ডিএসএলআরের ১২ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরায় কেন স্মার্টফোনের ২০০ মেগাপিক্সেলের চেয়ে ভালো ছবি ওঠে

ডিএসএলআর ক্যামেরায় ছবি ভালো হবে, তবে এখনকার স্মার্টফোনগুলোতেও ভালো ছবি তোলা যায়

ধরো, তুমি একটি নতুন স্মার্টফোন কিনতে গেলে। বিক্রেতা তোমাকে মুঠোফোন দেখালেন। প্যাকেটের গায়ে ও পাশেই একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে জ্বলজ্বলে লেখা, ‘বিশ্বের প্রথম ২০০ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা!’ এই লেখা দেখে তোমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ২০০ মেগাপিক্সেল! ভাবা যায়?

তোমার মনে পড়ল, পরিচিত এক বড় ভাইয়ের কাছে একটা ডিএসএলআর (DSLR) ক্যামেরা আছে। দেখতে বেশ পেশাদার, কিন্তু সেটার ক্যামেরা মাত্র ১২ মেগাপিক্সেল। তাহলে কি এই মুঠোফোনে ওটার চেয়েও ভালো ছবি উঠবে?

বিক্রেতাকে এই প্রশ্নই করলে। জবাব শুনে তোমার মনে খটকা লাগল। কারণ, বিক্রেতা বললেন, ‘না, মুঠোফোনে ডিএসএলআরের মতো ভালো ছবি উঠবে না। তা ছাড়া ওটার দামও তো অনেক বেশি।’

তোমার মাথায় এখন দুটো প্রশ্ন। ২০০ মেগাপিক্সেলের এই দানবের তুলনায় ১২ মেগাপিক্সেলের ওই ডিএসএলআর ক্যামেরা কেন এত দামি? আর এই বিক্রেতা কিংবা পেশাদার ফটোগ্রাফাররাই-বা কেন বলেন যে মুঠোফোনের চেয়ে ডিএসএলআরে অনেক ভালো ছবি ওঠে? মেগাপিক্সেলের এই বিভ্রান্তিকর গোলকধাঁধা থেকে বেরোতেই আজকের এই লেখা। চলো, এ রহস্যের সমাধান করে আসি।

আরও পড়ুন

এ জন্য প্রথমেই সমাধান করতে হবে মেগাপিক্সেল রহস্যের। আমাদের একটা খুব সাধারণ ধারণা হলো, যত বেশি মেগাপিক্সেল, ছবির মান তত ভালো। এই ধারণা আসলে স্মার্টফোন কোম্পানিগুলোর সফল মার্কেটিংয়ের অংশ। বলা বাহুল্য, ধারণাটি পুরোপুরি সত্যি নয়। তাহলে মেগাপিক্সেল জিনিসটা আসলে কী?

বিষয়টা সহজ করে বোঝা যাক। একটা ছবি অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোকবিন্দু বা ডট দিয়ে তৈরি। এই প্রতিটি ডটই একেকটি পিক্সেল (Pixel)। ১০ লাখ পিক্সেল মিলে হয় এক মেগাপিক্সেল। সুতরাং ১২ মেগাপিক্সেল মানে হলো, ছবিটি ১ কোটি ২০ লাখ পিক্সেল দিয়ে তৈরি, আর ২০০ মেগাপিক্সেল মানে ছবিটি ২০ কোটি পিক্সেল দিয়ে তৈরি।

তা, এই মেগাপিক্সেলের কাজ কী? মেগাপিক্সেলের মূল কাজ হলো ছবির রেজল্যুশন বা ডিটেলস ধারণ করা। যত বেশি মেগাপিক্সেল, ছবিকে তুমি তত বেশি জুম করতে পারবে বা দেয়ালে পোস্টারের মতো বড় আকারে প্রিন্ট করতে পারবে, ছবিটি ফাটবে না। অর্থাৎ মেগাপিক্সেল ছবির আকারের সঙ্গে সম্পর্কিত, সরাসরি মানের সঙ্গে নয়। ছবির মান নির্ভর করে অন্য একটি জিনিসের ওপর। এই জিনিস থাকে পর্দার আড়ালে; এবং স্মার্টফোন কোম্পানিগুলো ভুলেও এই জিনিস নিয়ে কথা বলে না।

জিনিসটার নাম, সেন্সর। ছবির মানের আসল কারিগর এই সেন্সর, মানে ক্যামেরার সেন্সর। এটাকে ভাবতে পারো ক্যামেরার হৃৎপিণ্ড। এটাই মূলত আলো গ্রহণ করে, সেই তথ্যগুলোকে ছবিতে রূপান্তরিত করে। এখানেই ডিএসএলআর আর স্মার্টফোনের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য তৈরি হয়ে যায়। বিষয়টা একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক।

আরও পড়ুন

ধরো, তুমি বৃষ্টির জল সংগ্রহ করবে। তোমার কাছে দুটি অপশন বা বিকল্প উপায় আছে। অপশন এক (ডিএসএলআর), একটি বিশাল উঠানে রাখা ১২টি বড় বড় বালতি। আর অপশন দুই, একটা ছোট্ট বারান্দায় গাদাগাদি করে রাখা ২০০টি ছোট আকারের (শিশি বা বোতলের ছিপির মতো) পাত্র। এবার ঝিরঝির করে বৃষ্টি (স্বল্প আলো) নামল। কোন পাত্রগুলো বেশি পানি (আলো) সংগ্রহ করতে পারবে? অবশ্যই বড় বালতিগুলো, তাই না? এখানে ক্যামেরার সেন্সর সেই উঠান বা বারান্দার মতো, আর পিক্সেলগুলো হলো পানি সংগ্রহের পাত্র।

ডিএসএলআর ক্যামেরার সেন্সরগুলো বিশাল আকারের হয়। যেমন ‘ফুল-ফ্রেম’ বা এপিএস-সি সেন্সর (আলোচনা বুঝতে এই টেকনিক্যাল নামগুলো অবশ্য দরকার নেই)। তাই এর ১২ মেগাপিক্সেলের প্রতিটি পিক্সেল বা ‘বালতি’ আকারে অনেক বড় হয়। ফলে এটি স্বল্প বা ম্লান আলোতেও অনেক বেশি আলো সংগ্রহ করতে পারে। সেই তুলনায় স্মার্টফোনের সেন্সর আকারে অনেক ছোট (আঙুলের নখের চেয়েও ছোট)। এই ক্ষুদ্র জায়গায় ২০ কোটি পিক্সেলকে জায়গা দিতে হয়। ফলে প্রতিটি পিক্সেল (বা ছিপি) এত ক্ষুদ্র হয় যে এগুলো খুব সামান্য আলো ধরতে পারে। এটুকু বুঝলে তুমি মূল বিষয়টা বুঝে ফেলেছ। কারণ, যত বেশি আলো, ছবির মান তত ঝকঝকে ও নিখুঁত হয়। কম আলোয় ছবি তুললে যে ঝিরঝিরে বা অস্পষ্ট ভাব দেখা যায়, টেকনিক্যাল ভাষায় যাকে বলে ‘নয়েজ’, তার মূল কারণ হলো পিক্সেলগুলো যথেষ্ট আলো সংগ্রহ করতে পারেনি। ডিএসএলআরের বড় পিক্সেলগুলো যেহেতু অনেক বেশি আলো ধরে, তাই এর ছবি হয় অনেক পরিষ্কার, ঝকঝকে। এতে রঙের গভীরতাও থাকে অনেক বেশি।

আরও পড়ুন

তাহলে বিজ্ঞাপনে যে এত বড় করে ২০০ মেগাপিক্সেল লেখা হয়, এর কাজটা কী? স্মার্টফোন কোম্পানিগুলো কেন এত বেশি বেশি মেগাপিক্সেলের পেছনে ছুটছে? এর পেছনে একটি আধুনিক প্রযুক্তি কাজ করে, যার নাম পিক্সেল বিনিং (Pixel Binning)।

ছবির মান নির্ভর করে মূলত সেন্সরের আকারের ওপর
ছবি: রয়টার্স

স্মার্টফোনের প্রতিটি পিক্সেল যেহেতু আকারে খুব ছোট, তাই সফটওয়্যারের মাধ্যমে এতে একটু কারিকুরি করতে হয়। এ জন্য একটা সহজ কৌশল ব্যবহার করা হয়। স্মার্টফোনের ক্যামেরা পাশাপাশি থাকা ৪, ৯ বা ১৬টি ক্ষুদ্র পিক্সেলকে একত্র করে একটি বড় ‘সুপার পিক্সেল’ হিসেবে ব্যবহার করে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা ভালোভাবে বোঝা যাবে।

একটা ২০০ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা যখন ১৬-ইন-১ পিক্সেল বিনিং ব্যবহার করে, তখন এটি ২০০-কে ১৬ দিয়ে ভাগ করে ১২.৫ মেগাপিক্সেলের একটি ছবি তৈরি করে। ছবিটি হবে ২০০ ÷ ১৬ = ১২.৫ মেগাপিক্সেল। এই সুপার পিক্সেলটি তখন একটি বড় পিক্সেলের মতো আচরণ করে এবং বেশি আলো সংগ্রহ করতে পারে, ফলে কম আলোতেও তুলনামূলক ভালো ছবি আসে।

আরও পড়ুন

এটি একটি অত্যন্ত কার্যকর প্রযুক্তি ঠিকই, কিন্তু এই সমাধান সফটওয়্যারের মাধ্যমে করা হয়। এটি কখনোই ডিএসএলআরের স্বাভাবিক, বড় সেন্সর ও বড় পিক্সেলের বাস্তব সুবিধার সমান হতে পারে না। তবে সফটওয়্যার তথা কোডিং জিনিসটা একদম ফেলনা যে নয়, এটুকু স্পষ্ট বোঝা যায় গুগলের পিক্সেল ফোনে তোলা ছবি দেখলে। শুধু কোডিং করে এই পদ্ধতিতে ছবির মান অনেক উন্নত করা যায়। এই একটি জায়গায় স্মার্টফোন ডিএসএলআরকে প্রায়ই হারিয়ে দেয়। এটাকে টেকনিক্যাল ভাষায় বলতে পারো ‘ইমেজ প্রসেসিং’ বা ‘কম্পিউটেশনাল ফটোগ্রাফি’। স্মার্টফোনের শক্তিশালী প্রসেসর, উন্নত কোডিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত সফটওয়্যার ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গেই সেটাকে বিশ্লেষণ করে ছবির রং, আলো, শার্পনেস সবকিছু বেশ আকর্ষণীয় করে তোলে। ডিএসএলআর সেটা করতে পারে না। মূলত ‘র’ বা প্রাকৃতিক ছবি তোলে, এতে কৃত্রিমতার কিছু থাকে না। এই ছবিকে পড়ে এডিট করে নিতে হয়।

কিন্তু আরও একটা দিকে এগিয়ে থাকে ডিএসএলআর। সেটা হলো, লেন্স। ডিএসএলআরের লেন্সগুলো আকারে বড় এবং উচ্চমানের কাচ দিয়ে তৈরি। এই লেন্স সেন্সরে অনেক বেশি ও বিশুদ্ধ আলো পাঠাতে পারে। একে তুলনা করা যায় বড়, পরিষ্কার জানালার সঙ্গে। অন্যদিকে, স্মার্টফোনের লেন্সকে ভাবতে পারো দরজার ছোট পিপ-হোলের মতো।

তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? বিষয়টা হলো, মেগাপিক্সেল ছবির আকারের মাপকাঠি, মানের নয়। ছবির মান নির্ভর করে মূলত সেন্সরের আকারের ওপর। যত বড় সেন্সর, তত ভালো ছবির মান। তবে ইমেজ প্রসেসিং করে স্মার্টফোনগুলো এই সমস্যা খানিকটা কাটাতে পারে। সেই সঙ্গে তোমাকে উপহার দিতে পারে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছবি। ডিএসএলআর এটা করতে পারে না।

এখন কেউ যদি তোমাকে মেগাপিক্সেলের সংখ্যা বলে চমকে দিতে চায়, তুমি তাকে বলে দিতে পারবে, ভেতরের সত্যিটা তুমি জানো।

সূত্র: ডিপিরিভিউ, ওয়্যারড, সিনেট

আরও পড়ুন