ক্যাপসুল ও প্যারাসুট দিয়ে কেন মহাকাশ থেকে ফিরতে হয়?

ঝপ করে পানিতে নামা বা স্প্ল্যাশডাউনছবি: অ্যাস্ট্রোনমি ডটকম

মানুষ মহাকাশ জয় করেছে প্রায় ৬৪ বছর হলো। প্রতিবারই মহাকাশ থেকে ফিরে আসার সময় নিরাপদে অবতরণের জন্য বিশেষ কিছু পদ্ধতি মেনে চলতে হয়েছে। মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে ফেরার জন্য নভোচারীরা সাধারণত পানির ওপর নামেন, যাকে মহাকাশবিজ্ঞানে বলা হয় 'স্প্ল্যাশডাউন'। মানে ঝপ করে পানিতে নামা। মহাকাশযান বা ভেতরে থাকা ক্যাপসুল দিয়ে পানিতে নামা হয়। পানিতে নামার কারণ খুব সহজ। পৃথিবীর পৃষ্ঠতলের প্রায় ৭০ শতাংশ পানি। তাই মহাকাশ থেকে নেমে এলে পানিতে নামার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

সাধারণত স্প্ল্যাশডাউন খুব নিরাপদ। তবে মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনাও ঘটে। যেমন, একটি স্প্ল্যাশডাউনের ঘটনা ঘটেছিল ১৯৬১ সালের ২১ জুলাই। মার্কিন নভোচারী গাস গ্রিসম 'লিবার্টি বেল ৭' মিশনে অংশ নিয়েছিলেন। রকেটে করে তিনি ১০০ মাইলেরও বেশি উপরে উঠেছিলেন। তারপর আটলান্টিক মহাসাগরে পানির ওপর নেমে আসেন। সবকিছু পরিকল্পনা মতোই চলছিল। গ্রিসম ক্যাপসুলের ভেতরে বসে কিছু তথ্য রেকর্ড করছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই ক্যাপসুলের দরজা খুলে গিয়ে ভেতরে পানি ঢুকে যায়! গ্রিসম তাঁর স্পেসস্যুটের একটি ভালভ বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন, ফলে তার পোশাকের ভেতরেও পানি ঢুকতে শুরু করে।

আরও পড়ুন

কোনোমতে ক্যাপসুল থেকে বেরিয়ে তিনি ভেসে থাকার চেষ্টা করছিলেন। হেলিকপ্টার শেষ মুহূর্তে তাঁকে উদ্ধার করে। গ্রিসমের এই ঘটনা ইতিহাসের অন্যতম নাটকীয় স্প্ল্যাশডাউন হিসেবে পরিচিত। তবে সাধারণত স্প্ল্যাশডাউন এত ভীতিকর হয় না।

পৃথিবীতে ফেরার আগে মহাকাশযানের অবশ্যই গতি কমাতে হয়। মহাকাশযান যখন দ্রুত গতিতে পৃথিবীর দিকে আসে, তখন বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘষা লেগে এর গতি কমে যায়। এই ঘর্ষণের ফলে অনেক তাপ তৈরি হয়। এর তাপমাত্রা প্রায় ১,৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। স্পেসএক্সের স্টারশিপ রকেটের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা প্রায় ১,৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্তও ওঠে।

তবে শুধু বাতাসের বাধাকে ব্যবহার করে মহাকাশযানকে নিরাপদে নামানো যায় না। এভাবে যথেষ্ট গতি কমানোও সম্ভব হয় না। তাই প্রকৌশলীরা আরও কিছু কৌশল ব্যবহার করেন। যেমন মহাকাশযানে প্যারাসুট ব্যবহার করা হয়। নাসার প্যারাসুটগুলো উজ্জ্বল কমলা রঙের হয়, যেন সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। এগুলোর ব্যাস ১০০ ফুটেরও বেশি, মানে বিশালাকার প্যারাসুট। একটি মহাকাশযানকে ভালোভাবে নামানোর জন্য একাধিক প্যারাসুট ব্যবহার করা হয়। যখন মহাকাশযানের গতি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৭০০ মিটারের নিচে নেমে আসে, তখন ড্র্যাগ প্যারাসুট বা গতি কমানোর ছোট প্যারাসুটগুলো খোলা হয়।

আরও পড়ুন
ক্যাপসুলের সমুদ্রে অবতরণ
ছবি: নাসা, জনসন স্পেস সেন্টার

নিরাপদে অবতরণের দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো পানির ওপর অবতরণ। প্যারাসুটের সাহায্যে গতি কমানোর পরেও মহাকাশযানকে কঠিন কোনো তল বা ভূমিতে নামানো যায় না, কারণ ধাক্কা লেগে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। গবেষকেরা পানিতে নামানোর পদ্ধতি বের করেছেন, কারণ পানি দারুণভাবে ধাক্কা শোষণ করতে পারে। এভাবে পানির ওপর নামা বা স্প্ল্যাশডাউনের ধারণা এসেছে।

পানিতে মহাকাশযান নামানোর পেছনে কয়েকটি কারণ আছে। পানির ঘনত্ব মাটি বা পাথরের চেয়ে অনেক কম। চাপ দিলে পানির আকার খুব দ্রুত বদলে যায়। এভাবে ক্যাপসুলের আঘাতের তীব্রতা কমে। আরেকটি কারণ হলো পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ পানি দিয়ে ঢাকা। মহাকাশ থেকে নিচে পড়ার সময় পানির ওপর পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম মানববাহী ক্যাপসুল স্প্ল্যাশডাউন করেছিল। এর নাম ছিল 'মারকারি' ক্যাপসুল। এই ক্যাপসুলের নিচের দিকটা চওড়া। এভাবে ক্যাপসুলটি পানির ওপরে পড়ে। ভেতরে নভোচারী ওপরের দিকে মুখ করে বসে থাকেন। বাতাসের সঙ্গে ঘর্ষণে ক্যাপসুলের নিচের অংশ বেশি তাপ শোষণ করে। তাই নিচের অংশে একটি বিশেষ তাপ-প্রতিরোধী স্তর ব্যবহার করা হয়।

আরও পড়ুন

মহাকাশযান বা ক্যাপসুল প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২৪ মিটার গতিতে পানির ওপর নামে। এর নিচের অংশ মসৃণ না হলেও সমস্যা হয় না। এর কাঠামো, ভেতরের জিনিসপত্র বা নভোচারীদের কোনো ক্ষতি হয় না।

১৯৮৬ সালে চ্যালেঞ্জার স্পেস শাটল দুর্ঘটনার পর প্রকৌশলীরা 'ক্র্যাশওয়ার্দিনেস' বা আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা নিয়ে আরও গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। এখন সব মহাকাশযান এমনভাবে পরীক্ষা করা হয়, যেন মহাকাশ থেকে ফেরার পর সেগুলো পানির ওপর টিকে থাকতে পারে।

২০২১ থেকে ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত স্পেসএক্সের সাতটি ড্রাগন ক্যাপসুল ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন থেকে ফিরে আসার সময় সফলভাবে স্প্ল্যাশডাউন করেছে। ৬ জুন ২০২৪, স্পেসএক্সের স্টারশিপ রকেট ভারত মহাসাগরে অসাধারণভাবে উলম্বভাবে স্প্ল্যাশডাউন করে। এটি পানির কাছাকাছি আসার সময়ও রকেটের ইঞ্জিন জ্বলছিল, ফলে বিপুল পরিমাণে বাষ্প তৈরি হয়েছিল।

স্পেসএক্স ড্রাগন ক্যাপসুলগুলোকে আবার ব্যবহার করার জন্য স্প্ল্যাশডাউনের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা হয়। এতে বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয় না। ফলে ভবিষ্যতে এটি আবার ব্যবহার করা যাবে। এভাবে কোটি কোটি ডলার সাশ্রয় করতে পারবে প্রতিষ্ঠানগুলো। মহাকাশ মিশনের খরচও কমবে।

তাই স্প্ল্যাশডাউন এখনও মহাকাশযানের পৃথিবীতে ফেরার সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি। ভবিষ্যতেও আরও অনেক স্প্ল্যাশডাউন দেখা যাবে।

সূত্র: অ্যাস্ট্রোনমি ডটকম

আরও পড়ুন