রকিব হাসানকে মিস করব
বেশ কয়েক বছর আগে এক ব্যস্ত বিকেলে অবসর প্রকাশনীর প্রকাশক আলমগীর ভাই ফোন করলেন। বললেন, 'আপনার সঙ্গে রকিব হাসান দেখা করতে চান! আমরা কি আপনারা কাছে আসব নাকি আপনি এদিক আসবেন?'
আমি তখন একটা পত্রিকায় কার্টুনিস্ট হিসেবে কাজ করি। নিউজরুমের ভীষণ ব্যাস্ততায় সকল উত্তেজনা চেপে রেখে বললাম, 'আজ পারব না। কাল সকালে আপনার অফিসে আসতে পারি।'
পরদিন একটা লম্বা জ্যাম ঠেলে গেলাম বাংলাবাজার। আলমগীর ভাইয়ের অফিসে বসতে বসতে খানিক দেরি হয়ে গেল। বললাম, 'যাক উনি এখনও আসেননি তাহলে।' আলমগীর ভাই কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই বললেন, 'উনিই রকিব হাসান।' আমি চমকে উঠে ডান পাশে তাকালাম, লম্বা সাদা দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক, বইয়ের ফ্ল্যাপে ক্লিন শেভড লেখকের সঙ্গে কোনে মিল নেই!
আমি তাড়াতাড়ি সরি-টরি বললাম। তারপর সেই যে একটা আড্ডা শুরু হলো… লাঞ-টাঞ্চসহ প্রায় ৪ ঘন্টা! একবারের জন্যও মনে হয়নি দুজন বৃদ্ধের সঙ্গে আমি গল্প করছি! যার যার কাজ নিয়ে দুই তরুণই(!) সমান উত্তেজিত!
আড্ডা শেষে আমি অফিসে যাব। আলমগীর ভাই আমার অফিসের উদ্দেশ্যে একটা গাড়ি দিলেন। কিংবদন্তি রকিব হাসান বোধহয় ইস্কাটনের দিকে কোথাও নামবেন। আমার সঙ্গে তিনিও রওনা হলেন, জ্যাম খেতে খেতে আরো দেড় ঘন্টা গল্প।
এরপর থেকে তিন জনের কাজ তো শুরু হলোই, সঙ্গে শুরু হলো ফোনে আড্ডা! কাজে-অকাজে ফোন দিয়ে রীতিমত আড্ডা দিতেন রকিব হাসান। ৪০ মিনিটের আগে কখনো তিনি ফোন রেখেছেন বলে আমার মনে পড়ছে না। ফলে মাঝেমধ্যে আমি ওনার ফোন কেটে দিতাম, আর মনে মনে ভাবতাম আমি কি হনুরে! পরে হাতে সময় নিয়ে ফোন রিচার্জ করে কলব্যাক করতাম। একেকটা বই নিয়ে কী গভীরভাবে ভাবতেন তিনি! আর কি শিশুতোষ উত্তেজনা নিয়ে আমাকে বলতেন গল্পগুলো! লেখালেখির প্রতি ওনার এই একাগ্রতা শেখার মতো।
বাজারে প্রচলিত আছে তিনি ভীষণ অহংকারী! কাউকে সাক্ষাৎকার দেন না, অটোগ্রাফ দেন না, কারো সঙ্গে ছবি তোলেন না! আমার তো হিসেব মেলে না!
একসময় হুট করে তিনি অসুস্থ হয়ে গেলেন। ফোনালাপও বন্ধ হয়ে গেল।গত বছরের শুরুতেই আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, ঢাকায় এলে দুজন মিলে রকিব ভাইয়ের বাসায় দেখা করতে যাব। এরপর হুট করে আলমগীর ভাই-ই চলে গেলেন না ফেরার দেশে! আমার আর যাওয়া হলো না রকিব ভাইয়ের কাছে।
আজ চলে গেলেন রকিব হাসান!
কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দুজনই আমাকে ভীষণ পছন্দ করতেন। আলমগীর ভাই প্রতি ৬-৭ মাস পর পর পর আমাকে বস্তা ভরে টি-শার্ট কুরিয়ার করতেন। যেকারণে গত ১৩-১৪ বছর আমি কোনো টিশার্ট কিনতেই পারিনি! মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগেও ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এক বস্তা গিফট পাঠিয়েছিলেন। ঢাকা ছাড়ার পর এরকম আর কেউ মনে রাখেনি!
একটু এলোমেলো ব্যক্তিগত লেখা হয়ে গেল! আমি তো শিল্পী, লেখক নই। লেখক হিসেবে অন্যরাই লিখুক। কিন্তু দুই বুড়ো তরুণকেই আমি মিস করি, করব…