দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরাও এখন মাঠে বসে খেলা উপভোগ করতে পারবেন

‘ফিল্ড অব ভিশন’ছবি: সিএনএন

ফুটবল হোক বা ক্রিকেট, স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে প্রিয় দলের খেলা দেখার মজাই আলাদা। গোল হলে আনন্দ-উচ্ছ্বাস, আর হারলে হতাশা। কিন্তু যারা চোখে দেখেন না, তাদের কাছে স্টেডিয়ামের অভিজ্ঞতাটা বেশ অন্যরকম। তারা হয়তো খেলার শব্দ বা দর্শকের চিৎকার শুনতে পান। কিন্তু মাঠে কে কী করছে, তা তাদের কাছে অজানাই থেকে যায়।

বিশ্বজুড়ে স্টেডিয়ামগুলোতে যারা চোখে দেখতে পান না, তারাও খেলা দেখতে যান। সেসব খেলাপ্রেমীদের ম্যাচ উপভোগ করার জন্য প্রায়ই ধারাভাষ্যকার বা আশেপাশে বসে থাকা মানুষের ওপর নির্ভর করতে হয়। যারা খেলাটা বর্ণনা করে শোনান। এবার এই সমস্যা সমাধানের জন্য একটি আইরিশ স্টার্টআপ কাজ করছে।

আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনের ‘ফিল্ড অব ভিশন’ নামের একটি যন্ত্র তৈরি করেছে। তাদের জানিয়েছেন, এই যন্ত্রটি অন্ধ ও আংশিক দৃষ্টিশক্তিহীন ভক্তদের খেলাটা শুধু শুনতে নয়, বরং ‘অনুভব’ করতেও সাহায্য করবে। এর ফলে স্টেডিয়ামে বসে সরাসরি খেলা দেখার অভিজ্ঞতা তাদের জন্য আরও ভালো হবে।

স্টেডিয়ামের প্রতিটি কোণায় বসানো থাকে বিশেষ ক্যামেরা। এগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে ম্যাচের সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ট্র্যাক করে। মাত্র আধা সেকেন্ডের মধ্যে এই তথ্যগুলো ‘ফিল্ড অব ভিশনে’ পাঠান হয়। ডিভাইসটা দেখতে সাদা, ট্যাবের মতো। এই ডিভাইসটা খেলার মাঠের মতো দেখতে। এর ওজন এক কেজিরও কম। ব্যবহারকারীর এটা কোলের ওপর রাখতে পারবেন।

একটা ছোট চুম্বকের রিং ব্যবহারকারীর আঙুলকে ট্যাবলেটের চারপাশে ঘুরিয়ে নির্দেশ করে যে বলটা কোথায় আছে। অনেকটা উইজা বোর্ডের (Ouija board) নড়াচড়ার মতো। এছাড়াও, যখন খেলার মাঠে ট্যাকল হয় বা বলের দখল পরিবর্তন হয় তখন ডিভাইসটি কেঁপে ওঠে। এতে ব্যবহারকারী বুঝতে পারেন বলটা কার দখলে আছে।

‘ফিল্ড অব ভিশন’ ডিভাইসটিতে উন্নত অডিও প্রযুক্তি রয়েছে। যাতে অডিও বর্ণনা শোনার পাশাপাশি আরও ভালোভাবে খেলার অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। এতে হেডফোন লাগানোরও ব্যবস্থা আছে। যাতে ব্যবহারকারীরা চাইলে স্টেডিয়ামের খেলার বর্ণনাও শুনতে পারেন।

আরও পড়ুন
এই ডিভাইসটি ব্যবহার করে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এমন এক অনুভূতি পান যেন তারা খেলারই অংশ
ছবি: সিএনবিসি

‘ফিল্ড অব ভিশন’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড ডেনেহার এই প্রযুক্তি সম্পর্কে জানান, ‘এই ডিভাইসটি ব্যবহার করে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এমন এক অনুভূতি পান যেন তারা খেলারই অংশ। আর বাকি সবার মতোই মাঠে বসে খেলাটা উপভোগ করতে পারছেন। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া।’

‘ফিল্ড অব ভিশন’ তৈরিতে ডেভিড ডেনেহার সঙ্গে আরও ছিলেন তাঁর দুই বন্ধু। তাঁরা হলেন ডাব্লিনের ট্রিনিটি কলেজের শিক্ষার্থী টিম ফ্যারেলি এবং বেলফাস্টের কুইন্স ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ওমর সালেমের। তাঁরা তিনজন মিলে ২০২০ সালে এই স্টার্টআপটি শুরু করেন। কোভিড-১৯ লকডাউনের সময় তাঁদের কাছে অনেক বাড়তি সময় ছিল। আর সেই সময়েই তাঁরা কিছু একটা করার কথা ভাবেন।

অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করা ওমর সালেমের মাথায় প্রথম এই ধারণাটা আসে। তিনি লিভারপুল ফুটবল দলের একজন আংশিক দৃষ্টিশক্তিহীন সমর্থক মাইক কার্নির একটি সোশ্যাল মিডিয়া ভিডিও দেখেন। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল লিভারপুলের অ্যানফিল্ড স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে কার্নির চাচাতো ভাই স্টিফেন গার্সিয়া তাকে খেলার ঘটনাগুলো বলছেন। এই দৃশ্য দেখেই সালেম আইডিয়াটি পান।

লন্ডনের রয়্যাল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ব্লাইন্ড পিপল-এর (RNIB) তথ্য অনুসারে, শুধু যুক্তরাজ্যেই ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষ অন্ধ বা আংশিক দৃষ্টিশক্তিহীন হিসেবে তালিকাভুক্ত। আর সারা বিশ্বে আনুমানিক ৪ কোটি ৩০ লাখ মানুষ অন্ধ। ডেভিড ডেনেহার টিম আশা করে, ‘ফিল্ড অব ভিশন’-এর এই প্রযুক্তি বিশ্বজুড়ে বিপুল সংখ্যক খেলাপ্রেমীর জন্য সরাসরি স্টেডিয়ামের খেলার অভিজ্ঞতাকে অনেক উন্নত করতে পারে।

তবে, যখন তিনি ‘ফিল্ড অব ভিশন’ ট্যাবলেটটি ব্যবহার করলেন, তখন তার মনে হলো মাঠের খেলা উপভোগ করার জন্য এটা একটা অসাধারণ নতুন উপায়।

ডাব্লিন ফুটবল ক্লাব বোহেমিয়ানসের সমর্থক ডেক্লান মিনাঘ একটি চোখের সমস্যা নিয়ে জন্মেছিলেন। যার কারণে তিনি মাত্র ৫ শতাংশ দেখতে পান। তিনি তাঁর প্রিয় দল বোহেমিয়ানসের ডালিমাউন্ট পার্ক স্টেডিয়ামের গোলের পেছনে সামনের সারিতে বসলেও, ক্রসবারের বাইরে কী ঘটছে তা দেখতে পান না। ক্লাবের স্বেচ্ছাসেবকরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী দর্শকদের জন্য ইয়ারফোনের মাধ্যমে খেলার বর্ণনা দেন। যাতে তাঁরা খেলাটা বুঝতে পারেন। কিন্তু স্টেডিয়ামের ভিড়ের চিৎকারে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনতে পান না।

আরও পড়ুন

তবে, যখন তিনি ‘ফিল্ড অব ভিশন’ ট্যাবলেটটি ব্যবহার করলেন, তখন তার মনে হলো মাঠের খেলা উপভোগ করার জন্য এটা একটা অসাধারণ নতুন উপায়। তিনি বলেন, ‘ফুটবলটা ঠিক কোথায় আছে আর মাঠে কী হচ্ছে, সেটা অনুভব করতে পারাটাই আসল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। ট্যাবলেটটা দারুণ সাহায্য করে। কারণ এর ফলে মাঠে বলের অবস্থান ও নড়াচড়া সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া যায়। সত্যিই বুঝতে পেরেছি সবকিছু কতটা দ্রুত ঘটছে। এটা আসলেই চমৎকার’।

‘ফিল্ড অব ভিশন’ ট্যাবলেটটি ২০২১ সালে জেমস ডাইসন পুরস্কারে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে। ২০২২ সালে টাইম ম্যাগাজিনের সেরা আবিষ্কারের তালিকায় স্থান করে নেয়। এটি আইরিশ স্পোর্ট ইন্ডাস্ট্রি অ্যাওয়ার্ডসেও সম্মানিত হয়েছে। প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার ইউরো তহবিল সংগ্রহের পায় এই প্রযুক্তি। বোহেমিয়ানস ফুটবল ক্লাব থেকে শুরু করে ম্যানচেস্টার সিটির স্টেডিয়ামে এর সফল পরীক্ষা চালানো হয়। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার মার্ভেল স্টেডিয়ামে এর পূর্ণাঙ্গ উদ্বোধন হয়। মার্ভেল স্টেডিয়াম অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল লীগ মৌসুমে প্রতিটি খেলার সময় ৪০টি ডিভাইস দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী দর্শকদের দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন