আগাথা ক্রিস্টি: কুইন অব মিস্ট্রি
গোয়েন্দা, কিংবা ডিটেকটিভ—শব্দগুলো শুনলেই হয়তো তোমাদের চোখে ভেসে ওঠে একজন লম্বা-চওড়া ঝকঝকে চেহারার টগবগে তরুণ—তিনি যে রকম বুদ্ধিমান, তেমনই সাহসী আর ঠিক তেমনই মারামারি-পটু।
মগজাস্ত্র কিংবা হাতের অস্ত্র—যখন যেখানে যেটা দরকার, সেটি খেলিয়ে কখনো ফেলুদা, কখনো শার্লক হোমস, কখনো ব্যোমকেশ হয়ে গোয়েন্দারা আমাদের নিয়ে যান রহস্যে মোড়া অ্যাডভেঞ্চারের জগতে। তাঁরা বুদ্ধিতে শাণ দিয়ে কঠিন থেকে কঠিনতর রহস্য যেমন সমাধান করে ফেলেন, তেমনি প্রয়োজনে ঢিসুমঢাসুম করে প্রতিপক্ষকে কাতও করে দিতে পারেন।
কিন্তু কখনো কি ভেবেছ, আমাদের দাদি-নানিদের মতো, রূপকথার গল্প শোনানো, ভাঁজ পড়া চামড়ার ফোকলা দাঁতের মিষ্টি একজন বয়স্ক মানুষও তুখোড় গোয়েন্দা হতে পারেন?
একজন ভেবেছিলেন। আগাথা ক্রিস্টি।
ভেবেছিলেন বলেই লিখতে পেরেছিলেন মিস মার্পলকে। মিস মার্পল লাঠি হাতে ঠুকঠুক করে হেঁটে যাওয়া এক মিষ্টি বৃদ্ধা। ষাটের কোঠা পার করেছেন। থাকেন সেন্ট মেরি মিড গ্রামে। শুধু পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা আর ক্ষুরধার বুদ্ধিকে ব্যবহার করে খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবে সমাধান করে ফেলেন জটিল সব রহস্যের। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বড় কর্তারাও শরণ নেন তাঁর।
আগাথা ক্রিস্টির আরও একটি সৃষ্টি বেলজিয়ান ডিটেকটিভ এরকুল পোয়ারো। শার্লক হোমসের পর বিশ্বে সবচেয়ে বিখ্যাত গোয়েন্দা বোধ হয় ইনিই। শতাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে এরকুল পোয়ারো সিরিজের প্রায় সব উপন্যাস।
সাধারণত কোনো লেখককে আমরা তাঁর একটি সৃষ্টি দিয়ে চিনি। যেমন, আর্থার কোনান ডয়েলকে চিনি শার্লক হোমসের জন্য, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে চিনি তাঁর চিরায়ত সৃষ্টি টেনিদার বরাতে। আগাথা ক্রিস্টিই বোধ হয় একমাত্র লেখক, যাঁর একাধিক চরিত্রের সব কটিই বিশ্বব্যাপী অসামান্য জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ক্রিস্টির বই এখন পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে প্রায় দুই বিলিয়ন কপি। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের তালিকায় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকায় তাঁর ওপরে আছেন শুধু শেক্সপিয়ার।
রহস্য গল্প যাঁরা লেখেন, বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায় তাঁদের নিজেদের জীবন হয় রসকষহীন আর অ্যাডভেঞ্চারবিহীন। এদিক থেকেও আগাথা ক্রিস্টি বেশ ব্যতিক্রম। তাঁর আর্কিওলজিস্ট স্বামীর সঙ্গে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন ইরাক, মিসর আর সিরিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক একেকটা স্থাপনায়। সকালবেলায় লিখতেন আর দিনের বাকি সময়টা পুরোদস্তুর প্রত্নতত্ত্ব দলের সদস্য হয়ে নেমে পড়তেন কাজে। খনন করে তুলে আনা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ছবি তুলতেন, মাটির তৈরি প্রাচীন তৈজসপত্র রিস্টোর করতেন আর পেপারওয়ার্ক সামলাতেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের পটভূমিতেও তিনি লিখে গেছেন অসংখ্য উপন্যাস।
আগাথা ক্রিস্টি যখন প্রথম লিখতে শুরু করেন, তখন পৃথিবীটা ছিল অন্য রকম। মাত্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, অভিবাসীদের ঢল ব্রিটেনজুড়ে। ব্রিটিশরা জাতি হিসেবে এমনিই বেশ নাক-উঁচু। আর ইউরোপের দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে একটু চাপা রেষারেষি, সংস্কার আর দ্বেষ তো আছেই। তাই বেলজিয়ান, রুশ, সার্বিয়ান, ফরাসিসহ অনেক জাতিসত্তার অভিবাসীদের আশ্রয় দিলেও ব্রিটেন তাদের ঠিক আপন করে নিতে পারেনি।
ক্রিস্টি তখন যুদ্ধাহতদের হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক নার্স হিসেবে কাজ করেন আর মাঝেমধ্যে ছোটগল্প লেখেন—স্বপ্ন নিয়ে, প্যারানরমাল জিনিসপত্র নিয়ে। ছদ্মনামে বিভিন্ন সাময়িকীতেও পাঠান, কিন্তু ছাপা হয় না। একদিন বোনের সঙ্গে বাজি রেখে লিখে ফেললেন একটা গোয়েন্দা উপন্যাস। নার্স হিসেবে অনেক আহত বেলজিয়ান সৈনিকের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর। তাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে বেলজিয়ান এক অবসরপ্রাপ্ত অভিবাসী পুলিশ কর্মকর্তাকে বানালেন তাঁর গল্পের মূল গোয়েন্দা-চরিত্র।
অনেক জায়গা থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর একটা প্রকাশনী অবশেষে উপন্যাসটা ছাপতে রাজি হলো। কিন্তু শর্ত জুড়ে দিল, গল্পের শেষটা একটুখানি বদলাতে হবে। ক্রিস্টি বদলালেনও। ব্যস, ছাপা হলো দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস। এরকুল পোয়ারোকে নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস।
সেই যে শুরু হলো, তার আর থামাথামি নেই। পাঠকের অনুরোধে, প্রকাশকের তাগাদায় পরপর লিখে গেছেন অসংখ্য উপন্যাস আর গল্প। সৃষ্টি হয়েছে পোয়ারো, মিস মার্পল, টমি আর টুপেন্সের মতো অসংখ্য জনপ্রিয় চরিত্র।
প্রথম বই প্রকাশের ৫৬ বছর পর ১৯৭৩-এ তিনি যখন তাঁর জীবদ্দশায় শেষ প্রকাশিত উপন্যাস পস্টার্ন অব ফেট লিখছেন, তখন তাঁর ঝুলিতে ৬৫টি উপন্যাস আর অসংখ্য ছোটগল্প। ম্যারি ওয়েস্টম্যাকট ছদ্মনামে আছে আরও ছয়টি উপন্যাস।
ওই অর্ধশতাব্দীতে পৃথিবী-সমাজ-দেশ সব একেবারে পাল্টে গেছে। পৃথিবী দেখেছে আরও একটি বিশ্বযুদ্ধ। ব্রিটেন আর সেই ‘যে সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না’ নেই। রাজতন্ত্র আর শ্রেণিব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা কমতে শুরু করেছে সূচকীয় হারে। প্রযুক্তির দুনিয়ায় আকাশ-পাতাল বদল ঘটেছে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে পৃথিবীটা হয়ে উঠেছে আরেকটু অস্থির, আরেকটু নড়বড়ে। মানুষের দেখার চোখও বদলে গেছে। এই বিশাল পরিবর্তনের ছাপ পড়েছিল ক্রিস্টির লেখাতেও। তাঁর চরিত্রগুলো আর গল্পের মোড়ও স্থির থাকেনি। তারাও সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে। রহস্যের ঘনঘটায় মোড়ানো হলেও বিশ্বের পাল্টে যেতে থাকা আর্থসামাজিক ইতিহাসের চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর লেখায়।
আগাথা ক্রিস্টির জীবনে চমকপ্রদ ঘটনাও কম নেই। একবার বাসায় রাগারাগি করে একটা চিঠি লিখে দুম করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান ক্রিস্টি। চিঠিতে লিখে গিয়েছিলেন ইয়র্কশায়ারে যাওয়ার কথা। কিন্তু দুই দিন পর নিউল্যান্ডস কর্নারের একটা পিকনিক স্পটে তাঁর খালি গাড়ি পাওয়া যায়। গাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় তাঁর পোশাক আর মেয়াদোত্তীর্ণ ড্রাইভিং লাইসেন্স। জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। নিউইয়র্ক টাইমস ও ডেইলি মিরর–এর প্রথম পৃষ্ঠায় নিখোঁজ সংবাদ প্রকাশিত হয়। ঘোষণা করা হয় অর্থ পুরস্কার। উদ্ধারে নেমে পড়েন হাজারখানেক পুলিশ কর্মকর্তা, ১৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক আর বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ। স্যার আর্থার কোনান ডয়েল ও আরেক গোয়েন্দা-লেখক ডরোথি এল সায়ার্সও যোগ দিয়েছিলেন ক্রিস্টির উদ্ধার অভিযানে। শেষমেশ নিখোঁজ হওয়ার এগারোতম দিনে ইয়র্কশায়ারের হ্যারোগেটের একটি হোটেলে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়।
আগাথা ক্রিস্টির তুলনামূলক কম পরিচিত দুটি চরিত্র টমি আর টুপেন্স। তাদের নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে এন অর এম? শিরোনামে একটা বই লিখেছিলেন ক্রিস্টি। বইটি এতই বিশ্বাসযোগ্য ছিল যে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সন্দেহজনক তালিকায় নাম উঠে গিয়েছিল তাঁর!
তবে ঔপনিবেশিক আর রক্ষণশীল বলে আগাথা ক্রিস্টির বেশ অপযশও চালু আছে। মাঝেমধ্যেই তাঁর লেখায় অ-ব্রিটিশ চরিত্রগুলোর প্রতি বেশ বৈষম্যের গন্ধ পাওয়া যায়। তার পরও টানটান গল্প আর রোমাঞ্চকর গাঁথুনির লেখাগুলো তাঁর জনপ্রিয়তায় একবিন্দু ভাটা পড়তে দেয়নি।
তুমি যদি এখনো আগাথা ক্রিস্টিকে না পড়ে থাকো, শুরু করতে পারো দ্য ম্যান ইন দ্য ব্রাউন স্যুট, এরকুল পোয়ারোকে নিয়ে লেখা দ্য মার্ডার অব রজার অ্যাকরয়েড, মিস মার্পলের প্রথম বই মার্ডার অ্যাট দ্য ভিকারেজ অথবা ছোটগল্প ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ক্রিসমাস পুডিং’ দিয়ে। এরপর তাঁর ৬৬টি উপন্যাস আর ১৪টি গল্প সংকলনের বিশাল সংগ্রহ তো আছেই!
এ মাসের ১৫ তারিখ এই ‘কুইন অব মিস্ট্রি’র জন্মদিন। তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা।