পুরো বই পড়ার দিন কি ফুরিয়ে আসছে
একসময় স্কুল মানে ছিল বইয়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ সময় কাটানো। অনেক বিখ্যাত লোকের আত্মজীবনীতে পাওয়া যায়, ক্লাসে বসে তাঁরা গল্পের বই পড়েছেন। এমনকি ক্লাসের মধ্যে বই দিয়ে ঢেকে বড় উপন্যাস পড়ে শেষ করে ফেলেছেন।
একসময় আমাদের দেশে ‘তিন গোয়েন্দা’ পড়ার খুব চল ছিল। শিশু-কিশোরেরা ‘তিন গোয়েন্দা’ পড়ত। শুধু পড়ত না, কিশোর মুসা রবিনের চরিত্রে ঢুকে পড়ত। গল্পের ভেতরে ঢুকে পড়া যাকে বলে। রহস্যের সমাধান কী হয়, বইয়ের শেষে কী ঘটে—জানার জন্য অপেক্ষা করত পাঠকেরা। পুরো বই পড়ে ফেলত। এ অভ্যাস বদলে যাচ্ছে। বই পড়ার হার কমছে। এখন ক্লাসে লুকিয়ে বই পড়ার বদলে ফোন ব্যবহারের ঘটনা ঘটছে।
নবম-দশম শ্রেণিতে বাংলা বইয়ের সঙ্গে আমাদের কারিকুলামে উপন্যাস থাকে। দেখা যাচ্ছে, এই উপন্যাসের পুরোটা তেমন কেউ পড়ছে না। যতটুকু দরকার পরীক্ষার জন্য, সেটুকু পড়ার দিকে মনোযোগ বাড়ছে। এ তথ্য একদম সঠিক করে বলা সম্ভব নয়। যেহেতু কোনো নির্ভরযোগ্য গবেষণা পাওয়া যায়নি। তবে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে এমন প্রবণতা জানা গেছে।
এ বিষয়ে গবেষণা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এই দেশের হাইস্কুলে ইংরেজি ভাষার ক্লাসে একটা উপন্যাস পুরোটা পড়তে হয়। উপন্যাসটা এখন আর কেউ পুরোটা পড়ছে না। পড়ার অভ্যাস ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
টেক্সাসের হিউস্টনের কাছাকাছি এলাকার দশম শ্রেণির ইংরেজি শিক্ষক লরা হেনরি বলছেন, ‘পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমরা একটা বই পড়াই, “দ্য গ্রেট গ্যাটসবি”। অনেক শিক্ষার্থী জীবনে এই প্রথমবার ক্লাসে পুরো একটি উপন্যাস পড়ে।’ এখনকার বহু শিক্ষার্থী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি বই পড়ে না।
মেরিল্যান্ডের রকভিলের রেবেকা জ্যাকবস বলেছেন, তাঁর নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে ‘আ রেইজিন ইন দ্য সান’ নাটকটি পড়েনি, শুনেছে অডিও আকারে। আর ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’-এর ক্ষেত্রে পুরো নাটক নয়, শুধু ব্যালকনি দৃশ্যটাই দেখেছে ভিডিওতে। বইয়ের জায়গা দখল করছে স্ক্রিন, বইয়ের পৃষ্ঠার বদলে আসছে রিলস।
নিউ মেক্সিকোর লস আলামোসের ১৬ বছর বয়সী শিক্ষার্থী লিভ নিকলাসন বলেছে, ‘আমরা একটা বই পড়তেই এত সময় নিয়ে ফেলি যে নবম শ্রেণিতে পুরো বছরে একটাই বই পড়েছিলাম, “ম্যাকবেথ”।’ আসলে এসব স্কুলের ক্লাসে বই পড়ানো হচ্ছে খুব ধীরে। খুব অল্প পরিমাণে।
নিউইয়র্ক টাইমসের শিক্ষাবিষয়ক প্রতিবেদক ডানা গোল্ডস্টিন লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হাইস্কুলে হয়তো বইয়ের যুগ শেষের পথে। গবেষণা আর টাইমসের এক অনানুষ্ঠানিক জরিপে অংশ নেওয়া দুই হাজারের বেশি শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতায় উঠে এসেছে, অনেক কিশোর-কিশোরীকে বছরে এক বা দুটির বেশি পূর্ণাঙ্গ বই পড়তে দেওয়া হয় না।
এ পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে পড়ার দক্ষতায়ও। দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের রিডিং স্কোর এখন ইতিহাসে সর্বনিম্ন পর্যায়ে আছে। এমনকি নামী কলেজগুলোর অধ্যাপকেরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ ও জটিল লেখা পড়াতে আগের চেয়ে অনেক বেশি বেগ পেতে হচ্ছে।
টিকটক আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে এটা হওয়ার কথা ছিল কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। অনেক শিক্ষাবিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ভবিষ্যতে গল্প আর জ্ঞান মূলত অডিও আর ভিডিওর মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়বে। মোবাইল আর স্ট্রিমিং মিডিয়ার দুনিয়ায় পড়ার সময় দেওয়ার ধৈর্য কমে যাবে।
এ বাস্তবতা বোঝার জন্য নিউইয়র্ক টাইমস শিক্ষকদের, অভিভাবকদের আর শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চেয়েছিল, স্কুলে বই পড়ার অভিজ্ঞতা এখন কেমন। দুই হাজারের বেশি মানুষ উত্তর দিয়েছেন। বহু অভিজ্ঞ শিক্ষক জানিয়েছেন, ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে যত বই পড়াতেন, এখন তার চেয়ে অনেক কম পড়ান। কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের মনোযোগ কমে যাওয়ার জন্য প্রযুক্তিকে দায়ী করেছেন। তবে অনেকেই আঙুল তুলেছেন স্কুলের পাঠ্যক্রমের দিকে।
এ পাঠ্যক্রমগুলোতে পুরো বই নয়, পড়ানো হয় ছোটগল্প, সংবাদ প্রতিবেদন বা উপন্যাসের অংশবিশেষ। সঙ্গে থাকে ছোট প্রশ্ন, সংক্ষিপ্ত উত্তর আর ছোট প্রবন্ধ। সবকিছুই অনলাইনে। স্কুল থেকে দেওয়া ল্যাপটপে থাকে। এ অভ্যাস শুরু হয় প্রাথমিক স্কুলে। তাই হাইস্কুলে এসে পুরো বই পড়া শিক্ষার্থীদের কাছে পাহাড়সম বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এ ধরনের পাঠ্যক্রম মূলত তৈরি হয়েছে পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য। স্কুলে তো সবাই চাপে থাকে, পরীক্ষায় ভালো ফল করতে হবে। সহপাঠ হিসেবে দেওয়া উপন্যাস। তখন আর আগ্রহ নিয়ে পড়া হয় না। পরীক্ষায় কীভাবে ভালো করা যাবে, সেদিকে থাকে মনোযোগ। ফলে পরীক্ষার প্রস্তুতি আর নির্ধারিত সিলেবাস শেষ করতেই সময় ফুরিয়ে যায়। পুরো বই পড়ার আর সুযোগ থাকে না।
এখন প্রশ্ন হলো আমরা কি শুধু পরীক্ষার জন্য পড়ছি, নাকি সত্যিকারের পাঠক তৈরি করাও জরুরি? এ উত্তর পেতে হলে আরও অপেক্ষা করতে হবে।