আড়াই হাজার বছর আগে পাথরে লেখা ইতিহাস থেকে তৈরি হচ্ছে অভিধান
আড়াই হাজার বছর আগের এক মৃত ভাষা। নেই কোনো বই, নেই কোনো শিক্ষক। তবু বিজ্ঞানীরা পাথরের গা থেকে তুলে আনছেন সেই হারানো শব্দ! সিসার পাতে লেখা ভয়ংকর অভিশাপ থেকে শুরু করে হাজার বছরের গোপন ইতিহাস উঠে আসছে নতুন ডিকশনারিতে।
আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের ইউরোপকে কল্পনা করতে পারো? তখনো ইংরেজি বা ফরাসি ভাষার জন্ম হয়নি। রোমান সাম্রাজ্যও সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েনি। সেই সময়ে ইউরোপের বিশাল অংশজুড়ে দাপিয়ে বেড়াত এক দুর্ধর্ষ জাতি। সে জাতির নাম কেল্ট।
আমরা অনেকেই কমিকস বা সিনেমায় অ্যাস্টেরিক্স ও ওবেলিক্সের গল্প দেখেছি। তারা ছিল গল বা কেল্টিক জনগোষ্ঠীর মানুষ। কিন্তু কখনো কি ভেবেছ, এই মানুষগুলো আসলে কোন ভাষায় কথা বলত? তারা কি একে অপরকে হ্যালো বলত, নাকি অন্য কিছু?
দুর্ভাগ্যবশত, তাদের সেই ভাষাগুলো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। কিন্তু এবার সেই মৃত ভাষাকেই জ্যান্ত করার এক অসাধ্য সাধনে নেমেছেন ভাষাবিজ্ঞানীরা। তাঁরা তৈরি করছেন প্রাচীন কেল্টিক ভাষার বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অভিধান বা ডিকশনারি!
এই কাজটা মোটেও সহজ নয়। কারণ, আমাদের হাতের কাছে যেমন বাংলা বা ইংরেজি ডিকশনারি আছে, প্রাচীন কেল্টদের তেমন কোনো লিখিত বই বা ব্যাকরণ ছিল না। তাহলে বিজ্ঞানীরা শব্দগুলো পাচ্ছেন কোথায়? বিজ্ঞানীরা শব্দ খুঁজছেন মাটির নিচে আর পাথরের গায়ে। ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি ও পর্তুগালের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার পুরোনো শিলালিপি, ব্রোঞ্জের পাত, এমনকি প্রাচীন মুদ্রার ওপর লেখা ছোট ছোট শব্দ জোড়া লাগিয়ে তাঁরা এই ডিকশনারি বানাচ্ছেন।
বিজ্ঞানীরা মূলত কন্টিনেন্টাল কেল্টিক ভাষা নিয়ে কাজ করছেন। আধুনিক যুগে আয়ারল্যান্ড বা ওয়েলসে যে কেল্টিক ভাষা চালু আছে, এগুলো তার চেয়ে আলাদা। প্রাচীন এই ভাষাগুলো রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তারের ফলে এবং লাতিন ভাষার দাপটে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
গবেষকেরা ৪ হাজারেরও বেশি এমন প্রাচীন লিপি বা ইনস্ক্রিপশন সংগ্রহ করেছেন। এগুলো পাঠোদ্ধার করে তাঁরা অবাক! কী নেই সেখানে? কোনো ফলকে লেখা আছে রাজার নাম, কোনোটিতে ব্যবসার হিসাব-নিকাশ। আবার কিছু কিছু পাওয়া গেছে সিসার তৈরি পাত বা শিট। সেখানে লেখা আছে ভয়ংকর সব অভিশাপ!
প্রাচীনকালে মানুষের বিশ্বাস ছিল, শত্রুর ক্ষতি করতে হলে সিসার পাতে অভিশাপ লিখে সেটাকে ভাঁজ করে মাটির নিচে বা কুয়োর মধ্যে ফেলে দিতে হয়। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ভাষায় একে বলা হয় কার্স ট্যাবলেট বা অভিশাপনামা। এই ট্যাবলেটগুলো থেকেই বিজ্ঞানীরা প্রচুর নতুন শব্দ উদ্ধার করেছেন।
আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের গবেষকেরা বলছেন, ‘এই প্রজেক্টের মাধ্যমে আমরা ইউরোপের ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায় জানতে পারব। এত দিন আমরা ইউরোপের ইতিহাস পড়েছি রোমান বা গ্রিকদের লেখায়। এবার প্রথমবারের মতো আমরা সেই আমলের সাধারণ মানুষের জবানিতে তাঁদের কথা শুনতে পাব।
বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত হাজার হাজার শব্দ ডিজিটাল ডেটাবেজে যুক্ত করেছেন। তাঁরা আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছেন, যাতে এই ভাঙা শব্দগুলো জোড়া লাগিয়ে পূর্ণাঙ্গ বাক্য তৈরি করা যায়।
ভাষাই হলো একটি জাতির প্রাণ। রোমানদের তলোয়ারের নিচে যে ভাষা একদিন হারিয়ে গিয়েছিল, আড়াই হাজার বছর পর আধুনিক বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় তা আবার প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। পাথরের গায়ে লেখা সেই হাজার বছরের নীরব শব্দরা অবশেষে কথা বলতে শুরু করেছে!
সূত্র: আইএফএল সায়েন্স