আইসক্রিম কোথা থেকে এল
আইসক্রিম সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়, বিশেষ করে শিশুদের কাছে। সারা বিশ্বের মানুষ বিশেষ করে গরমের সময় আইসক্রিম খেতে খুব পছন্দ করে। তবে অন্য সময়ও মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয় এই খাবার। যদিও অনেকের ভয়, শীতকালে বা বেশি আইসক্রিম খেলে আবার ঠান্ডা লেগে না যায়। আইসক্রিমের মতো এর ইতিহাসও কিন্তু বেশ মজার। চলো, আমরা আইসক্রিমের কামড়ের মতো করে এর ইতিহাসে একটা করে কামড় দিয়ে আসি।
প্রথম বাইট: কীভাবে আর কোথা থেকে এল আইসক্রিম
আইসক্রিমের জন্ম কিন্তু এশিয়ায়। কীভাবে এটা এশিয়া থেকে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল, সে এক মজার কাহিনি। ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে ভেনিস ছিল এক নগররাষ্ট্র, মানে একটা দেশ, যা এখন ইতালির এক শহর। সেখান থেকে চীনের উদ্দেশে যাত্রা করে এক বণিক পরিবার।
সেই দলে ছিল এক কিশোর। দীর্ঘ ও কষ্টকর যাত্রা শেষে তারা চীনে পৌঁছায়। সেখানে প্রায় ১৭ বছর কাটানোর পর সে যখন ভেনিসে ফিরে আসে, তখন সে এক তরুণ। যদিও অনেকে ভেবেছিল, সে হয়তো আর কোনো দিন ফিরবে না। পথেই মৃত্যুবরণ করেছে এরা সবাই। কারণ, তখন এ রকম দূরদেশের যাত্রায় পথে পথে ছিল মৃত্যুর শঙ্কা।
মৃত্যুকে এড়িয়ে সেই বণিক কেবল ভেনিসে ফিরেই এলেন না, সেই সঙ্গে নিয়ে এলেন অনেক মূল্যবান সামগ্রী আর অসংখ্য গল্প। তিনি জানালেন, চীন অনেক সম্পদশালী দেশ। দেশে ফিরে তিনি তাঁর চীন সফর ও সেখানে বাস করা নিয়ে একটা বই লিখলেন। এই বই লেখার কারণে তাঁকে এলাকার মানুষ আজগুবি গল্পের লেখক, পাগল হিসেবে চিহ্নিত করল।
কারণ, সেই বইয়ে বণিক লিখেছিলেন, চীনে মানুষ কাগজ ব্যবহার করে। বিনিময় করে কাগজের টাকার মাধ্যমে (ইউরোপ তখনো জানত না, কাগজ কী জিনিস)। তারা কালো একটা উপাদান (কয়লা) দিয়ে আগুন ধরায়। বরফে মিষ্টি মিশিয়ে অত্যন্ত সুস্বাদু এক খাবার খায়।
যদিও অনেকেই সেই বণিককে পাগল ঠাউরেছিল, কিন্তু তিনি সবাইকে সেই মিষ্টি খাবার বানিয়ে খাওয়ান। আর সেই খাবার খেয়ে পুরো ভেনিস খাবারটির প্রেমে পাগল হয়ে যায়।
সেই বণিকের নাম ছিল মার্কো পোলো আর সেই সুস্বাদু খাবারের নাম হলো আইসক্রিম।
দ্বিতীয় বাইট: আইসক্রিমের জন্ম
গল্পে আছে, ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে চীনের শাং বংশের রাজা তাংয়ের রাজ্যে ৯৪ জন কারিগর বরফ দিয়ে খাবার বানাতেন। তাঁরা একদিন মহিষের দুধ ঘন করে তাতে মিষ্টি, বরফ, সুগন্ধি চাল ও কর্পূরের গন্ধ মিশিয়ে যে খাবার তৈরি করেন, সেটাই নাকি আইসক্রিম। আর এর নাম ছিল সুসান।
তবে অনেক ইতিহাসবিদের মতে চীনের মানুষ যে আইসক্রিম খেত, সেটার কাহিনি আরও পুরোনো। কারও মতে, যিশুর জন্মের ২০০ বছর, আবার কারও মতে ২ হাজার বছর আগে চীনের লোকেরা বরফ, দুধ ও চাল মিশিয়ে এক ঠান্ডা খাবার খেত। সেটাই ছিল আইসক্রিম।
আইসক্রিম কারা বানিয়েছে? এ নিয়ে ইরান, গ্রিস ও চীনের মধ্যে এখনো এক ঠান্ডা লড়াই চলে। চীন ছাড়া ইরান ও গ্রিসেও আইসক্রিমের মতো খাবার খাওয়া হতো। তবে অনেক আইসক্রিম–বিশেষজ্ঞের মতে, সেগুলো আসলে বরফ দিয়ে শরবত কিংবা ফল খাওয়ার মতো।
তৃতীয় বাইট: চীন থেকে ইউরোপে যাত্রা
মার্কো পোলো আইসক্রিমকে ইউরোপে নিয়ে এলেন। তবে আইসক্রিম কিন্তু সাধারণ মানুষের খাবার ছিল না। কারণ, ক্রিম তো তখন এত সহজে বানানো যেত না, আবার তখন মানুষ যে সময় আইসক্রিম খেতে চাইত, মানে গরমকালে, তখন আশপাশে কোথাও বরফের ছিটেফোঁটাও দেখা যেত না। আর সবচেয়ে বড় কথা, আইসক্রিম বানানোর কৌশল সাধারণ মানুষের জানা ছিল না। তাই মার্কো পোলোর কাছ থেকে পাওয়া এই চীনা খাবারের রেসিপি ইতালির রাজারা গোপন রাখতেন।
ইতালি থেকে আইসক্রিম প্রথমে ফ্রান্সে গিয়ে হাজির। এই যাত্রার পেছনে ছিল একটা বিয়ের গল্প। ইতালির ফ্লোরেন্সের শাসক মেদিচি পরিবারের কন্যা ক্যাথিরিন দে মেদিচির সঙ্গে ১৫৩৩ সালে বিয়ে হয় ডিউক অব আর্লিয়েন্সের। যিনি কিনা ভবিষ্যতে দ্বিতীয় হেনরি নামে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসতে যাচ্ছেন। রাজকন্যা যৌতুক হিসেবে একদল রাঁধুনিসহ শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে হাজির হন। এই রাঁধুনিদের দলে একজন ছিলেন আইসক্রিম নির্মাতা। তাঁর আইসক্রিমের স্বাদে মুগ্ধ হয় ফ্রান্স।
বলা হয়ে থাকে, এরও ১০০ বছর পর ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লস আইসক্রিমের স্বাদ পেয়ে নাকি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে এরপর তিনি সেই আইসক্রিম বানানোর কারিগরকে নিজের রাজপ্রাসাদে বেতন দিয়ে রেখে দেন, যেন আর কেউ এই আইসক্রিমের স্বাদ পেতে না পারে।
চতুর্থ বাইট: রাজবাড়ি থেকে দোকানে
১৬৮৬ সাল আইসক্রিমের ইতিহাসে বিশেষ বছর। তার আগে আইসক্রিম কেবল রাজবাড়িতে বা একেবারে অভিজাত কোনো পরিবারে খেতে পাওয়া যেত। সে বছর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ফ্রান্সিসকো ডে কোলাতেল্লি ওরফে ফ্রাঁসোয়া প্রকোপে নামের এক ব্যক্তি একটি দোকান খোলেন। দোকানটির নাম ক্যাফে প্রকোপে। নাম ক্যাফে হলেও সেটা ছিল আইসক্রিমের দোকান। নাম ফ্রান্সিস হলেও ডে কোলাতেল্লি আদতে ছিলেন সিসিলির মানে আজকের ইতালির নাগরিক। তিনি ইতালির বিশেষ আইসক্রিম জেলাটোর আবিষ্কারক। আইসক্রিমের লাইসেন্স নিয়ে তিনি তাঁর ক্যাফেতে আইসক্রিম বিক্রি করা শুরু করেন। সে জন্য তাঁকে ‘ফাদার অব জেলাটো’ বলা হয়। আর সেই ক্যাফে হচ্ছে বিশ্বের প্রথম আইসক্রিমের দোকান বা আইসক্রিম পারলার।
ফ্রান্সের অভিজাত ব্যক্তিদের কাছে এই খাবার এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে এরপর ৫০ বছরে প্যারিসে ২৫০টি আইসক্রিম পারলার গড়ে উঠে।
পঞ্চম বাইট: আমেরিকা
কলম্বাস আমেরিকায় যাওয়ার জলপথ খুঁজে পাওয়ার পর ঝাঁকে ঝাঁকে ইউরোপিয়ানরা আমেরিকায় গিয়ে হাজির হয়। তবে কলম্বাসের আমেরিকার জলপথ খুঁজে পাওয়ার প্রায় ২৫০ বছর পর জনপ্রিয় খাবার আইসক্রিম গিয়ে হাজির হয় যুক্তরাষ্ট্রে। বলা হয়ে থাকে, ১৭৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের গর্ভনরের স্ত্রী আনা ভ্যান সোয়ারিনজেনকে প্রথম আইসক্রিম খেতে দেওয়া হয়। আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যারা বীর সেনাপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক, তাদের সবার আইসক্রিমে আসক্তি ছিল মারাত্মক। জর্জ ওয়াশিংটন, বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন, থমাস জেফারসন—এরা সবাই আইসক্রিম খেতে খুবই পছন্দ করতেন। বলা হয়ে থাকে যে আমেরিকার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন আমেরিকায় ভ্যানিলা আইসক্রিমকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
ষষ্ঠ বাইট: সাধারণের নাগালে আইসক্রিম
কার্লো গাত্তি ছিলেন সুইজারল্যান্ডের নাগরিক। তিনি ১৮৪৭ সালে ইংল্যান্ডে আসেন। সেই সঙ্গে নিয়ে আসেন এক ব্যবসার বুদ্ধি। তিনি রিজেন্ট কানাল নামে খাল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেন। সেই চুক্তি অনুসারে গাত্তি এই কোম্পানির কাছ থেকে বরফ নিতেন।
বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলে প্রথম বেবী আইসক্রিম মেশিনে তৈরি আইসক্রিম বিক্রি শুরু করে। এর আগে অবশ্য হাতে তৈরি আইসক্রিম বিক্রি হতো।
কার্লো গাত্তি চেরিংক্রস নামে লন্ডনের মূল জংশনে আইসক্রিম বিক্রি করতেন। সবাই হুমড়ি খেয়ে তাঁর আইসক্রিম খেত। কারণ, তাঁর আইসক্রিমের দাম ছিল মাত্র এক পেনি। এত দিন যে খাবার ছিল কেবল অভিজাত মানুষের, গাত্তির কারণে সেটা হয়ে গেল সবার প্রিয় খাবার।
গাত্তির ব্যবসা এতটাই ফুলেফেঁপে উঠেছিল যে তিনি আইসক্রিম বানানোর জন্য নরওয়ে থেকে টন টন বরফ নিয়ে আসতেন। আর রিজেন্ট কানাল বা খালের পাশে বিশাল ভবন বানিয়ে সেই বরফ সংরক্ষণ করতেন।
আইসক্রিমের জন্ম চীনে হলেও ইউরোপকে আইসক্রিম চিনিয়েছিলেন এক ইতালিয়ান নাগরিক। আর আইসক্রিমকে সারা বিশ্বের সাধারণ নাগরিকদের হাতের নাগালে যিনি এনেছেন, তিনিও আদতে ইতালীয় নাগরিক। হ্যাঁ, কার্লো গাত্তির জন্ম সুইজারল্যান্ডে হলেও তিনি আদতে ছিলেন ইতালীয় মা–বাবার সন্তান। এখনো বিশ্বের সেরা আইসক্রিম নির্মাতা কারা? ইতালীয়রা। এখনো আইসক্রিম বানানোয় ইতালীয়রা বিখ্যাত।
আইসক্রিম ইতিহাসের শেষ বাইট: বাংলাদেশে আইসক্রিম
যদিও আইসক্রিম ইউরোপ থেকে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়েছে, কিন্তু উপমহাদেশে আইসক্রিম অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে আগেই এসে পড়েছিল। আর সেটা এ দেশে এনেছিল মোগলরা। আজও কিন্তু আমরা সেই আইসক্রিম খাই! আর সেটা হলো কুলফি মালাই। মোগলরা দিল্লি দখলের পর দিল্লি থেকে এই খাবার সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মটকা বা হাঁড়িতে রেখে এটি তৈরি করা হতো বলে একসময় কেবল মটকা কুলফি খাওয়া হতো। এখন আম কুলফি, পেস্তা কুলফি, খেজুর কুলফি, জাফরান কুলফি ইত্যাদি পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলে প্রথম বেবী আইসক্রিম মেশিনে তৈরি আইসক্রিম বিক্রি শুরু করে। এর আগে অবশ্য হাতে তৈরি আইসক্রিম বিক্রি হতো। তবে বেবী আইসক্রিম ঢাকায় আইসক্রিমকে সবার কাছে জনপ্রিয় করে তোলে। সেই সঙ্গে তারা গুলিস্তানে একটা আইসক্রিমের দোকান খোলে। ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামে কোকাকোলার কারখানার পাশে একটা আইসক্রিম কোম্পানি তাদের কার্যক্রম শুরু করে, যা এখনো চলছে। আর সেই কোম্পানির নাম ইগলু।