বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণিত প্রতিযোগিতা ম্যাথ ক্যাঙারুতে অংশ নেবে বাংলাদেশ

বিশ্বের শতাধিক দেশের প্রায় ৬৫ লাখ শিক্ষার্থী ২০২৫ সালের এই গণিত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। এ কারণে ম্যাথ ক্যাঙারুকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণিত প্রতিযোগিতা। তবে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া যায় নিজের স্কুলে বা নিকটতম কেন্দ্রে। ২০২৬ সাল থেকে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাও এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে। ম্যাথ ক্যাঙারুর আয়োজকদের বার্ষিক সভা থেকে ফিরে শিক্ষার্থীদের এই খুশির খবর দিচ্ছেন মুনির হাসান।

এই অক্টোবরের ১৫–১৯ তারিখে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে জড়ো হয়েছেন শতাধিক দেশের দুই শতাধিক গণিতের অধ্যাপক, শিক্ষক ও গণিতকর্মী। উদ্দেশ্য—বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণিত প্রতিযোগিতা ম্যাথ ক্যাঙারুর আয়োজক সংস্থা Association Kangourou Sans Frontières (AKSF)-এর ৩৩তম বার্ষিক সভা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সেখানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এর আগে আমরা বিশ্বের বৃহত্তম এই গণিত প্রতিযোগিতার সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছি। সেই আবেদন উপস্থাপন করতেই আমার যাওয়া। সভার শুরু ও শেষ হয় ম্যাথ ক্যাঙারুর সাধারণ অধিবেশন দিয়ে। সব সক্রিয় ও সাময়িক সদস্যদেশ সেখানে অংশ নেয়, আর আবেদনকারী দেশগুলো থাকে পর্যবেক্ষক হিসেবে। প্রথম দিনেই জানলাম, বাংলাদেশের সাময়িক সদস্যপদের (provisional membership) বিষয়টি ভোটাভুটিতে উঠবে শেষ দিনের সাধারণ সভায়। নিয়ম অনুযায়ী কোনো দেশ প্রথমে সাময়িক সদস্য হয়; তিন বছর কার্যক্রম পরিচালনার পর পায় পূর্ণ সদস্যপদ।

আরও পড়ুন
ম্যাথ ক্যাঙারু প্রতিযোগিতা

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণিত প্রতিযোগিতা

১৯৯১ সালে ফরাসি গণিতবিদদের উদ্যোগে গঠিত হয় একেএসএফ। তখন আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের জনপ্রিয়তা বেড়েছে, কিন্তু সেটি কেবল প্রাক্‌-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের কয়েকজন মেধাবী শিক্ষার্থীর মধ্যেই সীমিত। একটি দেশ থেকে সর্বোচ্চ ছয়জন শিক্ষার্থী সেখানে অংশ নিতে পারে। একেএসএফের প্রতিষ্ঠাতারা চাইলেন, গণিত শেখার আনন্দ আরও বেশি সংখ্যক শিশুর কাছে পৌঁছে দিতে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, একই দিনে সারা বিশ্বে একই প্রশ্নে পরীক্ষা হবে, কিন্তু প্রতিটি শিক্ষার্থী অংশ নেবে নিজের দেশে এবং নিজের স্কুলে বা নিকটতম কেন্দ্রে। তারও আগে থেকে অস্ট্রেলিয়ায় অলিম্পিয়াড ছাড়াও সবার জন্য একটা গণিত প্রতিযোগিতা হতো। সেটার মতো করেই এই প্রতিযোগিতার কথা ভাবা হয়। সে জন্য এটির নাম হয় ক্যাঙারু ম্যাথ। এ প্রতিযোগিতা শুধু প্রাক্‌-বিশ্ববিদ্যালয় নয়; প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত। শিক্ষার্থীদের ছয়টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়, যেন বয়স ও স্তর অনুযায়ী সবাই সমান সুযোগ পায়। ১ নম্বর ছকে শিক্ষার্থীদের ক্যাটাগরি দেখা যাবে।

ছক-১: ম্যাথ ক্যাঙারুর ক্যাটাগরি ও শ্রেণি বিভাজন

আরও পড়ুন
ম্যাথ ক্যাঙারুতে প্রতিটি ক্যাটাগরিতে ৭৫ মিনিটের একটি বহু নির্বাচনী প্রশ্নে (MCQ) পরীক্ষা হয়

প্রশ্ন কেমন, পরীক্ষা কেমন

ম্যাথ ক্যাঙারুর বৈশিষ্ট্য হলো বয়স ও শ্রেণিভিত্তিক সিলেবাস। তৃতিয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর প্রশ্ন কখনোই পঞ্চম শ্রেণির স্তরের হয় না। এখানে জোর দেওয়া হয় যুক্তি অনুধাবন, পর্যবেক্ষণ ও সৃজনশীলতায়। এটি মুখস্থবিদ্যার পরীক্ষা নয়। সাধারণত কোনো সূত্র বা ফর্মুলা ব্যবহার করে প্রশ্নগুলো সমাধান করা যায় না, চিন্তা করলেই উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিটি ক্যাটাগরিতে ৭৫ মিনিটের একটি বহু নির্বাচনী প্রশ্নে (MCQ) পরীক্ষা হয়। প্রতিটি প্রশ্নের ৫টি সম্ভাব্য উত্তর থাকে—সঠিক উত্তরটি বেছে নিতে হয় যুক্তি দিয়ে বা গাণিতিক পদ্ধতিতে, আন্দাজে নয়। প্রশ্ন থাকে তিন স্তরে—সহজ, মাঝারি ও কঠিন। সহজ প্রশ্নে সঠিক উত্তরে ৩ নম্বর, মাঝারি প্রশ্নের সঠিক উত্তরে ৪ নম্বর ও কঠিন প্রশ্নের সঠিক উত্তরে ৫ নম্বর পাওয়া যায়। তবে ভুল উত্তরে এক নম্বর কাটা হয়। প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত তিন ক্যাটাগরিতে মোট প্রশ্ন থাকে ২৪টি আর সপ্তম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ক্যাটাগরিগুলোতে ৩০টি করে প্রশ্ন থাকে।

আরও পড়ুন

কারা তৈরি করেন প্রশ্ন

প্রতিবছর প্রতিযোগিতা শেষে সব সদস্যদেশ তাদের নিজস্ব প্রশ্ন প্রস্তাব করে। এসব প্রশ্নে সদস্যদেশগুলোর প্রতিনিধিরা মতামত ও রেটিং দেন। এরপর একেএসএফ একটি আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করে সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে। বার্ষিক সভায় অংশ নিয়ে সবাই মিলে সেই প্রশ্ন যাচাই-বাছাই করেন—বয়স উপযোগী কি না, আগে কোথাও ব্যবহৃত হয়েছে কি না, ভাষাগতভাবে স্পষ্ট কি না—এসব দেখে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। ইস্তাম্বুলের এবারের সভাতেও প্রায় ২০০ গণিতবিদ মিলে ২০২৬ সালের প্রশ্নপত্র চূড়ান্ত করেছেন।

ম্যাথ ক্যাঙারু প্রতিযোগিতার পদক

কখন হয় পরীক্ষা

প্রতিবছর মার্চ মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার ম্যাথ ক্যাঙারু ডে পালিত হয়। সেদিন সারা পৃথিবীতে একই প্রশ্নে একই সঙ্গে পরীক্ষা হয়। তবে কোনো দেশ চাইলে বাস্তবিক কারণে কয়েক দিন পরেও আয়োজন করতে পারে। ২০২৬ সালের ম্যাথ ক্যাঙারু ডে হবে ১৯ মার্চ, যা বাংলাদেশে ঈদুল ফিতরের সময়ের কাছাকাছি। তাই আমাদের দেশে প্রথমবারের আয়োজন হবে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে।

আরও পড়ুন

ফলাফল ও পুরস্কার

এখানে পাস–ফেল নেই। প্রত্যেক শিক্ষার্থী নিজের স্কোর জানতে পারে। তাতে শিক্ষার্থী যেমন নিজের শক্তি–দুর্বলতা জানতে পারে, তেমনি তার স্কুলও জানতে পারে কোথায় উন্নতির সুযোগ আছে। প্রতিটি দেশে সেরা ১ শতাংশ শিক্ষার্থীকে পুরস্কৃত করা হয়—তাদের মধ্যে প্রায় এক–ষষ্ঠাংশ স্বর্ণ, এক–তৃতীয়াংশ রৌপ্য এবং বাকিরা ব্রোঞ্জপদক পায়।

প্রশিক্ষণ ও ক্যাম্প

যেহেতু প্রশ্নগুলো সাধারণ সিলেবাসের হলেও পদ্ধতিতে ভিন্ন, তাই অনেক দেশেই অনলাইন ও অফলাইনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। প্রতিবছর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্যাম্পও আয়োজন করা হয়, যেখানে সেরা শিক্ষার্থীরা নতুনভাবে চিন্তা করা শেখে—খেলার মতো আনন্দে।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশও এখন সাময়িক সদস্য

বাংলাদেশে সব শিক্ষার্থীকে আনন্দে গণিত শেখা ও যাচাই করার সুযোগ দেওয়ার জন্য আনন্দে গণিত শেখার কার্যক্রমকে বিস্তৃত করার জন্য ম্যাথ ক্যাঙারুকে বাংলাদেশে নিয়ে আনা। ম্যাথ ক্যাঙারু বাংলাদেশ সেই সুযোগটাই করে দেবে। এখানে শিশুরা নিজের স্কুলেই অংশ নেবে, শিক্ষকেরা হবেন প্রধান সংগঠক আর অভিভাবকেরা দেখতে পাবেন—গণিত ভয় নয়, আনন্দ। ইস্তাম্বুল সভার শেষ দিনে ভোটাভুটির মাধ্যমে বাংলাদেশকে সাময়িক সদস্যপদ (Provisional Membership) প্রদান করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (BdOSN) এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৬ সাল থেকে ম্যাথ ক্যাঙারুর আয়োজন করতে পারবে। আগামী তিন বছর এই কার্যক্রম পরিচালনার পর বাংলাদেশ পূর্ণ সদস্যপদের যোগ্যতা অর্জন করবে।

বাংলাদেশে ম্যাথ ক্যাঙারুবিষয়ক ওয়েবসাইট - http://kangaroomathbd.org/

আরও পড়ুন