বই না পড়ে জমিয়ে রাখলেও যে উপকার পাওয়া যায়

বইমেলা থেকে একগাদা বই কিনে এনেছ, কিন্তু পড়া হচ্ছে না? ভাবছ, তুমি অলস? একদমই নয়! না পড়া বই আসলে তোমার অজ্ঞতার সাইনবোর্ড, যা তোমাকে আরও বিনয়ী ও জ্ঞানপিপাসু করে তোলে। এর পেছনে আছে এক অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব…

গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব বাড়িতে প্রচুর বই থাকে, সেসব বাড়ির ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় অন্যদের চেয়ে ভালো হয়।ছবি: কবির হোসেন

বইমেলা বা কোনো বইয়ের দোকানে গেছ, ফেরার সময় ব্যাগে করে একগাদা বই কিনে ফিরেছ। অনেকেরই এমন স্বভাব আছে। হয়তো কোনো বই কেনার প্ল্যান ছিল, কিন্তু কিনে ফেলেছ দুইটা! আসলে যারা বই পড়ে, তাদের পক্ষে ভালো বই কেনার লোভ সামলানো দায়।

কিন্তু সমস্যাটা হয় বাড়ি ফেরার পর। পড়ার টেবিলে বা বুকশেলফে একের পর এক বই জমতে থাকে, কিন্তু পড়ার আর সময় হয় না। তখন কি তোমার একটু একটু অপরাধবোধ হয়? মনে হয়, ইশ! এত বই কিনছি, কিন্তু পড়ছি না কেন? শুধু শুধু কতগুলো টাকা নষ্ট করলাম!

তোমার সঙ্গে যদি এমনটা হয়ে থাকে, তবে মন খারাপের কিছু নেই; বরং খুশির খবর হলো এই না পড়া বইয়ের পাহাড় আসলে তোমার বুদ্ধিমত্তারই পরিচয় দেয়! বিশ্বাস হচ্ছে না তো? চলো, তোমাকে একটা মজার গল্প শোনাই।

নাসিম নিকোলাস তালেব নামের একজন বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ আছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সাধারণত যেসব বই পড়ে শেষ করেছি, সেগুলোকে খুব গুরুত্ব দিই। ভাবি, আমি কত জানি!’ কিন্তু তাঁর মতে, যেসব বই আমরা এখনো পড়িনি, সেগুলোই আসলে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এর নাম দিয়েছেন অ্যান্টিলাইব্রেরি। মানে তুমি যেসব বই কিনেছ, কিন্তু এখনো পড়ার সময় পাওনি, সেগুলোকে তিনি বলছেন অ্যান্টিলাইব্রেরি।

আরও পড়ুন

কেন এমন নাম জানো? কারণ, পড়া বইগুলো তোমার জানা জ্ঞানের সীমানা। আর না পড়া বইগুলো তোমাকে মনে করিয়ে দেয়, পৃথিবীতে জানার এখনো কত কিছু বাকি! এই না পড়া বইগুলো তোমাকে অহংকারী হতে দেয় না; বরং তোমাকে বিনয়ী করে তোলে। এগুলো তোমাকে মনে করিয়ে দেয়, এখনো অনেক কিছু শেখার আছে!

ইতালির একজন বিখ্যাত লেখক ও পণ্ডিত ছিলেন, নাম উম্বের্তো একো। তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে কতগুলো বই ছিল জানো? প্রায় ৩০ হাজার! তাঁর বাড়িতে যখন কেউ বেড়াতে আসতেন, তাঁরা বিশাল ওই লাইব্রেরি দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, আপনি কি এসব বই পড়েছেন?

উম্বের্তো একো হাসতেন। তিনি জানতেন, সব বই পড়া সম্ভব নয়। তিনি যদি ১০ বছর বয়স থেকে ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিদিন একটা করে বইও পড়তেন, তবু তিনি মাত্র ২৫ হাজার বই শেষ করতে পারতেন। তাহলে বাকি বইগুলো কেন? কারণ, তিনি মনে করতেন, লাইব্রেরি কোনো ট্রফি বা মেডেল সাজিয়ে রাখার জায়গা নয়। লাইব্রেরি হলো একটা গবেষণাগার। সেখানে এমন বই বেশি থাকা উচিত, যেগুলো তুমি এখনো পড়নি। কারণ, ওগুলোই তোমাকে নতুন কিছু শিখতে উৎসাহিত করবে।

তোমার এই বই জমিয়ে রাখার অভ্যাসের কিন্তু একটা দারুণ জাপানি নামও আছে। জাপানিরা একে বলে সানদোকু। শব্দটা এসেছে সানদে-ওকু ও দোকুশো থেকে। জাপানি শব্দ সানদে-ওকু মানে জিনিসপত্র স্তূপ করে রাখা, আর দোকুশো মানে বই পড়া। এই দুটি শব্দ মিলে হয় পড়ার উদ্দেশ্যে বই কিনে জমিয়ে রাখা। মজার ব্যাপার হলো জাপানে এই শব্দকে মোটেও খারাপ চোখে দেখা হয় না। এটি বাতিকগ্রস্তের মতো শুধু সাজিয়ে রাখার জন্য বই কেনা নয়; সানদোকু মানে হলো তুমি বইগুলো ভালোবাসো এবং ভবিষ্যতে কোনো এক সময় পড়ার ইচ্ছা তোমার আছে।

আরও পড়ুন

গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব বাড়িতে প্রচুর বই থাকে, সেসব বাড়ির ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় অন্যদের চেয়ে ভালো হয়। বইয়ের চারপাশে থাকলে তোমার মনের বিকাশ ঘটে, নতুন নতুন শব্দ শেখা যায় আর কল্পনার জগৎটা হয় বিশাল।

বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বই পড়া বা বইয়ের সান্নিধ্যে থাকা মানসিক চাপ কমাতেও দারুণ কার্যকর। যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৬ মিনিট বই পড়লে মানুষের মানসিক চাপ প্রায় ৬৮ শতাংশ কমে! তাই বই শুধু জ্ঞান নয়, মানসিক প্রশান্তিরও ওষুধ!

জেসিকা স্টিলম্যান নামের এক লেখক বলেন, না পড়া বইগুলো আমাদের না জানা বিষয়গুলোর একেকটা সাইনবোর্ড। আর নিজের অজ্ঞতা সম্পর্কে জানাটা খুব বড় গুণ। বোকারা ভাবে তারা সব জানে, কিন্তু বুদ্ধিমানেরা জানে যে তাদের জানার অনেক বাকি। তোমার শেলফের ওই না পড়া বইগুলো তোমাকে সেই বুদ্ধিমানদের দলে রাখে।

তাই বই কিনতে থাকো, জমাতে থাকো। হয়তো আজ পড়ছ না, কিন্তু হয়তো কাল, পরশু বা আরও কয়েক বছর পর পড়বে। তুমি না পড়তে পারলেও হয়তো তোমার পরের প্রজন্ম পড়বে। মূল কথা হলো বইয়ের সঙ্গ ছেড়ো না!

সূত্র: বিগ থিঙ্ক ও ব্রেন পিকিংস

আরও পড়ুন