এক
শারিতা ও জাফর আবদুল্লাহকে দেখে কিন্তু মোটেও বিজ্ঞানী মনে হয় না। মনে হয় হানিমুনে বেরোনো এক জোড়া হাসিখুশি তরুণ-তরুণী।
দুজনই সুদর্শন। বয়স ত্রিশের কোঠায়। জাফরের লম্বা চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমেছে। স্বামীর চেয়ে অনেক ছোট শারিতার চুল, পুরুষালি কায়দায় ছোট ছোট করে ছাঁটা। চুল ছোটই হোক কিংবা বড়, দেখে মনে হয় আঁচড়ানোর সময় করে উঠতে পারে না কেউই। লাইব্রেরিতে বইয়ে মুখ গুঁজে থাকার চেয়ে বাইরে প্র্যাকটিক্যাল ওয়ার্কই বেশি পছন্দ তাদের।
২০৮১ সালের জুন মাস। পার্বত্য চট্টগ্রাম আর মিয়ানমার বর্ডারের কাছে বাংলাদেশের সীমানায় কাজ করছে দুজনে। জায়গাটার নাম হিমপাহাড়।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভূতত্ত্ববিদ। একটা বিশেষ বৈজ্ঞানিক মিশন নিয়ে এসেছে।
দুর্গম পার্বত্য এলাকায় একটা ভূমিধসের কারণ অনুসন্ধান করতে এসেছে ওরা। এলাকাটার বদনাম হয়ে গেছে। ইদানীং প্রায়ই ধস নামে এখানে। আর এর জন্যই নাকি ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এই ধসের ওপর থিসিস লিখে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট নেওয়ার ইচ্ছা দুজনের।
পাহাড়ের উপত্যকা থেকে শুরু করে ক্রমে ওপরের দিকে উঠে গেছে বড় বড় গাছের জঙ্গল। দূর থেকে দেখতে চমৎকার লাগে। বসতিশূন্য বনের ভেতর থেকে ভেসে আসে বুনো ফুলের মাতাল করা সুবাস। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে নিচে তাকালে দেখা যায় চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য। বঙ্গোপসাগরের উপকূলও চোখে পড়ে। নিচে ছোট ছোট কয়েকটা গ্রাম। বাড়িঘরগুলো থাকলেও লোকজন বিশেষ থাকে না এখন আর এখানে। ভয়ে পালিয়েছে। দুটো কারণে। এক, গরিলার মতো অদ্ভুত এক দানবকে নাকি ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় বনের মধ্যে। মানুষ দেখলে হামলা চালায়। আর দ্বিতীয় কারণটা হলো ভূমিকম্প। প্রায়ই কেঁপে ওঠে ধরণি। পাহাড়ের উপত্যকায় আদিবাসীদের ও রকম একটা প্রায় নির্জন গ্রামের প্রান্তেই তাঁবু খাটিয়েছে জাফররা।
আদিবাসীদের পায়ে হাঁটা পথ ধরে কয়েক শ গজ নিচের একটু খোলামতো জায়গায় এসে দাঁড়াল শারিতা আর জাফর। অঞ্চলটা ঢালু। ঘাসে ছাওয়া। এক পাশ দিয়ে সরু পাহাড়ি নদী বয়ে যাচ্ছে। কান পাতলে শোনা যায় স্রোতের মিষ্টি কুলকুল ধ্বনি। পাহাড়ি ঘুঘুর বিলাপের মতো ডাক। আরও নানা রকম পাখি আছে এখানে। নানা রকম বুনো জানোয়ারও আছে।
চলতে চলতে থমকে দাঁড়াল জাফর। আশপাশের ঢিলাটক্কর এবং নিচের জমির দিকে তাকিয়ে মনে মনে কী অনুমান করে নিল। তারপর কাঁধে ঝোলানো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ঠাসা ভারী ব্যাগটা নামিয়ে রাখল পায়ের কাছে। শ্বাস নিল লম্বা করে।
‘এক্কেবারে আদিম জঙ্গল।’ বলল সে।
কাঁধের অপেক্ষাকৃত হালকা বোঝাটা নামিয়ে রাখছে শারিতা।
‘হুঁ!’
‘আমার ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীতে এসে পড়েছি।’
‘ঠিকই বলেছ। আশপাশের ঝোপঝাড় আর গাছপালা দেখে এমনই লাগছে। বেশি নির্জন। কাছেপিঠে লোকবসতির চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না।’
‘এতে একটা ব্যাপারে কিন্তু সুবিধে হয়েছে।’ পেছন থেকে স্ত্রীর কাঁধে হাত রাখল জাফর।
‘কী?’ দূরের পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে আছে শারিতা।
দুই কাঁধ ধরে নিজের দিকে ফেরাল ওকে জাফর। ‘কেউ ডিস্টার্ব করবে না আমাদের।’
‘এটা কোনো নতুন কথা না। পাহাড়ের উত্তর ধার ঘেঁষে বসালাম বাইশটা সেন্সর, দক্ষিণে আঠারোটা। কোনোটা বসানোর সময়েই তো ডিস্টার্ব করল না কেউ। খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই লোকের।’ একঘেয়ে কাজ করতে করতে বিরক্ত হয়ে উঠেছে শারিতা।
‘ফালতু কথা বাদ দাও এখন!’ ধমক লাগাল শারিতা। ‘বহু কাজ পড়ে আছে। ১৯ নম্বর সেন্সরটা বসাবে না?’
বসে ব্যাগ খুলতে শুরু করল শারিতা।
ওপরের খোপ থেকে চকচকে স্টিলের সিলিন্ডারের মতো একটা জিনিস বের করে আনল সে। লম্বায় ১০ ইঞ্চি, ৫ ইঞ্চি বেড়।
জাফরও ব্যাগ খুলতে শুরু করল।
ব্যাগ থেকে একটা বেস-লোডেড ভিএইচএফ টেলিমেট্রি অ্যানটেনা বের করে সিলিন্ডারের ওপর লাগাল শারিতা। নিচে লাগাল ৩ ফুট লম্বা একটা স্টেনলেস স্টিলের তৈরি প্রোব।
‘এতগুলো সেন্সর বসালাম, কিন্তু এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছে না আমার,’ যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল শারিতা।
একটা হ্যান্ডড্রিলের সাহায্যে মাটিতে ছিদ্র করতে করতে জিজ্ঞেস করল জাফর, ‘কী বিশ্বাস হচ্ছে না?’
‘এগুলো ভূমিকম্পের পূর্বসংকেত জানাবে কি না।’
‘জানাবে, জানাবে।’
‘না জানালে কষ্টটাই মাঠে মারা যাবে,’ প্রোবটা ঠিকমতো লাগল কি না, পরীক্ষা করে দেখছে শারিতা।
ছিদ্র করা শেষ হলো জাফরের। মাটির গভীর থেকে ড্রিলের ফলাটা তুলে আনল। ফলায় মাটির কণা লেগে আছে। মাটিতে আস্তে করে টোকা দিয়ে ড্রিলের গা থেকে কণা পরিষ্কার করতে করতে বলল, ‘এসো, প্রোবটা ঢোকাও গর্তে। দেখো, আরও গভীর করা লাগবে কি না।’
এগিয়ে এসে প্রোবটা ছিদ্রে ঢুকিয়ে দিল শারিতা। ঠিকই হয়েছে। নরম মাটির ওপর খাড়া হয়ে রইল সিলিন্ডার আকৃতির সেন্সর রেডিওটা। তিরতির করে মৃদু কাঁপছে ওপরের অ্যানটেনা।
‘বেসে কল দিয়ে দেখো তো এবার,’ নির্দেশ দিল জাফর।
হিমপাহাড়ের উত্তর দিকের প্রান্ত ঘেঁষে একটা বড় গ্রাম কিরিঞ্চা। বেসের জন্য নির্ধারিত স্থান। গ্রামের প্রান্তে কয়েকটা তাঁবু ফেলা হয়েছে। গাড়িও আছে গোটা তিনেক। তিনটা গাড়ির একটা ওয়্যারলেস ভ্যান, টেলিমেট্রি ভ্যানও বলা হয় এটাকে। ভ্যানের ছাদ ছাড়িয়ে কয়েক ফুট উঠে গেছে রেডিও অ্যানটেনা। প্রায় একই রকম দেখতে আরেকটা গাড়িতে জেনারেটর বসানো হয়েছে। ক্যাম্পে আলো এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় এখান থেকে। তৃতীয় গাড়িটা একটা আধটনি আর্মি পিকআপ। গ্রামে যাওয়ার ধূলি–ধূসরিত পথটার ধারে দাঁড়িয়ে যেন ঝিমাচ্ছে কিম্ভূতদর্শন গাড়িটা।
রেডিও ভ্যান থেকে বেরিয়ে আসা কতগুলো তার নিয়ে আসা হয়েছে গজ দশেক দূরের একটা ফর্মিকার তৈরি টেবিল পর্যন্ত। যোগ করা হয়েছে টেবিলে রাখা একটা রেডিও ট্রানসিভার, একটা ভ্রাম্যমাণ টেলিফোন এবং একটা রেকর্ডিং সিসমোগ্রাফের সঙ্গে। আশপাশে বসানো সিলিন্ডার-রেডিওগুলোর পাঠানো সংকেত একটা সরু কাগজের ফিতার ওপর ধরে রাখার কাজ করে এই শেষোক্ত যন্ত্রটা।
টেবিলের সামনে রাখা একটা মেটাল ফোল্ডিং চেয়ারে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে একজন অতি সুদর্শন লোক। বয়স ত্রিশ। নাম ইউসুফ পাশা।
হাত দুটি পেছনে বাঁকিয়ে, আঙুলগুলো খাঁজে খাঁজে আটকে, দুই তালুর ওপর আরাম করে মাথা রেখেছে সে। দৃষ্টি পাঁচ গজ দূরের একটা গাছের ডালে। ছোট্ট নাম না–জানা নীল পাখিটার নাচানাচি দেখছে তন্ময় হয়ে। জেনারেটরের একটানা গুনগুন সংগত করছে যেন তার সঙ্গে। পেছনের জঙ্গল একেবারে নিস্তব্ধ। প্রকৃতির এই খোলামেলা পরিবেশ দারুণ ভালো লাগছে তার।
বসতিশূন্য খোলামেলা বুনো কিংবা পার্বত্য এলাকা খুবই পছন্দ ইউসুফের। হিমপাহাড়ে বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রী দলের সঙ্গে আসার প্রস্তাবটা তাই লুফে নিয়েছে সে। মাত্র কিছুদিন আগে এই অঞ্চলে বৈজ্ঞানিক অভিযানে এসে রহস্যজনকভাবে অচেনা শত্রুর হাতে আক্রান্ত হয়েছে দুটি দল। কাজেই এবারের দলটার সঙ্গে দেওয়া হয়েছে ইউসুফকে। শত্রুর ওপর নজর রাখার দায়িত্ব তার। এ রকমই একটা কাজ চাইছিল সে মনে মনে। অ্যাডভেঞ্চার ভালো লাগে তার।
টেবিলে রাখা সিসমোগ্রাফটার দিকে নজর রাখতে বলা হয়েছে ইউসুফকে। কিন্তু সেদিকে তার খেয়ালই নেই। একমনে লক্ষ্য করছে গাছের ডালের অপূর্ব সুন্দর নীল পাখিটাকে।
হঠাৎই যেন পাখিটার মনে হলো, যথেষ্ট দর্শন দেওয়া হয়েছে নিচের আধশোয়া মানুষটাকে। কোনো রকম জানান না দিয়েই ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল ওটা। অনেক দূরের একটা গাছে গিয়ে বসল। পরমুহূর্তে জীবন্ত হয়ে উঠল টেবিলে রাখা রেডিও। পরিষ্কার শারিতার কণ্ঠ।
‘হ্যালো,’ শারিতা বলল। ‘শুনতে পাচ্ছ, ইউসুফ?’
নিরুৎসুকভাবে সোজা হয়ে বসল ইউসুফ। আড়মোড়া ভাঙল। তারপর হাত বাড়িয়ে তুলে নিল মাইক্রোফোন। ‘শুনতে পাচ্ছি, শারিতা। কেমন আছ?’
‘ভালো।’
‘তা খবর কী? কোত্থেকে বলছ?’
‘পজিশন নাইনটিন। লাস্ট সেন্সরটা এইমাত্র বসালাম।’
‘কোনো গোলমাল?’
‘না। তোমার ওখানে?’
‘ভালো। টেলিমেট্রি ঠিকমতো চলছে। ৫ নম্বর সেন্সরটার সঙ্গে টেলিমেট্রির যোগাযোগ মিনিট পাঁচেকের জন্য বন্ধ হয়ে গেছিল অবশ্য একটু আগে। কিছু না, শর্টসার্কিট। কী করে যেন এক টুকরা তার খসে পড়েছিল সার্কিট বোর্ডের ওপর। তেমন কিছু না।’
‘ওই পাঁচ মিনিটে তাহলে সেন্সর ফাইভ থেকে কোনো সংকেত রেকর্ড করতে পারেনি কম্পিউটার?’
‘না।’
‘খারাপ কথা। যাকগে, যা হওয়ার হয়েছে,’ একটু থামল শারিতা। ‘হ্যাঁ, শোনো, আমাদের কাজ শেষ।’
‘ভেরি গুড। জলদি ফিরে এসো। ডেটা কালেকশন আর ভালো লাগছে না আমার। নদীতে মাছ ধরতে যেতে চাই এবার আমি।’
‘কাজ শেষ বলেছি। ফিরে আসার কথা তো কিছু বলিনি।’
ঠোঁট বাঁকাল ইউসুফ।
‘কিন্তু দুদিন হয়েছে গিয়েছ তোমরা। কাজও শেষ বললে। ফিরে আসতে বাধা কোথায়?’
হেসে উঠল শারিতা।
‘কোথায় ক্যাম্পে ফিরে শান্তিতে রাত কাটাবে, তা না, বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ। কেমনতরো লোক তোমরা?’
‘এখানে, জঙ্গলই ভালো লাগে আমাদের।’
‘ভুলে যেয়ো না, আমার সামনের রেডিওটা সাংঘাতিক সেনসিটিভ। তোমরা কোথায় আছ, জানা আছে আমার। কাজেই ডিস্টার্ব করতে অসুবিধা হবে না। হাহ্ হাহ্ হাহ্...!’
‘এখানকার রিসিভার অফ করে রাখব।’
‘তাহলে আর প্রয়োজনীয় ভূকম্পনের সংকেত ধরতে পারবে না।’
‘তার মানে, আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না?’
‘পাগলকে বলে সাঁকো নাড়াসনে...।’ একটা ধাতব শব্দে থেমে গেল ইউসুফ। টেলিমেট্রি ভ্যানটার দিকে চোখ তুলে তাকাল। ভ্যানের ছাদের এক প্রান্তে বসানো বিশাল অ্যানটেনা। সেন্সরগুলোর সিলিন্ডার থেকে আসা সংবাদ রিসিভ করে রেডিওতে পাঠানোর কাজ করে। ১৪০ ডিগ্রি কোণ করে বেঁকে গেছে। পড়েই যাবে হয়তো।
‘এক মিনিট,’ শারিতাকে বলল ইউসুফ, ‘অ্যানটেনাটা আবার বেঁকে গেছে। কিছুতেই কারণটা বুঝতে পারছি না। ধরে থাকো, ওটা ঠিক করে রেখে আসি।’
‘একটু আগে না বললে তেমন কোনো সমস্যাই নেই ওখানে!’ শারিতার প্রশ্ন।
‘অন্য কোনো সমস্যা নেই, তবে অ্যানটেনার গন্ডগোলটা গতকাল থেকে শুরু হয়েছে। একটু ধরো, আমি আসছি।’
‘পরে কথা বলব। ছেড়ে দিচ্ছি এখন।’
নীরব হয়ে গেল রেডিও। মাইক্রোফোনটা টেবিলে নামিয়ে রাখল ইউসুফ। চেয়ারটা ঠেলে পেছনে সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। টেলিমেট্রি ভ্যানের দিকে এগোল।
ভ্যানের পেছনে পৌঁছে চারদিকে একবার দ্রুত তাকিয়ে নিল ইউসুফ। কেউ আছে কি না, দেখে নিল। যা করতে যাচ্ছে, সেটা দেখিয়ে অকারণে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে চায় না। শরীরের ওপরের অংশ সোজা রেখে হাঁটুটা কয়েক ইঞ্চি ভাঁজ করল সে। আচমকা স্প্রিংয়ের মতো লাফ দিল। হালকা পালকের মতো উঠে গেল শূন্যে। তারপর পালকের মতোই বাতাসে ভাসতে ভাসতে নেমে এল ভ্যানের ছাদে, মাটি থেকে ১০ ফুট ওপরে। ইউসুফ পাশা সম্পর্কে যারা কিছু জানে না, ব্যাপারটা স্বপ্নের মতোই মনে হবে তাদের কাছে।
অ্যানটেনাটা ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখল। তার মনে হলো, ঠিকমতো বসানো হয়নি ওটা। কোনো আনাড়ি কারিগরের কাজ হতে পারে। খুব কাঁচা হাতে লুব্রিকেট করা হয়েছে। বিয়ারিংয়ের ঠিক ওপরে অ্যানটেনার দণ্ডটা প্রচণ্ড শক্তিশালী বায়োনিক হাত দিয়ে মুঠো করে ধরল। সাধারণ মানুষ দুই হাতে চেপে ধরেও একচুল নড়াতে পারত না ভারী অ্যানটেনাটা। কিন্তু ইউসুফের কথা আলাদা। সে আর দশজনের মতো সাধারণ মানুষ নয়।
তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দ তুলে আস্তে আস্তে সোজা হতে শুরু করল অ্যানটেনা। আবার আগের জায়গায় এসে গেল দণ্ডটা। উঠে দাঁড়াল ইউসুফ। চোখের সামনে মেলে ধরল তার বায়োনিক আঙুলগুলো। ইচ্ছা করলে এই আঙুলের এক মোচড়ে কঠিন ইস্পাতের দণ্ডটা ভেঙে দিতে পারে এখন। দুই আঙুলে টিপে ধরে চ্যাপ্টা পর্যন্ত করে দিতে পারে।
‘কম্পিউটার না বানিয়ে আসলে আমার মতো আরও কিছু বায়োনিকম্যান বানানো উচিত বিজ্ঞানীদের,’ ভাবল ইউসুফ।
দুই
বিজ্ঞানের এক আশ্চর্য সৃষ্টি ইউসুফ পাশা। পৃথিবীর প্রথম সফল সাইবর্গ। আধা মানুষ, আধা যন্ত্র। মানুষের স্বাভাবিক স্বভাব-চরিত্র, আবেগ, চিন্তাধারা সবই আছে তার। এর পাশাপাশি আছে অপরিসীম যান্ত্রিক শক্তি। দৈহিক শক্তিতে তার সমকক্ষ তো দূরের কথা, কাছাকাছিও আসতে পারে, এমন মানুষ পৃথিবীতে একজনও নেই। যেকোনো রেসের ঘোড়াকে দৌড়ে হারিয়ে দিতে পারে সে, সাঁতারে তার তুলনায় ডলফিন কিছুই না।
জীবন্ত যান্ত্রিক মানুষে পরিণত হওয়ার আগেও ধনী পিতার একমাত্র সন্তান, অল্প বয়সে মা–বাবা হারানো ইউসুফ পাশা কিন্তু আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো ছিল না। বুদ্ধি ছিল তার অতি প্রখর। খুব অল্প বয়সে বিমান চালনা শিখেছে। কলেজে যেকোনো খেলাধুলা, বিশেষ করে ফুটবলের জাদুকর বলা হতো তাকে। অ্যারোডাইনামিক, অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইতিহাস, তিনটি বিষয়েই মাস্টার ডিগ্রি নিয়েছে। লেখাপড়া করার সময়েই কুস্তি শিখেছে, ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছে কারাতে ও জুডোতে। দক্ষ পাইলট হয়েছে। বেপরোয়া, একরোখা, দুঃসাহসী। আকাশে ওড়াটা তার নেশা। সুযোগ পেলেই প্লেন নিয়ে উড়াল দেয় আকাশে। সাধারণ প্লেন নিয়েও উঠে যায় বিপৎসীমার অনেক অনেক ওপরে। তার মতো দুঃসাহস এর আগে আর কোনো পাইলট দেখাতে পারেনি। আর প্লেন চালাতে গিয়েই করে বসল একদিন অ্যাকসিডেন্ট। সোজা নাক গুঁজে মাটিতে পড়ল বিমান। চুরমার হয়ে গেল। ভাগ্য ভালো, আগুন ধরল না।
দ্রুত ছুটে এল অ্যাম্বুলেন্স আর ফায়ার ব্রিগেডের ভ্যান। গাড়িগুলোর দরজা খুলে টপাটপ নেমে এল কর্মীরা। প্রথমেই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে টেনে বের করল ইউসুফকে।
দুটি পায়েরই ঊরু থেকে নিচের অংশ গুঁড়ো হয়ে গেছে তার। বাঁ হাতটাও শেষ। চোখা কোনো কিছুতে খোঁচা লেগে বাঁ চোখটা গলে বেরিয়ে গেছে। চাপ লেগে ভেঙে গেছে পাঁজরের বেশ কিছু হাড়। ধাতুর চোখা একটা পাত ঢুকে গেছে বুকের ভেতরে, একেবারে হৃৎপিণ্ড ঘেঁষে, একটা হার্ট ভালভ কেটে দিয়েছে। নিচের চোয়াল গুঁড়ো হয়ে গেছে। দুই পাটির অধিকাংশ দাঁত নেই। কয়েকটা মারাত্মক ফাটল খুলিতে। তালগোল পাকিয়ে পড়ে আছে রক্তাক্ত দেহটা।
কিন্তু বিস্ময়করভাবে বেঁচে গেছে সে। সোজা তাকে নিয়ে যাওয়া হলো বায়োনিক রিসার্চ সেন্টারে। জয়দেবপুরে প্রচুর টাকা খরচ করে প্রতিষ্ঠিত একটা টপ সিক্রেট সরকারি গবেষণাগার এটা।
দ্রুত ইউসুফকে পরীক্ষা করলেন বায়োনিক রিসার্চ সেন্টারের নেতৃস্থানীয় ডাক্তার-বিজ্ঞানীরা। অদ্ভুত এক চিন্তা স্থান নিল তাদের অতি উন্নত মগজে। এত দিন যা ভাবছিলেন, এই বিশেষ লোকটাকে দিয়েই সেটা কার্যে পরিণত করে দেখার চেষ্টা করে দেখলে কেমন হয়? তার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। সরকার কি দেবে অত টাকা? তবু তারা সাহস করে চেয়ে বসলেন। টাকার অঙ্কের কথা শুনে চমকে উঠলেন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ড. আসজাদুল কিবরিয়া। একজন লোকের পেছনে অত টাকা ব্যয় করবেন? তবে অনেক ভেবেচিন্তে উচ্চপদস্থ অফিসারদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে শেষ পর্যন্ত টাকা দেওয়াই স্থির হলো।
ইউসুফ পাশাই হবে পৃথিবীর প্রথম সাইবর্গ—মানুষ আর যন্ত্রের সংমিশ্রণ। পৃথিবীর প্রথম বায়োনিকম্যান। মানবিক ক্ষমতা আর যন্ত্রের সহাবস্থানে সৃষ্টি হবে এক অতি আশ্চর্য জীব। কাজ করবে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের হয়ে।
বিসিআইয়ের স্পেশাল অপারেশন বিভাগের প্রধান আশফাক খান। বায়োনিক রিসার্চ স্টেশনটা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পক্ষে যে কজন ভোট দিয়েছেন, তিনিও তাদের একজন। প্রতিষ্ঠানটা গড়ে ওঠার পর থেকেই একটা বিশেষ আশা মনে মনে পোষণ করে আসছেন তিনি। অভূতপূর্ব ক্ষমতাশালী এবং শক্তিধর একজন বায়োনিকম্যান যদি তৈরি করা যেত। দুর্দান্ত সিক্রেট এজেন্ট বানানো যেত তাহলে তাকে।
আশফাক খানের মনের আশা পূরণ করার জন্যই যেন ইউসুফকে সাইবর্গ বানানোয় মন দিলেন রিসার্চ সেন্টারের বিজ্ঞানীরা। খবরটা চাপা থাকল না আশফাক খানের কাছে। লাফিয়ে উঠলেন তিনি। ছুটলেন রিসার্চ সেন্টারে। জ্যান্ত সাইবর্গ কী রকম হলে ভালো হয়, একটা ধারণাও দিলেন বিজ্ঞানীদের।
বায়োনিক রিসার্চ সেন্টারের প্রধান ড. কিবরিয়া নামকরা বিজ্ঞানী। গভীর সহানুভূতি আর কৌতূহল নিয়ে কাজে মন দিলেন তিনি। ইলেকট্রোপিপ পদ্ধতিতে ঘুম পাড়ানো হলো ইউসুফকে। একের পর এক অজস্র অপারেশন চলল তার দেহে।
প্রথমেই ইউসুফের নষ্ট হয়ে যাওয়া হার্ট ভালভটা বদলে কৃত্রিম হুফনাজেল ভালভ লাগানো হলো। ভাঙাচোরা খুলি খুলে ফেলে দেওয়া হলো। তার জায়গা দখল করল সিজিয়ামের তৈরি কৃত্রিম খুলি। ভেতরে–বাইরে দুই দিকেই স্পঞ্জজাতীয় পদার্থের আস্তরণ, ব্রেন এবং চামড়া নষ্ট হওয়ার ভয় রইল না এতে। ধরতে গেলে একটা সার্বক্ষণিক হেলমেটই বসানো হয়ে গেল ইউসুফের মাথায়। ভয়ানক আঘাতেও সহজে আর ব্রেনে চোট লাগবে না।
বুকের ভাঙাচোরা পাঁজরগুলো কেটে বের করে নিয়ে আসা হলো। তার জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হলো ধাতব অ্যালয়-ভিটালিয়ালের তৈরি পাঁজর। সিলিকন রাবারের তৈরি কৃত্রিম পেশি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো বক্ষপাঁজর। তার আগেই কৃত্রিম পাঁজরের সঙ্গে সূক্ষ্ম তারের অ্যানটেনা আর অন্যান্য রেডিওসামগ্রী আটকে দেওয়া হয়েছে। অ্যানটেনার তারটা একটা রিব বেয়ে গিয়ে মেরুদণ্ড ধরে নেমে গেছে একটা বায়োনিক পা পর্যন্ত।
সিজিয়ামের সাহায্যেই তৈরি হয়েছে কৃত্রিম চোয়াল, আসল চোয়ালের চেয়ে অন্তত দশ গুণ বেশি টেকসই। কঠিন নাইলনের তৈরি দাঁত বসানো হলো এই চোয়ালে। নষ্ট হয়ে যাওয়া বাঁ চোখের অবশিষ্ট বের করে নিয়ে অক্ষিকোটরে বসিয়ে দেওয়া হলো অতি খুদে, কিন্তু অসাধারণ শক্তিশালী মিনিয়েচার ক্যামেরা লাগানো চক্ষুগোলক। পুরোপুরি অন্ধকারেও এই চোখের সাহায্যে দেখতে পাবে ইউসুফ। চাইলেই চোয়ালে বসানো একটা খুদে বোতাম টিপে এই ক্যামেরার সাহায্যে যেকোনো সময় যেকোনো লাইটিংয়ে যেকোনো জিনিসের ছবি তুলতে পারবে সে। চোখের ভেতরের ক্যামেরাতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রসেসিং হয়ে যাবে ছবি। ইচ্ছা করলে বের করে নিয়ে আসা যাবে ফিল্ম—এই ফিল্মও বিশেষ পদার্থে তৈরি, কখনোই শেষ হবে না। ক্যামেরার ভেতরে আপনা–আপনি তৈরি হতে থাকবে। একটা ফিল্ম বের করে আনার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়ে জায়গামতো বসে যাবে আরেকটা ফিল্ম। অদ্ভুত সৃষ্টি এই বাঁ চোখটা। অতগুলো সূক্ষ্ম জটিল যন্ত্রপাতির সমাবেশ, অথচ বাইরে থেকে দেখে আসল ডান চোখটা থেকে এটাকে আলাদা করে চেনা যাবে না। কেউ ধারণাই করতে পারবে না, এটা একটা বায়োনিক চোখ। শুধু ছবি তোলা আর দেখাই নয়, অণুবীক্ষণেরও কাজ করবে এই চোখ। যেকোনো জিনিসকে বহুগুণ বড় করে দেখতে পারবে ইউসুফ ইচ্ছা করলেই। কোনো সুইচ টেপাটেপির দরকার নেই। ইউসুফের কৃত্রিম খুলির ভেতর দিকে বসানো আছে কম্পিউটার, ব্রেনের সঙ্গে যোগ আছে এর। অর্থাৎ ইউসুফের ইচ্ছার সঙ্গেও যোগ আছে। সুতরাং সে চাইলেই বিশেষ বিশেষ কাজ করে দেবে কম্পিউটার, তার হয়ে।
ইউসুফের বায়োনিক হাত-পাগুলোও কম বিস্ময়কর নয়। ভেতরের হাড় বিশেষ ধরনের ধাতব অ্যালয় দিয়ে তৈরি, যেগুলো সহজে ভাঙা যাবে না। রাসায়নিক পদার্থে তৈরি কৃত্রিম পেশি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে এই হাড়। অদ্ভুত মিনি জেনারেটর বসানো হয়েছে হাড়ের ভেতরে। সারাক্ষণই বিদ্যুৎ তৈরি করতে থাকবে জেনারেটর। ছড়িয়ে দেবে কৃত্রিম পেশিতে। অসাধারণ ক্ষমতা আর শক্তি এসে যাবে পেশিগুলোতে। ইউসুফ চাইলেই কম্পিউটার আদেশ দেবে পেশিগুলোকে রেডিওর সাহায্যে। একটা নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে যেকোনো গতিবেগে দৌড়াতে পারবে ইউসুফ বায়োনিক পায়ের সহায়তায়। কৃত্রিম বাহুটায় এসে যাবে বায়োনিক শক্তি। আসল হাতের মতোই এই বায়োনিক হাতে ডিমের মতো ভঙ্গুর জিনিসকেও তুলে নিতে পারবে, আবার ইচ্ছা করলে ইস্পাতের ফাঁপা বলকেও চিপে চ্যাপ্টা করে দিতে পারবে।
এমনই সব আরও আজব আজব জিনিস আর যন্ত্রপাতি ভরে ভরে অদ্ভুত এক রোবটে পরিণত করা হলো ইউসুফ পাশাকে। শত্রুর জন্য এক ভয়াবহ ধ্বংসমেশিন। অত সব কাজ শেষ করতে পুরো একটি বছর লেগে গেল। এই একটি বছর হাসপাতালের বিছানায় আর অপারেশন টেবিলে কাটাতে হলো ইউসুফকে এবং এই সময়ে প্রায় রোজই এসে ইউসুফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গেছেন আশফাক খান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাহচর্য দিয়েছেন।
এত দিনে ইউসুফের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেছেন স্পেশাল অপারেশন চিফ আশফাক খান।