বাড়ির উঠানে পাওয়া গেল দুই হাজার বছর পুরোনো রোমান সমাধিফলক

গত মার্চ মাসের এক সকাল। বাড়ির উঠান পরিস্কার করছিলেন দানিয়েলা সান্তোরো আর তাঁর স্বামী অ্যারন লরেঞ্জ। উঠানটা জঙ্গল হয়ে ছিল। সেটাকে কেটেছেটে ঠিকঠাক করছিলেন তাঁরা। এমন সময় মাটি আর শ্যাওলায় ঢাকা এক কোণে তাঁরা অদ্ভুত একটা জিনিস খুঁজে পেলেন। সাদা মার্বেলের এক টুকরো পাথর, যার গায়ে খোদাই করা আছে অচেনা ভাষায় কিছু লেখা। এটি কোনো ইংরেজি শব্দ বা পরিচিত ভাষার লেখা না। পাথরের গায়ে তাঁরা দেখলেন প্রাচীন ল্যাটিন অক্ষরের সারি। ঘটনাটা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্স শহরের শান্ত এক এলাকায়।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্স শহরের শান্ত এক এলাকায় এক বাড়ির উঠানে পাওয়া গেছে এই সমাধিফলকতুলেন ইউনিভার্সিটি

ড. সান্তোরো পেশায় একজন নৃবিজ্ঞানী। চোখের এক দেখাতেই তাঁর মনে হলো, এটি হয়তো একটি সমাধিফলক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমন প্রাচীন জিনিস নিউ অরলিন্সের এই ব্যাকইয়ার্ডে এল কোথা থেকে?

সৈনিকের সমাধি

ড. সান্তোরোর ধারণা সত্যি। খোদাই করা পাথরটি আসলে দুই হাজার বছরের পুরোনো এক রোমান সৈনিকের সমাধিফলক। সৈনিকের নাম সেকসটাস কনজেনিয়াস ভেরাস। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর একজন নাবিক ও সৈনিক তিনি। ২২ বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করার পর ৪২ বছর বয়সে মারা যান।

যেভাবে জানা গেল

সান্তোরো এই পাথরের ফলকের ছবি তোলেন। এক পর্যায়ে ছবিটি টিউলেন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. সুজান লুজনিয়ার হাতে পৌঁছায়। তিনি এক মুহূর্তেই বুঝে ফেলেন, এটি রোমান যুগের আসল লিপি। ড. সুজান বলেন, ‘ছবিটা দেখেই আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ল্যাটিন লিপিটা এত স্পষ্ট ছিল, বুঝতে একদম দেরি হয়নি।’

তবে ই-মেইলটা ড. সান্তোরো পাঠিয়েছিলেন ১ এপ্রিল। এটি আবার এপ্রিল ফুলস ডে! তাই ড. সুজানের প্রথমে একটু সন্দেহ হয়েছিল। এর অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি খুঁজে বের করেন, পাথরটির লিপি ১৮৬০-এর দশকে ইতালির চিভিতাভেচ্চিয়া শহরের এক প্রাচীন রোমান কবরস্থানে পাওয়া একগুচ্ছ সমাধিলিপির অংশ।

আরও পড়ুন

যুদ্ধ, হারিয়ে যাওয়া, পুনরাবিষ্কার

১৯১০ সালে এই পাথরটি ছিল ইতালির স্থানীয় পৌর গ্রন্থাগারে। পরে ১৯১৮ সালে সেটি স্থানান্তরিত হয় শহরের নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিউজিয়ামটি মিত্রবাহিনীর বোমা হামলায় ধ্বংস হয়ে যায়। পরে পাথরটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর প্রায় এক শতাব্দী পার হয়ে গেছে। কেউ জানত না সমাধিফলকটির পরিণতি কী হয়েছে, যতক্ষণ না নিউ অরলিন্সের বাড়ির উঠানে সেটি আবার পাওয়া গেল।

ইতালির চিভিতাভেচ্চিয়ার জাতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের পরিচালক ড. লারা আনিবোলেত্তি বলেছেন, ‘এই লিপিগুলো থেকে আমরা জানি, রোমান নৌবাহিনীর নাবিকরা কীভাবে দূরদূরান্ত থেকে এসে নৌবাহিনীতে যোগ দিত। আমরা আশা করছি, যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই ও ইতালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ইউনিটের সহযোগিতায় এই পাথরটি ফেরত আনা সম্ভব হবে।’

আরও পড়ুন

নিউ অরলিন্সে পাথরটি কীভাবে এল

কীভাবে পাথরটি নিউ অরলিন্সে এল, সেটা ছিল বড় রহস্য। ২১ বছর পর এই রহস্যের সমাধান মিলেছে। নিউ অরলিন্সের পিজারভেশন রিসোর্স সেন্টার জানিয়েছে, এক নারী তাদেরকে জানিয়েছেন, তিনিই পাথরটি ওই উঠানে রেখেছিলেন! তাঁর দাদু ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালিতে অবস্থান করা এক মার্কিন সৈনিক। যুদ্ধশেষে তিনি এই পাথরটি কোনোভাবে নিজের কাছে রাখেন। পরে পরিবারের কাছে প্রদর্শনীর বস্তু হিসেবে এটি সংরক্ষিত ছিল বহু বছর। পরবর্তীতে পাথরটি এসে পড়ে নিউ অরলিন্সের ওই বাড়িতে। সেখানেই বছরের পর বছর ঘাসের নিচে ঢাকা পড়ে থাকে।

অধ্যাপক লুজনিয়া বলেছেন, ‘রোমানদের কাছে সমাধিলিপির মানে ছিল স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা। তাদের বিশ্বাস ছিল, যতদিন কেউ তোমার নাম স্মরণ করবে, ততদিন তুমি বেঁচে থাকবে।’ দুই হাজার বছর পর এক দূরদেশের মাটিতে সেই সৈনিকের নাম আবারও উচ্চারিত হলো। এর মানে, এই সৈনিকের নাম পৃথিবী থেকে এখনও মুছে যায়নি।

সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস

আরও পড়ুন