তারা মাঠে পাড়ে ডিম

প্রতীকী ছবিপ্রতীকী ছবি : এআই আর্ট

দুরন্ত কৈশোর ছিল আমার, মাঠ–ঘাট দাপিয়ে বেড়ানো, সীমান্তরেখা ইছামতী পেরিয়ে ভিনদেশে ঢুকে পড়া, পাখির বাসা-ডিম-ছানার প্রতি তীব্র আকর্ষণ, বর্ষা ধোয়া বিকেলে দলবল আর কুকুরের পাল নিয়ে শিয়াল-বেজিদের পিছু ধাওয়া, ছিপ-বড়শি দিয়ে জলা মাঠে মাছ ধরা—শৈশবের এই নস্টালজিয়া আজও তাড়া করে ফেরে, মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে হাতছানি দেয় হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিরা। তাই ছুটি পেলে মাঝেমধ্যেই ক্যামেরা হাতে ঘুরে বেড়াই ভাঁট-আসশেওড়ার বনে, কিংবা শালুক ফোটা জলাঙ্গীতে। সেই ঘোরা বৃথা যায় না, ছেলেবেলা রাঙিয়ে দেওয়া বুনো গুল্মলতার মায়াবী সুবাস নাসারন্ধ্রে কম্পন তোলে, বাহারি বুনোফুলে চোখ জুড়ায়। ভাগ্য ভালো হলে পেয়ে যাই ছেলেবেলার পরম প্রার্থিত শিয়াল, বনবিড়াল, গুইসাপ, কিংবা ভয়ংকর কালকেউটের দেখা।

সময়টা ২০১৪। অনেক দিন পল্লিবর্ষার টইটম্বুর রূপ দেখিনি। সেবার ঈদের ছুটি সেই সুযোগ করে দেয়। পশ্চিম মাঠে গিয়েছিলাম। ছোট ভাইয়ের কাছে খবর ছিল, সেখানে নাকি শাপলা-শালুকের বড্ড বাড়বাড়ন্ত। পশ্চিম মাঠে বর্ষাকালে পানি জমে। সেখানকার শাপলা-শালুকের ডেরা দেখে আসছি সেই শৈশব থেকে। সত্যি সত্যিই মাঠে গিয়ে প্রাণটা ভরে গেল। অজস্র শাপলা আর অল্প কিছু শালুক ফুটে আছে জলের বুকে। পোশাক ভেজার তোয়াক্কা না করেই নেমে পড়লাম মাঠের সেই হাঁটুসমান পানিতে। ভুল একটা হয়েছে। তেল মেখে আসিনি। এসব পানি বড্ড বিষাক্ত। গায়ে-পায়ে যেখানেই খোলা চামড়া পায়—কামড় বসায়। বড্ড চুলকায় বিষাক্ত পানির সেই কামড়। কী আর করা!

চরাচরজুড়ে রাজত্ব করছে শাপলা-শালুকের দঙ্গল। একটা শালুকের মধু খেতে এসে জুটেছে একটা খুদে জাতের মৌমাছি। ক্যামেরা হাতে থাকলে এই দৃশ্য ধরে রাখার লোভ কি সামলানো যায়! লাল রঙের এক জাতের ফড়িং উড়ছিল ফুলে ফুলে। ক্যামেরাবন্দী করলাম বেশ কিছুর। কিন্তু ছবি একটাও মনের মতো হলো না। পেলাম হুবহু নয়নতারা ফুলের মতো দেখতে এক জাতের জলজ ফুল। ছোটবেলায় প্রচুর দেখেছি এ জিনিস। বাড়ি এনে লাগাতামও। কিন্তু আমার বাগানে এর ফুল ফোটাতে পারিনি কোনো দিন। এই উদ্ভিদটার নাম মালঞ্চলতা।

চার লাইনের ছোট্ট ছড়া, তাতে ক্লু তো মোটে দুটো—খাড়া শিং আর মাঠে ডিম পাড়া। এই ক্লু ধরেই কেউ একদিন আবিষ্কার করে ফেলে, এই হাট্টিমা টিম টিমেরা আসলে মেঠো শামুক বা শম্বুক।

অতি পরিচিত এক জাতের শেওলার দেখা মিলল। নদীতে গোসল করতে গেলে কালো পানির আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই শেওলা গায়ে–মাথায় জড়িয়ে যেত। এক বন্ধু পরে বলেছিলেন, এটা শেওলার কোনো জাত নয়। এর নাম ঝাঁজি।

সবচেয়ে আমোদ পেলাম ব্যাঙের পেছনে ছুটে। খুব করে চাইছিলাম কোনো এক ব্যাঙ ব্যাটাকে শাপলার পাতার ওপর তুলে শট নিতে। তাড়িয়ে তুলছিলামও, কিন্তু শুটের সময়টুকু দিচ্ছিল না ব্যাটারা। তবে কথায় বলে, একবার না পারিলে দেখো শতবার! শেষমেশ সফল হলাম। শাপলার পাতায় শামুক বসা দেখতেও মন্দ লাগে না।

কয়েকটা জলজ গাছ দেখলাম, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। একধরনের বুনো ঘাস, তার মাথায় গোছা গোছা ফুল ফুটে ছিল। ক্যামেরায় আরও একবার ক্লিক ক্লিক শব্দ হলো।

তবে পানি থেকে ওঠার সময় পেলাম মহামূল্যবান এক জিনিসের দেখা। আইলের গায়ে গোপন এক জায়গায় চুপটি করে বসে আছে শামুকের ডিম। দুর্লভ হয়তো নয়। কিন্তু বহুদিন এ জিনিস আমি দেখিনি। তাই ক্যামেরা হাতে থাকা অবস্থায় এমন কিছু পেয়ে যাওয়া সৌভাগ্যের বিষয় বৈকি। অর্থাৎ ক্লিক ক্লিক।

শামুকের ডিম নিয়ে কী বলব! অনেক কিছু বলা যায়, লেখাও যায়। এই শামুকের খাড়া দুটো শিং। তারা মাঠে পাড়ে ডিম। তাদের নাম হাট্টিমা টিম টিম। কিন্তু রোকনুজ্জামান খানের ছেলে–ভোলানো ছড়ার সেই আজব প্রাণীটা যে কী, তা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল যেমন তাঁর জীবদ্দশাতেও, তেমনি এই অনলাইনের যুগে এসেও সেই ধোঁয়া পরিষ্কার হয়নি। চার লাইনের ছোট্ট ছড়া, তাতে ক্লু তো মোটে দুটো—খাড়া শিং আর মাঠে ডিম পাড়া। এই ক্লু ধরেই কেউ একদিন আবিষ্কার করে ফেলে, এই হাট্টিমা টিম টিমেরা আসলে মেঠো শামুক বা শম্বুক। ধীরগতিতে চলার জন্য এদের খ্যাতি বা দুর্নাম জগৎজোড়া। কিন্তু এরাই কেন হাট্টিমা টিম টিম হলো?

ছবি : সিএবিআই

কারণ, এদের মাথায় দুটো খাড়া শিং বা অ্যান্টেনা আছে। আবার ডিমও পাড়ে মাটিতে। গাঁয়ের মাঠে শিংওয়ালা ডিম পাড়া প্রাণী আর পাবে না। তাই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিতে সমস্যা নেই ছড়ারসিক আর প্রকৃতিপ্রেমীদের।

একালের বাঙালিরা প্রকৃতি সম্বন্ধীয় যা কিছু নিয়েই লিখতে যান না কেন, দেখবেন, এর আগেও বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডব অর্থাৎ রবি ঠাকুর, সুকুমার রায়, শরৎচন্দ্র নইলে জীননানন্দ লিখে গেছেন। এই যে ডিমের ছবিগুলো আমি তুলেছি। ছোটবেলায় কিন্তু জানতাম না এগুলো শামুকের ডিম। বড়রা বলতেন ব্যাঙে ডিম পেড়ে রেখেছে। কিন্তু পরে সুকুমার রায়ের ‘শামুক-ঝিনুক’ নামে একটা লেখা পড়ে নিশ্চিত হই এগুলো শামুকের ডিম। শামুকের ডিম নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘যে ডিম ফুটিয়া ছানা বাহির হয়, সেই ডিমগুলি দেখিতে বড়ই অদ্ভুত। কতগুলি ছোট ছোট পোঁটলা একসঙ্গে মালার মতো বাঁধা থাকে। প্রত্যেকটি পোঁটলার মধ্যে কতগুলি ডিম। এক একটি শামুক অনেকগুলি ডিম পাড়ে—একশ দেড়শ হইতে দশ বিশ হাজার।’

দশ-বিশ হাজার না হোক, এক শ দেড় শ ডিমের একটা সমাবেশ তো পেলাম!

সেদিন ছেলেবেলায় দেখা সেই দুর্লভ বস্তু এত দিন পর দেখতে পেয়ে যতটা না খুশি হয়েছিলাম, তার চেয়ে সুখী হয়েছিলাম এর ছবি তুলতে পেরে। কম দামি ক্যামেরায় তোলা এ ছবি সাদামাটা হলেও আমার কাছে মহামূল্যবান এক গুপ্তধন যেন।

আরও পড়ুন