ডাইনোসর বিলুপ্ত করা গ্রহাণুটির কী হয়েছিল
আজ থেকে প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ বছর আগের কথা। পৃথিবীতে তখন দাপিয়ে বেড়াত বিশাল বিশাল ডাইনোসর। কিন্তু একদিন আকাশ থেকে নেমে আসে এক ভয়ংকর গ্রহাণু। এটি ছিল প্রায় ১২ কিলোমিটার চওড়া। অর্থাৎ মাউন্ট এভারেস্টের সমান। গ্রহাণুটি ঘণ্টায় প্রায় ৪৩ হাজার কিলোমিটার বেগে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে। সেই ভয়ংকর সংঘর্ষের পর ডাইনোসর তো বিলুপ্ত হয়ে গেল, কিন্তু ওই বিশাল গ্রহাণুর কী হলো? ওটা কি এখনো কোথাও পড়ে আছে?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পারমাণবিক বোমার চেয়ে প্রায় ৮০০ কোটি গুণ বেশি শক্তি নিয়ে যখন গ্রহাণুটি পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে, তখন সেটি প্রচণ্ড উত্তাপে গলে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে বাষ্প হয়ে যায়! হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। পুরো গ্রহাণুটিই গলে গিয়ে একধরনের সূক্ষ্ম ধূলিকণায় পরিণত হয়েছিল।
সেই ধুলাবালু বায়ুমণ্ডলের অনেক ওপরে উঠে যায়। এরপর বৃষ্টি বা বরফের মতো ধীরে ধীরে পুরো পৃথিবীতে ঝরে পড়ে। এই ধুলার মধ্যে ইরিডিয়াম নামক একধরনের দুর্লভ ধাতু ছিল। এই ধাতু পৃথিবীতে খুব কম পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রহাণুতে এটি প্রচুর পরিমাণে থাকে। কোটি কোটি বছর পর সেই ধুলার স্তরই পাথরের পাতলা স্তরে পরিণত হয়েছে। এই স্তর এখন পৃথিবীর সবখানে পাওয়া যায়। এটিই ডাইনোসরদের মেরে ফেলা সেই গ্রহাণুর সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
তাহলে গ্রহাণুটির কোনো টুকরা কি আর অবশিষ্ট নেই? বিজ্ঞানীরা বলছেন, হাওয়াই দ্বীপের কাছে সমুদ্রের নিচ থেকে তোলা মাটির নমুনায় তিলের দানার মতো ছোট্ট একটা টুকরা পাওয়া গেছে। সম্ভবত টুকরাটি ওই গ্রহাণুরই অংশ। এর চেয়ে বড় কোনো টুকরা খুঁজে পাওয়াটা হবে অনেকটা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো।
তবে গ্রহাণুটি অদৃশ্য হয়ে গেলেও পৃথিবীতে একটা বিশাল ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে। মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপে একটি বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছিল। এর নাম চিকশুলুব ক্রেটার। এটি প্রায় ১৮০ কিলোমিটার চওড়া এবং ২০ কিলোমিটার গভীর! কোটি কোটি বছরে এটি মাটি ও পাথরের নিচে চাপা পড়ে গেছে। এর বড় একটি অংশ এখনো মেক্সিকো উপসাগরের নিচে রয়েছে।
শুধু গর্তই নয়, সেই সংঘর্ষের ফলে প্রায় এক মাইল উঁচু সুনামি তৈরি হয়েছিল! তার বিশাল ঢেউ ঘণ্টায় প্রায় ১৪৩ কিলোমিটার বেগে পুরো মহাসাগরে ছড়িয়ে পড়ে। এর ধাক্কায় সমুদ্রের তলদেশে পাঁচতলা ভবনের সমান উঁচু ঢেউয়ের চিহ্ন বা ‘মেগারিপল’ তৈরি হয়েছিল। তা আজও লুইজিয়ানার মাটির নিচে সংরক্ষিত আছে।
গ্রহাণুর আঘাতে শুধু আশপাশের প্রাণীই মারা যায়নি বা সুনামিতে ভেসে যায়নি। এরপর শুরু হয়েছিল আসল বিপর্যয়। আকাশ থেকে ঝরেছিল অ্যাসিড বৃষ্টি। পুরো পৃথিবীতে লেগে গিয়েছিল ভয়ংকর আগুন। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল সেই ধুলার মেঘ।
এই মেঘ পৃথিবীকে এমনভাবে ঢেকে ফেলেছিল যে সূর্যের আলো আর পৌঁছাতে পারছিল না এখানে। গাছপালা সব মরে গেল, খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ল। আর পৃথিবীটা একটা বরফশীতল গ্রহে পরিণত হলো। এই শীতেই ডাইনোসরসহ পৃথিবীর প্রায় ৭৫ শতাংশ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
কানাডার বিজ্ঞানী অ্যালান হিল্ডব্র্যান্ড বলেন, এই শক্তি দশ হাজার পারমাণবিক যুদ্ধের সমান। মেক্সিকোর সেই বিস্ফোরণে পাথর আর ধুলা হাজার হাজার মাইল দূরে কানাডার আলবার্টায়ও পৌঁছেছিল। সেখানে এগুলো এক থেকে দুই সেন্টিমিটার পুরু স্তর তৈরি করেছিল! এমন ভয়ংকর আঘাতে যে পৃথিবীর বেশির ভাগ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তাতে আর আশ্চর্য কী!
সূত্র: লাইভ সায়েন্স