ঘরের শত্রু বিভীষণ, আর মনু মিয়ার ঘোড়ার শত্রু?
‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’—এই বাগধারা নিশ্চয়ই সবার জানা। বিভীষণ অর্থ অতিশয় বা ভীষণ ভয়ংকর। কিন্তু ঘোড়ার শত্রু কি বা কারা? এটা আমরা জানি না। হয়তো জানেন না, ঘোড়া ছুটিয়ে ৩ হাজারের বেশি কবর খোঁড়া দরিদ্র মনু মিয়াও। রোগে কাবু হয়ে মনু মিয়া এখন হাসপাতালের শয্যায়। এই সুযোগে তাঁর প্রিয় পোষা ঘোড়াটি মেরে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। এ খবর মনু মিয়া এখনো না জানলেও জেনে গেছে পুরো দেশ। ভাইরাল এই খবর ছাড়িয়ে গেছে দেশের সীমানাও।
সবখান থেকেই এই প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয়েছে—ঘোড়াটি মারল কারা (হু কিলড দ্য হর্স)? ঘোড়ার শত্রু কারা? এর সুনির্দিষ্ট উত্তর না জানলেও কেউ কেউ প্রথম আলোর এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উত্তর হিসেবে মন্তব্য করেছেন ‘অমানুষ’ শব্দটি। কেউ লিখেছেন, ‘মানুষ এত নৃশংস!’ আবার কেউবা লিখেছেন—‘মানুষ কেন মানুষ হয় না’। এসবই পাঠকের মন্তব্য। পাঠকের মন্তব্য যদি ঠিক হয়, তাহলে মানুষের হৃদয় তো ঘোড়ার ক্ষুরের চেয়েও শক্ত, অনমনীয়। নির্দয়। অথচ জানি, মানুষ মানবিক জীব। যে মানুষ ফুল দেখে মুগ্ধ হয়, সে মানুষ কি ঘোড়ার মতো নির্বাক প্রাণী হত্যা করতে পারে!
কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মনু মিয়া। তাঁর বয়স এখন ৬৭ বছর। তিনি কবরের কারিগর। দূরগাঁয়ে হয়তো কোথাও মাইকে বেজেছে মৃত্যু সংবাদ। অমনি তাঁর বুকে ধকধক শব্দ ওঠে। এই সংবাদ শুনেই খুন্তি, কোদালসহ প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘোড়ায় করে ছুটে যান কবরস্থানে। মানুষের অন্তিম যাত্রায় তিনি বাড়িয়ে দেন তাঁর আন্তরিকতার হাত। এভাবেই কবর খুঁড়ে যাচ্ছেন ৫০ বছর ধরে। এ জন্য নেন না কোনো পারিশ্রমিক। এভাবে নিঃস্বার্থ সেবার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। মনু মিয়ার ডায়েরির তথ্যানুযায়ী, এ পর্যন্ত তিনি কবর খুঁড়েছেন ৩ হাজার ৫৭টি।
নোবেলজয়ী মার্কিন লেখক জন স্টেইনবেক বলেছেন, ‘ঘোড়ায় আরোহী একজন মানুষ আধ্যাত্মিকভাবে, শারীরিকভাবেও, পায়ে হেঁটে চলা একজন মানুষের চেয়ে বড়।’ মনু মিয়া আর সব মানুষের চেয়ে হৃদয়ের দিক দিয়ে হয়তো সত্যিই বড় ছিলেন।
মনু মিয়া গরিব মানুষ। কিন্তু তাঁর ছিল সাধ্যের অতিরিক্ত সাধ; ছিল গরিবের ঘোড়া রোগ। কবর খুঁড়তে দূরের যাত্রায় দ্রুত পৌঁছাতে সারা জীবন আগলে রাখা নিজের ধানি জমি বিক্রি করে কয়েক বছর আগে একটি ঘোড়া কিনেছিলেন তিনি। ঘোড়াটি সচল রেখেছিল তাঁকে। গ্রামের গাড্ডা ভরা আলপথে ঘোড়ার পিঠে দুলতে দুলতে দ্রুত ছুটে যেতেন কবর খুঁড়তে। কাদা বা ধুলোমাখা পথে ঘোড়ার উন্মুখ চিঁহি, হ্রেষাধ্বনি শুনেই অন্য মানুষেরা বুঝতে পারতেন, এই গাঁয়ে বা দূরে কোথাও কারও মৃত্যু হয়েছে। সেই ঘোড়াটিকে কেউ মেরে ফেলতে পারে এটা কোনো দিন ভাবতে পারেননি মনু মিয়া ও তাঁর স্ত্রী রহিমা বেগম। ভাবতে পারছেন না গ্রামের অন্য মানুষেরাও।
জীবনভর কবর খোঁড়ার কাজ করতে গিয়ে নিজের দিকেই খেয়াল রাখতে পারেননি মনু মিয়া। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা জটিল রোগ। রোগে কাবু হয়ে সম্প্রতি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি। গত ১৪ মে তাঁকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই একরকম মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসা চলছে নিঃসন্তান মানুষটির। স্ত্রী রহিমা বেগম স্বামীর পাশে আছেন ছায়া হয়ে। বাড়িতে মনু মিয়া ও তাঁর স্ত্রী রহিমা বেগমের অনুপস্থিতিতে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে ঘোড়াটি। ১৬ মে সকালে পাশের মিঠামইন উপজেলার হাশিমপুর ছত্রিশ গ্রামের একটি মাদ্রাসার পাশে পানির মধ্যে ঘোড়াটির মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন এলাকাবাসী। ঘোড়াটির বুকে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মনু মিয়ার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার কথা ভেবে স্ত্রী ও স্বজনেরা তাঁর কাছে গোপন রেখেছেন ঘোড়াটি হত্যার কথা।
কোনো পাঠক লিখেছেন, এ দেশে মানুষের পাশাপাশি প্রাণীদের জীবনের নিরাপত্তা নেই। তাঁরা এই ঘোড়া হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার দাবি করেছেন। তাঁদের এ দাবি পূরণ হোক। নির্বাক প্রাণী বলে যেন কাউকে বলতে না হয়, নো ওয়ান কিলড দ্য হর্স।
মনু মিয়া জীবনে কারও কোনো ক্ষতি করেননি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। কোনো দিন ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার (মধ্যবর্তীকে অতিক্রম করে কাজ করা) মতো কাজও করেননি। মানুষ তাঁকে ভালোবাসে। তিনিও মানুষকে ভালোবাসেন। নিজের ছোট্ট ঘর পেরিয়ে পুরো গ্রাম, দূর গ্রামকেও ঘর ভাবতেন তিনি। তাইতো মৃত্যুর খবর পেলেই ছুটে যেতেন কবর খুঁড়তে। ভালোবাসার আড়ালে তাঁর এই বিশাল ঘরেই (গ্রামে) হত্যা করা হলো প্রিয় ঘোড়াটিকে। তাহলে তো বলা যায়, ঘরের শত্রু বিভীষণের মতো ঘোড়ার শত্রুও ভয়ংকর, বিভীষণ।
মনু মিয়ার ঘোড়া থাকলেও ঘোড়ার ডিমের (অস্তিত্বহীন অলীক বস্তু) ভাবনা ছিল না। তাঁর ভাবনা ছিল মানুষের জন্য কাজ করা, সেবা করা। নোবেলজয়ী মার্কিন লেখক জন স্টেইনবেক বলেছেন, ‘ঘোড়ায় আরোহী একজন মানুষ আধ্যাত্মিকভাবে, শারীরিকভাবেও, পায়ে হেঁটে চলা একজন মানুষের চেয়ে বড়।’ মনু মিয়া আর সব মানুষের চেয়ে হৃদয়ের দিক দিয়ে হয়তো সত্যিই বড় ছিলেন। নইলে তাঁর ঘোড়া হত্যা করা হবে কেন? মনু মিয়ার মুখোমুখি হওয়া মানে নিজের অপূর্ণতার মুখোমুখি হওয়া। এই ভয়ে হয়তো তাঁর ঘোড়াটিকে হত্যা করা হতে পারে।
নির্দয় মানুষের খুব কাছে হৃদয়বান মানুষেরাও থাকে। মনু মিয়ার ঘোড়া নিয়ে প্রথম আলোর ফেসবুক পেজের পোস্টে আসা মন্তব্য থেকে জানা গেছে, অনেকেই মনু মিয়াকে ঘোড়া কিনে দিতে চেয়েছেন। তার আগে মনু মিয়াকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। সুচিকিৎসায় ফিরে আসুক তিনি। তাহলে যে মানুষ ঘোড়ার খুনী আর যে মানুষ মানুষের মৃত্যু বেদনায় মুষড়ে পড়ে—তাঁদের পাশেই আবার দেখা যাবে মনু মিয়াকে। গ্রামের আলপথে আবারও ঘোড়া ছুটিয়ে যাবেন তিনি। ঘোড়ার সেই হ্রেষাধ্বনি আগের মতোই মুগ্ধ করবে সবাইকে।