লিফটের কি বিশ্রাম দরকার, নাকি সার্ভিসিং
আমার স্কুল থেকে বাসার গ্যারেজ পর্যন্ত আসতে যে কষ্ট হয়, তার চেয়ে বেশি কষ্ট হয় গ্যারেজ থেকে ছয়তলার বাসায় পৌঁছাতে। বাসায় গিয়ে শুনি ছোট্ট একান্ত এই অভিযোগ করছে। ব্যাখ্যা করে বলছে, ‘আমার স্কুল ছুটি হয় বিকেল চারটায়। স্কুল থেকে হেঁটে বাসায় ফিরতে সাড়ে চারটা বাজে। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে ফিরতে তেমন অসুবিধা হয় না। তবে বাসার গ্যারেজে এসে যখন দেখি লিফট বন্ধ, তখন আর ভালো লাগে না। ছয়তলায় হেঁটে উঠতে একদম পা ব্যথা হয়ে যায়। স্কুলের ভারী ব্যাগটা নিয়ে যখন সিঁড়ি বেয়ে ছয়তলায় উঠি, আমার দম বেরিয়ে যায়।’
এটা শুধু ছোট্ট একান্তের কথা না, ঢাকায় বা সারা দেশের বহু বাসায় প্রতিদিন এমন অনেকেই এই সমস্যার মুখোমুখি হন। কাজ থেকে বাসায় ফিরে দেখেন লিফট বন্ধ। এতে তাঁরা অবাক হন না, কারণ এটি ‘বাড়িওয়ালার’ নিয়ম। ঢাকার বাড়িওয়ালা বা অ্যাপার্টমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনগুলোর অদ্ভুত কিছু নিয়মের মধ্যে এটি একটি। আরও অদ্ভুত কিছু নিয়ম আছে, যেমন ছাদে ভাড়াটিয়া উঠতে পারবে না। এর থেকে বেশি অদ্ভুত হলো লিফট নির্দিষ্ট সময় বন্ধ থাকার নিয়ম। বাসায় যদি একটি মাত্র লিফট থাকে, তখন অসুবিধা হয় সবচেয়ে বেশি। একাধিক লিফট থাকলেও দেখা যায়, বাড়িওয়ালারা একটি লিফট বন্ধ করে রাখেন। ভাড়াটিয়ার এখানে কিছু বলার নেই। লিফট চালু বা বন্ধ করার ক্ষমতা কেবল তাঁদের হাতেই।
কেন লিফট বন্ধ রাখতে চান বাড়িওয়ালারা? আমাদের বাসাতেই খোঁজ নিলাম। জানতে পারলাম, লিফট সারাক্ষণ চালালে বিদ্যুৎ বেশি খরচ হয়। তাই দিনে বা রাতে নির্দিষ্ট সময় লিফট বন্ধ করে রাখলে বিদ্যুৎ খরচ কম হয়। বিলও কম আসে। বিদ্যুতের কথাটা স্বীকার না করে অন্যকে বোকা বানাতে চান অনেক বাড়িওয়ালা। দাবি করেন, লিফটের বিশ্রামের দরকার আছে।
লিফট কি সত্যিই বিশ্রাম চায়?
লিফট বা এলিভেটর ছাড়া এখন আর বহুতল ভবন বানানো হয় না। এটি আমাদের জীবন অনেক সহজ করে দিয়েছে। কিন্তু আবাসিক ভবনে নির্দিষ্ট কিছু সময় লিফট বন্ধ করে রাখার মতো অদ্ভুত ঘটনা অন্য কোথাও সচরাচর দেখা যায় না।
একটু মাথা খাটালেই বোঝা যায়, লিফটের বিশ্রাম দরকার—এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। লিফট এমন একটি যন্ত্র যা একটানা কাজের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। এটি গাড়ি বা অন্য কোনো যন্ত্রের মতো নয়, যার একটানা ব্যবহারের পর ইঞ্জিন ঠান্ডা হওয়ার জন্য বিরতি প্রয়োজন। একটি আধুনিক লিফট দিনে ২৪ ঘণ্টাই নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
লিফট বন্ধ রাখলে কি বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়?
লিফটের বিশ্রাম দরকার—এই কথাটি বাড়িওয়ালারা বলেন মূলত বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য। লিফট চালু রাখতে বিদ্যুৎ খরচ হয়। সকাল বা সন্ধ্যার মতো ব্যস্ত সময় ছাড়া অন্য সময়ে লিফটের ব্যবহার কমে যায়। এ সময় লিফট বন্ধ রাখলে বিদ্যুৎ বিল কিছুটা কম আসে। টাকা বাঁচাতে তাই এই কৌশল ব্যবহার করেন বাড়ির মালিকেরা।
কিন্তু বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের এই সিদ্ধান্তটি একটি মারাত্মক ভুল। এর ফলে অনেক ঝুঁকি তৈরি হয়। লিফট বারবার বন্ধ বা চালু করলে তার ওপর বরং অতিরিক্ত চাপ পড়ে। বন্ধ করার পর চালু করলে লিফটের মোটরের পুরো সিস্টেমটি রিস্টার্ট করতে হয়। এতে লিফটের যন্ত্রাংশের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, এগুলো দ্রুত নষ্ট হয়। লিফটকে নিয়মিত সচল রাখা এবং সময়মতো সার্ভিসিং করালেই তা দীর্ঘদিন ভালো থাকে। বারবার চালু ও বন্ধ করার চেয়ে নিয়মিত সার্ভিসিং করানোই বেশি যুক্তিযুক্ত, কারণ এতে বড় ধরনের মেরামতের খরচ কমে।
লিফট বন্ধের বিপদ ও ঝুঁকি
লিফট বন্ধ রাখার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো জরুরি পরিস্থিতিতে মানুষের দুর্ভোগ। ধরা যাক, কোনো ভবনের সাততলায় একজন বৃদ্ধ মানুষ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অথবা কোনো গর্ভবতী নারীর জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। লিফট বন্ধ থাকার কারণে তাঁকে সিঁড়ি ব্যবহার করে নিচে নামতে হবে, যা তাঁর জীবনের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বয়স্ক, অসুস্থ বা প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা এমনিতেই কঠিন, আর জরুরি অবস্থায় এটি প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আবার শিশুদের পক্ষে লম্বা সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করা বেশ কঠিন।
সম্প্রতি ঢাকায় ভাইরাস জ্বর ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্য অনেকের মতো আমিও আক্রান্ত হয়েছিলাম। এর মধ্যে এক দুপুরে যখন হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ল, দেখলাম ঘড়িতে বাজে বেলা তিনটা। আমাদের বাসায় লিফট বন্ধ থাকে দুপুর ২টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। সেদিন লিফট বন্ধ থাকায় বেশ বিপদে পড়েছিলাম। আমাকে হেঁটে নামতে হয়েছিল। বহু মানুষ এমন বিপদে পড়ে।
যদি লিফট বন্ধ থাকার কারণে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তবে এর দায়ভার কে নেবে? সামান্য বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য একটি জীবন বিপন্ন হতে পারে। এর চেয়ে বরং নিয়মিত লিফট সার্ভিসিং করানো জরুরি। লিফটের গতি যদি মসৃণ না হয়, অস্বাভাবিক শব্দ হয়, ঘন ঘন বন্ধ হয়ে যায় বা ফ্লোরে ঠিকমতো না থামে, তবে এসব লক্ষণ গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে লিফটের এই সমস্যাগুলো গুরুতর হতে পারে এবং বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
লিফটের বিশ্রাম দরকার—এই ধারণা যেমন ভুল, তেমনি এটি মানুষের জীবনযাপনের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করে। বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে গিয়ে বাড়ির বাসিন্দাদের ঝুঁকিতে ফেলা মোটেও ঠিক না।