প্লাস্টিকের বোতলে পানি খেলে কী ক্ষতি
পথে চলতে-ফিরতে অনেকেই সঙ্গে পানি নিয়ে বের হয় না। তখন পিপাসা মেটাতে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। আমরা ভাবি, এই পানি একদম বিশুদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে বোতলজাত পানি যতটা বিশুদ্ধ ভাবা হয়, ততটা বিশুদ্ধ নয়।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এই পানিতে রয়েছে ন্যানো ও মাইক্রোপ্লাস্টিক। ন্যানোপ্লাস্টিক এত ক্ষুদ্র, এর আকার মানুষের চুলের গড় প্রস্থের এক হাজার ভাগের এক ভাগ। এই ধরনের প্লাস্টিক কণা আমাদের পাচনতন্ত্র বা ফুসফুসের টিস্যুর মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে রক্তপ্রবাহে মিশে যাচ্ছে। ফলে ক্ষতিকর সিন্থেটিক রাসায়নিক সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, যা কোষে কোষে পৌঁছে নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। এ কারণে বিজ্ঞানীরা বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন।
এক লিটার বোতলজাত পানিতে গড়ে ২ লাখ ৪০ হাজার প্লাস্টিক কণা পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই ন্যানোপ্লাস্টিক এবং বাকি ১০ শতাংশ মাইক্রোপ্লাস্টিক। মাইক্রোপ্লাস্টিক হলো এমন ক্ষুদ্র পলিমার কণা, যেগুলোর আকার ৫ মিলিমিটার থেকে ১ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর চেয়ে আরও ছোট কণাগুলোকে বলা হয় ন্যানোপ্লাস্টিক, যেগুলোর আকার এক মিটারের এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগের মতো।
২০১৮ সালে করা একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা যায়, নয়টি দেশের ১১টি ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানির ৯৩ শতাংশ নমুনায় মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। গবেষকরা দেখেছেন, প্রতি লিটার পানিতে গড়ে ১০টি মাইক্রোকণা ও ৩০০টি ন্যানোকণা রয়েছে।
প্লাস্টিক বোতলের পানিতে এই কণাগুলোর উৎস কেবল বোতলের মূল উপাদান পলিথিন টেরেফথালেট নয়। বোতলের মুখ বারবার খোলা ও বন্ধ করার সময়, কিংবা তাপ ও চাপে বোতলের গা থেকে ক্ষুদ্র কণা ছিটকে পানিতে মিশে যেতে পারে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স জার্নালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি নতুন গবেষণা প্রকাশিত হয়। এতে তারা এমন একটি প্রযুক্তির কথা জানান, যার মাধ্যমে বোতলজাত পানির ন্যানোপার্টিকেলের রাসায়নিক গঠন শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়েছে।
এই গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া তিনটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের পানির প্রতি লিটারে ন্যানোপ্লাস্টিক কণার সংখ্যা ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ৩ লাখ ৭০ হাজার পর্যন্ত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ন্যানোপ্লাস্টিক হলো মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। কারণ, এই ক্ষুদ্র কণাগুলো শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কোষ ও টিস্যুতে ঢুকে যেতে পারে। এই কণায় থাকা রাসায়নিক উপাদান লিভার, কিডনি এবং মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারে, এমনকি গর্ভস্থ শিশুর কাছেও পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভবতী ইঁদুর যদি প্লাস্টিক কণা খায় বা শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে, তাহলে মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই কণা গর্ভস্থ সন্তানের মস্তিষ্ক, ফুসফুস, লিভার, কিডনি ও হৃদপিণ্ডে পৌঁছে যায়। শুধু ইঁদুর নয়, মানুষের শরীরেও ইতিমধ্যেই মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে—ফুসফুসের টিস্যু, রক্ত এবং মলে।
বিজ্ঞানীরা যে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, তা সাত ধরনের প্লাস্টিক শনাক্ত করতে সক্ষম—পলিমাইড, পলিপ্রোপিলিন, পলিথিন, পলিমিথাইল মেথাক্রাইলেট, পলিভিনাইল ক্লোরাইড, পলিস্টাইরিন এবং পলিথিন টেরেফথালেট।
প্লাস্টিক বোতলের পানিতে এই কণাগুলোর উৎস কেবল বোতলের মূল উপাদান পলিথিন টেরেফথালেট নয়। বোতলের মুখ বারবার খোলা ও বন্ধ করার সময়, কিংবা তাপ ও চাপে বোতলের গা থেকে ক্ষুদ্র কণা ছিটকে পানিতে মিশে যেতে পারে। কখনও পানির উৎস থেকেই এই কণাগুলো বোতলে চলে আসতে পারে।
তাই প্লাস্টিক যে শরীরের ক্ষতি করছে, এ ব্যাপারে গবেষকেরা নিশ্চিত। তাই নিজের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এখনই প্লাস্টিক ব্যবহার কমাতে হবে।
সূত্র: সিএনএন