গল্পগুলো আজও ভুলিনি, প্রিয় রকিব হাসান
তাঁর লেখা আগেও পড়েছিলাম। পরিচিতই ছিল নাম। কিন্তু বিশেষভাবে খেয়াল করেছিলাম সেদিনই প্রথম—ছাপার অক্ষরে নিজের নাম তখন দেখতে শুরু করেছি। আমার লেখা ছাপা হচ্ছিল। আর লিখতে হলে প্রচুর পড়তে হয়। এই দুটো কারণে ছোটদের ম্যাগাজিনগুলো প্রায়ই কিনে দিতেন আব্বু-আম্মু। ঈদসংখ্যাগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। এক অলস দুপুরে কিশোর তারকালোক–এর ঈদসংখ্যার পাতা ওলটাচ্ছিলাম। একটা ফিচার চোখে পড়ল। লেখকদের ছোটবেলার ঈদের স্মৃতি। সেই লেখাতেই প্রথম তাঁর একটা সাদা–কালো ছবি দেখি। চোখে চশমা, জ্ঞানী জ্ঞানী চেহারা। নিচে নাম লেখা—রকিব হাসান। আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করি তাঁর ছোটবেলার ঈদের স্মৃতি। বুঝতে পারি, লেখক শুরু থেকেই একজন অন্তর্মুখী মানুষ। ছোটবেলায় ঈদে বন্ধুদের বাসায় গিয়ে হইচই করার চেয়ে একা আনমনে ঘুরে বেড়াতেই পছন্দ করতেন তিনি। তেমনই কোনো এক ঈদে তিনি হাঁটছিলেন রেললাইনের পাশ দিয়ে। হঠাৎ দেখতে পেলেন এক মর্মান্তিক দৃশ্য। একটি শিশু ট্রেনে কাটা পড়েছে। তখনো তার পরনে নতুন জামা। হাতে আধখাওয়া বিস্কুট, বিস্কুটের গুঁড়া তখনো মুখে লেগে রয়েছে।
চোখ ছলছল করে উঠল ঘটনাটি পড়ে। বুঝতে পারলাম, লেখক প্রচণ্ড সংবেদনশীল একজন মানুষ। ছোটবেলার সেই কষ্টের স্মৃতি তিনি ভুলতে পারেননি। বড় হয়ে ভাগ করে নিয়েছেন পাঠকদের সঙ্গে।
ক্লাস সেভেনে থাকতে বইমেলায় গিয়েছিলাম। কিছু হরর বই কিনব বলে ‘সেবা প্রকাশনীর’ স্টলে গিয়েছিলাম। একটা বই পছন্দ হলো। আব্বু পাশ থেকে বললেন, ‘এটা নিবা নাকি? ভয়ংকর অসহায়?’ পাশে তাকিয়ে দেখি, আব্বুর হাতে একটা কালো রঙের বই ধরা। নাম ভয়ংকর অসহায়। প্রচ্ছদে একটা কুমিরের মতো মানুষ একটা বাক্সের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে। নিচে লেখকের নাম লেখা—রকিব হাসান। বইটা কিনলাম।
আমার পড়া ‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজের প্রথম বই ছিল ভয়ংকর অসহায়। বইটিতে কিশোর, মুসা, রবিন হাজির হয়েছিল অদ্ভুত এক শহরে। শহরটিতে কোনো স্বাভাবিক শিশুর জন্ম হয় না। প্রতিটি মানুষই বিকলাঙ্গ। কারও পুরো শরীরের চামড়া কুমিরের মতো, কারও আকৃতি দৈত্যের মতো হলেও সে বাক্শক্তিহীন। কেউ বাস করে যমজ ভাইয়ের পেটের ভেতর একটি পরজীবীর মতো। শারীরিক এসব সীমাবদ্ধতার পরও শহরটির মানুষগুলো বেঁচে ছিল আনন্দের সঙ্গেই। কেউই যেখানে স্বাভাবিক নয় সেখানে আসলে সবাই স্বাভাবিক। কারোরই তাই নিজের শরীর নিয়ে কোনো সংকোচ ছিল না। এমন একটি শহরে একের পর এক রহস্যজনক মৃত্যু ঘটতে থাকল। চিন্তায় পড়ল তিন গোয়েন্দা। সব কটি মৃতদেহের পেটেই ছিল বিশাল এক গর্ত। এই সূত্র ধরেই এগোতে হয়েছিল তাদের। তারা কি জেনেছিল অপরাধী আসলে কে? জানার পর কি তাকে ঘৃণা করতে পেরেছিল? নাকি নিজেরাও কেঁদেছিল তার অসহায়ত্ব দেখে? এটুকু জানতে বইটি পড়তে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। বইটি নিয়ে সেই সময় পাঠকদের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। কারও কারও মতে, এটি একটি বাজে বই। ‘তিন গোয়েন্দা’র মান অনুযায়ী হয়নি। কারও কারও কাছে ভয়ংকর অসহায় ছিল মর্মস্পর্শী এক গল্প। আমি দ্বিতীয় দলের পাঠক।
এর পর থেকে ‘তিন গোয়েন্দা’ পড়া হয়ে উঠল আমার অন্যতম প্রিয় শখ। কিনে হোক, ধার করে হোক, সময় পেলেই পড়তাম। দিন দিন ঢুকে যেতে লাগলাম ‘তিন গোয়েন্দা’র রহস্যময় জগতে। একে একে পড়লাম অনেকগুলো বই।
‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজের মায়াজাল আমার খুব প্রিয় বই। ‘চেইন লেটার’ নিয়ে নানা গল্প আমরা শুনেছি। একটি চিঠিতে সিরিয়াল ধরে অনেকগুলো নাম লেখা থাকে। একজন পাওয়ার পর পরেরজনকে চিঠিটি পাঠাতে হয়। এই গল্প এমনই একটি চিঠি নিয়ে। একজন পাওয়ার পর পরেরজনকে পাঠাতে হবে। কিন্তু তার আগে চিঠিতে লেখা অমানবিক একটি কাজ করতে হবে। না করলে? পরিণতি একটাই—কষ্টদায়ক মৃত্যু। শেষমেশ চিঠি এসে পৌঁছায় মুসার কাছে। সঙ্গে এমন এক কাজের নির্দেশ যা শুধু অমানুষের পক্ষেই করা সম্ভব। মুসা কি কাজটি করবে নাকি মৃত্যুকেই বেছে নেবে? বইটার পুরো গল্প আমাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল যে পড়া শেষ হওয়ার পরও আমি অনেক দিন গল্পটা থেকে বের হতে পারিনি। ভাবতাম, এই বইটা নিয়ে বাংলায় মুভি হলে চমৎকার হতো। বইটিতে কিশোর যে বিচক্ষণতার সঙ্গে তার বন্ধুদের সংকট থেকে উদ্ধার করেছিল তা পড়লে যে কেউ মুগ্ধ হবে। এমন বুদ্ধিমান একজনকে বন্ধু হিসেবে চাইবে যে কেউ।
রাত্রি ভয়ংকর আমার আরেকটি প্রিয় বই। হ্যালোইনে অনেকে ভূত সাজে। জোম্বির মতো ঘুরে বেড়ায়। তেমনই এক হ্যালোইন পার্টিতে দাওয়াত পায় তিন গোয়েন্দা। রাত যত গভীর হয়, পার্টি ততই জমে ওঠে। রহস্য-রোমাঞ্চ আর বন্ধুদের হাসি-আড্ডার হ্যালোইন পার্টি একসময় রূপ নেয় মূর্তিমান এক আতঙ্কে। পার্টি থেকে জীবন নিয়ে বেরিয়ে আসাই হয়ে ওঠে একমাত্র চ্যালেঞ্জ। পাতায় পাতায় সাসপেন্সে ভরা বইটি পড়ার পর মাথায় একটি প্রশ্ন থেকে যায়। যাদের সঙ্গে আমরা মিশি, তাদের সবাইকে কি আসলেই চিনি?
আরেকটি পছন্দের বই ছিল আরেক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্প তো আমরা অনেকেই জানি। একটি বৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্টের ভুল থেকে তার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু ‘তিন গোয়েন্দা’র ফ্রাঙ্কেনস্টাইন মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের চেয়ে আলাদা। মাত্র একটি ঘটনা জীবনকে আগাগোড়া বদলে দিতে যথেষ্ট। সেই সঙ্গে খুব ব্যক্তিগত কিছু অনুভূতি আর না পাওয়ার বেদনা কীভাবে একজন নিরীহ মানুষকেও ভয়ংকর অমানুষে পরিণত করতে পারে, বইটি মূলত সেটিই তুলে ধরে।
ভ্যাম্পায়ারের কাহিনি পড়তে ভালো লাগে? তাহলে সৈকতে সাবধান আর তার সিকুয়েল ভ্যাম্পায়ারের দ্বীপ তোমার পছন্দ হবেই হবে। সৈকতে সাবধান–এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র তিন গোয়েন্দার বন্ধু জিনা। সমুদ্রসৈকতে একের পর এক মৃত্যু আর দিন দিন জিনার অসুস্থ হয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে বইটিতে কিছু রহস্যের সূত্রপাত ঘটে। আর সেই রহস্যের সমাধান হয় ভ্যাম্পায়ারের দ্বীপ বইয়ে।
এগুলো ছাড়াও ‘তিন গোয়েন্দা’র আরও অসংখ্য বই ছিল আমাদের কিশোর বয়সের সঙ্গী। কিশোর, মুসা, রবিনকে আমরা বড়বেলায়ও ভুলতে পারি না। ‘তিন গোয়েন্দা’র কারণেই রকিব হাসান হয়ে উঠেছিলেন আমাদের অন্যতম প্রিয় লেখক। লেখক বেঁচে থাকেন তাঁর সৃষ্টিতে। আমার মতো আরও অনেকেই প্রিয় লেখককে খুঁজে ফিরবে কিশোরের বুদ্ধিদীপ্ত দুই চোখে, মুসার রসবোধে আর রবিনের চিন্তাশীলতায়। আজীবন।