ইলেকট্রোলাইটে ব্যবহার করা হয়েছে দুটি ভিন্ন দ্রাবক। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় প্রথমটি ব্যাটারির কর্মক্ষমতা ধরে রাখে। কিন্তু তাপ বাড়তে শুরু করলে দ্বিতীয় দ্রাবকটি সক্রিয় হয়ে রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার গতি কমিয়ে দেয়। ফলে আগুন লাগার আগেই থেমে যায় বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া।
ল্যাব পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই নতুন ইলেকট্রোলাইটযুক্ত ব্যাটারিতে পেরেক ঢুকিয়ে দেওয়া হলেও তাপমাত্রা বাড়ছে মাত্র সাড়ে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অথচ সাধারণ ব্যাটারিতে একই পরীক্ষায় তাপমাত্রা লাফিয়ে উঠেছে ৫৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তবু ব্যাটারির কর্মক্ষমতা কমেনি। এক হাজার বার চার্জ দেওয়ার পরও এটি ৮০ শতাংশের বেশি ক্ষমতা ধরে রেখেছে।
গবেষকদের মতে, যেহেতু ইলেকট্রোলাইট একটি তরল, তাই বর্তমান ব্যাটারি উৎপাদন কারখানাগুলোতেই ব্যাটারিতে এই পরিবর্তন আনা সম্ভব। নতুন যন্ত্র বা বড় বিনিয়োগের দরকার নেই। সামান্য খরচ বাড়লেও বড় পরিসরে উৎপাদন করলে এর দাম বর্তমান ব্যাটারির কাছাকাছিই থাকবে।
যদি সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোয়, তাহলে তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই এই নিরাপদ ব্যাটারি বাজারে আসতে পারে। তখন হয়তো স্মার্টফোন চার্জে রেখে ঘুমানো কিংবা বিমানে পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে উঠতে আর এত ভয় কাজ করবে না। ব্যাটারির দুনিয়ায় এই ছোট পরিবর্তন হয়তো বড় আগুন থেকে আমাদের বাঁচিয়ে দেবে।
সূত্র: সিএনএন