শ্রমিকদের পোশাক জিনস কীভাবে হয়ে উঠল তরুণদের স্টাইল

ছবি: নিউইয়র্ক ম্যাগাজিন

শার্ট, টি-শার্ট, হুডি কিংবা টপস—যেকোনো পোশাকের সঙ্গেই মানিয়ে যায় জিনস। স্কুল, খেলার মাঠ, বন্ধুদের আড্ডা কিংবা পার্টিতে—সব জায়গায় জিনস থাকে পছন্দের তালিকার শীর্ষে।

জিনস কিন্তু তরুণদের কথা চিন্তা করে বানানো হয়নি। এর পেছনে রয়েছে দেড় শ বছরের বেশি সময় আগের ইতিহাস। তুমি কি জানো, প্রথম দিকে জিনস প্যান্ট তৈরি হয়েছিল খনিতে কাজ করা শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে? চলো, জেনে নেওয়া যাক জনপ্রিয় এই পোশাকের ইতিহাস।

কীভাবে এল আজকের জিনস প্যান্ট

১৮৭০-এর দশকে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াসহ পশ্চিমাঞ্চলে ‘গোল্ড রাশ’ চলছিল। ওই সময়ে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় সোনা পাওয়ার খবরে হাজার হাজার মানুষ সেখানে ছুটে যেত। মানুষ ভাবত, কোনোভাবে স্বর্ণ খুঁজে পেলেই রাতারাতি ধনী হয়ে উঠবে। স্বর্ণের খনিতে বহু শ্রমিক কাজ করতেন তখন। কাজটা ছিল প্রচণ্ড পরিশ্রমের। পাথুরে খনিতে দীর্ঘ সময় ধরে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চালিয়ে যেতে হতো। শ্রমিকদের তাই প্রয়োজন ছিল এমন এক পোশাক, যা হবে টেকসই, ছিঁড়ে যাবে না সহজেই।

আরও পড়ুন

সেই সময়ে লেভি স্ট্রস নামের এক কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি খনিশ্রমিকদের জন্য মূলত ডেনিম ও ক্যানভাস কাপড়ের মতো মোটা কাপড় বিক্রি করতেন। জ্যাকব ডেভিস নামের এক দরজি তখন লেভি স্ট্রসের কাছ থেকে কাপড় কিনে আনতেন। মূলত খনিশ্রমিকদের জন্য কাপড় সেলাই করতেন তিনি। জ্যাকব খেয়াল করেন, খনিতে কাজ করার কারণে শ্রমিকদের পোশাক খুব তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে যায়। বিশেষ করে পকেট, হাঁটু ও কোমরের কাছের সেলাইয়ের জায়গাগুলো ছিঁড়ে যেত। এ সমস্যার একটি চমৎকার সমাধান বের করেন ডেভিস। প্যান্টের ওই জায়গাগুলো তামার রিভেট দিয়ে সেলাই করেন তিনি। রিভেট দেখতে ছোট গোল বোতামের মতো। এটি কাপড়ের একদিকে ফুটো করে বসিয়ে অন্যদিক ঠুকে চ্যাপটা করে দেওয়া হয়, যেন তা নড়চড় করতে না পারে। এতে কাপড়ের দুটি অংশ শক্তভাবে আটকে থাকে। এর ফলে প্যান্টের ডিজাইন অবিশ্বাস্যভাবে টেকসই হয়ে ওঠে।

শ্রমিকদের মধ্যে দ্রুতই ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই প্যান্ট। জ্যাকব বুঝতে পারেন, এই উদ্ভাবন অনন্য। কিন্তু তিনি একজন দরজি। প্যাটেন্ট করার মতো অর্থনৈতিক অবস্থা তাঁর ছিল না। তিনি লেভি স্ট্রসকে চিঠি দিয়ে বলেন, তাঁরা যদি একসঙ্গে প্যান্টের ডিজাইনটি প্যাটেন্ট করেন, তবে এটি বাণিজ্যিকভাবে সফল পণ্য হতে পারে।

জ্যাকবের এ প্রস্তাবে সাড়া দেন লেভি স্ট্রস। পরবর্তী সময়ে তাঁরা দুজন একসঙ্গে ১৮৭৩ সালের ২০ মে ‘রিভেটেড জিনস প্যান্ট’–এর প্যাটেন্ট পান।

আরও পড়ুন
জিন্স এখন তরুণদের প্রিয় স্টাইল

প্রথম দিকের জিনস প্যান্ট ছিল নীল রঙের। কারণ, প্রাকৃতিকভাবে নীল রং সহজলভ্য ছিল। কম দামে পাওয়া যেত। আবার শ্রমিকেরা প্রতিদিন ধুলা, কাদার যে পরিবেশে কাজ করতেন, নীল রং এসব দাগ-ময়লা সহজে ঢেকে ফেলত। তাই কাপড় দেখতে নতুনের মতো লাগত অনেক দিন। তাই ধীরে ধীরে এই প্যান্ট শুধু খনিশ্রমিক নয়, কাউবয়, রেলশ্রমিক, কাঠুরে, সৈনিক, কৃষক—সবাই পরতে শুরু করেন।

কবে জনপ্রিয়তা পেল তরুণদের কাছে

যাঁরা বাইরে কাজ করতেন এবং শারীরিক পরিশ্রম করতেন, শুরুতে তাঁদের মধ্যেই জনপ্রিয় ছিল জিনস। যেমন কৃষক, শ্রমিক, সৈনিক। তবে এ চিত্র বদলে যায় ১৯৫০–এর দশকে। তখন হলিউড সিনেমার তারকাদের কারণে দ্রুত তরুণদের পছন্দের পোশাকে পরিণত হয় জিনস। সেই সময়ে ‘দ্য ওয়াইল্ড ওয়ান’ সিনেমায় মার্লন ব্র্যান্ডো এবং ‘রেবেল উইদাউট আ কজ’ সিনেমায় জেমস ডিনের জিনস পরা লুক তরুণদের কাছে আইকনিক হয়ে ওঠে। জিনস প্যান্ট হয়ে ওঠে বিদ্রোহ আর সাহসের প্রতীক। প্রচলিত ধারার বাইরের এ পোশাক রাতারাতি তরুণদের কাছে জনপ্রিয়তা পায়।

আরও পড়ুন

ষাট ও সত্তরের দশকের বিখ্যাত সংগীতশিল্পীরাও জিনস পরতেন। এলভিস প্রিসলি, জন লেনন, বব ডিলানদের মতো শিল্পীরা জিনস পরেই মঞ্চে গান গাইতেন। আশি ও নব্বইয়ের দশকে বিশ্বজুড়ে মডেল, সেলিব্রেটি, খেলোয়াড়েরা জিনস পরতে শুরু করলে এটি আন্তর্জাতিক ফ্যাশনের অংশ হয়ে ওঠে। এখনো বিটিএস থেকে শুরু করে টেলর সুইফটসহ অনেক তারকা জিনস পরেন। তবে শুধু ক্যাজুয়াল পোশাক হিসেবে নয়, ক্রিশ্চিয়ান স্টুয়ার্ট, বিলি আইলিশের মতো তারকারা জিনস পরে রেড কার্পেটও মাতিয়েছেন।

শ্রমিকদের প্রয়োজন থেকে শুরু হয়েছিল জিনসের যাত্রা। আর আজ তা হয়ে উঠেছে তরুণদের প্রিয় স্টাইল। সময়ের সঙ্গে ডিজাইন বদলালেও এ পোশাকের আবেদন কমেনি; বরং আরামদায়ক এ পোশাক সব বয়সী মানুষের ওয়ার্ডরোবে জায়গা করে নিয়েছে।

আরও পড়ুন