যেভাবে নির্বাচিত হবেন নতুন পোপ

নতুন পোপ নির্বাচনের একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া আছে। অনেক ঐতিহ্য মেনে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। এসব নিয়মের বেশিরভাগই শত শত বছর ধরে মানা হচ্ছে। কী সেসব নিয়ম? কীভাবে নির্বাচিত হন একজন নতুন পোপ?

পোপ ফ্রান্সিসের মরদেহের সঙ্গে দেওয়া হয়েছে একটি জপমালাছবি: রয়টার্স

পোপ ফ্রান্সিস মারা গেছেন। ২১ এপ্রিল, সোমবার ভ্যাটিকান সিটি থেকে এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর এখন শুরু হবে নতুন পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়া। অনেক ঐতিহ্য মেনে এই প্রক্রিয়া শুরু হবে। এর মধ্যে বেশিরভাগ নিয়মই শত শত বছর ধরে একই রকম আছে। এই নিয়মগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন সবকিছু গোপন থাকে এবং শান্তিপূর্ণভাবে একজন নতুন পোপ নির্বাচিত হতে পারেন। পোপের মৃত্যুর পর থেকে নতুন পোপ নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়কালকে বলে ‘সেদে ভ্যাকান্তে’। মানে ‘শূন্য সিংহাসন’। এই সময়ে যা যা ঘটবে, তা-ই তুলে ধরছি এই লেখায়।

পোপের মৃত্যুর পর ভ্যাটিকান এখন কার দায়িত্বে?

পোপ মারা যাওয়ার পর প্রথমে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন ভ্যাটিকানের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান। তারপর পোপের মৃতদেহ সাদা পোশাকে ঢেকে নিয়ে যাওয়া হয় পোপের নিজস্ব চ্যাপেলে। এই সময় ভ্যাটিকানে দৈনন্দিন কাজের দায়িত্ব নেন রোমান চার্চের কার্ডিনাল চেম্বারলেইন। ইতালীয় ভাষায় একে বলে ক্যামেরলেঙ্গো। বর্তমানে এই দায়িত্বে আছেন কার্ডিনাল কেভিন জোসেফ ফ্যারেল। তিনি আইরিশ বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। ৭৭ বছর বয়সী এই কার্ডিনালকে ২০১৯ সালে নিযুক্ত করেন পোপ ফ্রান্সিস।

এরপর ক্যামেরলেঙ্গো এবং অন্য ভ্যাটিকান কর্মকর্তারা পোপের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। পোপের মৃতদেহ কাঠের তৈরি ও দস্তা দিয়ে মোড়ানো একটি কফিনে রাখা হয়। পোপকে পরানো হয় লাল রঙের পোশাক। আর পাশে রাখা হয় তাঁর ধর্মীয় টুপি ও পালিয়াম নামে বিশেষ পোশাক।

অনুষ্ঠান শেষে ক্যামেরলেঙ্গো একটি লিখিত প্রমাণপত্র তৈরি করেন। সেই প্রমাণপত্রে পোপের মৃত্যুর রিপোর্ট থাকে। তিনি পোপের ব্যক্তিগত কাগজপত্র সিল করে রাখেন এবং তাঁর বাসভবনের দরজা বন্ধ করে দেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি হলো পোপের ‘ফিশারম্যান’স রিং’ একটি ছোট হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলা। এই আংটি দিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ নথিতে সিল দিতেন। যাতে সেটি কেউ নকল করে ব্যবহার করতে না পারেন, তাই ভেঙে ফেলা হয়।

পোপের শেষকৃত্য কেমন হয়?

পোপ ফ্রান্সিস

পোপের দেহ কবে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় (ভ্যাটিকানের প্রধান গির্জা) নিয়ে যাওয়া হবে, তা ঠিক করেন কার্ডিনালরা। ভ্যাটিকান থেকে জানানো হয়েছে, ২৬ এপ্রিল, শনিবার সকালে শেষকৃত্য হতে পারে।

২০০৫ সালে যখন দ্বিতীয় পোপ জন পল মারা যান, তখন তাঁর দেহ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গির্জার উচ্চপদস্থ ধর্মীয় নেতাদের দেখানোর জন্য নেওয়া হয়েছিল। তার দুইদিন পর লাখ লাখ সাধারণ মানুষকে পোপের মৃতদেহ দেখানো হয়েছিল।

তবে ২০২৪ সালে পোপ ফ্রান্সিস তাঁর জীবদ্দশায় শেষকৃত্যের কিছু নিয়ম পরিবর্তন করেছিলেন। যেমন এখন আর অ্যাপোস্টলিক প্রাসাদে পোপের মৃতদেহ দেখার ব্যবস্থা থাকবে না। এখন থেকে রোমের বিভিন্ন গির্জায় নয়দিন ধরে শেষকৃত্যের আচার চলবে। তবে পোপের মৃত্যুর চার থেকে ছয় দিন পর তাকে সমাহিত করা হবে।

শেষকৃত্যের আগের রাতে কফিন বন্ধ করা হয়। পোপের মুখ সাদা সিল্কের কাপড় দিয়ে ঢাকা হয় এবং তাঁর সময়ে তৈরি করা মুদ্রা ভর্তি একটি ব্যাগ এবং তাঁর জীবন ও পোপত্বের সংক্ষিপ্ত বিবরণসহ একটি পাত্রসহ সমাহিত করা হয়। কফিন বন্ধ করার আগে রোজিতো পাঠ করা হয় (পোপের জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণী)।

পোপ ফ্রান্সিস ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, তাঁকে যেন সেন্ট মেরি মেজর ব্যাসিলিকায় সমাহিত করা হয়। এই গির্জাটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল এবং তিনি প্রায়ই ভার্জিন মেরির একটি আইকনের সামনে প্রার্থনা করার জন্য সেখানে যেতেন।

নতুন পোপ নির্বাচনের কাজ কবে শুরু হবে?

কার্ডিনালদের নেতৃত্বের ডিন, ৮৭ বছর বয়সী কার্ডিনাল জিওভান্নি বাতিস্তা রে সব কার্ডিনালকে রোমে কনক্লেভের জন্য ডাকেন। পোপের মৃত্যুর ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে কার্ডিনালরা সিস্টিন চ্যাপেলে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার জন্য মিলিত হন। ৮০ বছরের কম বয়সী কার্ডিনালরাই কেবল ভোট দিতে পারবেন। বর্তমানে ২৫২ জন কার্ডিনাল রয়েছেন। এরমধ্যে ১৩৮ জনই পোপ ফ্রান্সিস নির্বাচন করেছিলেন। সব কার্ডিনাল নির্বাচককে গোপনীয়তার শপথ নিতে হয়। নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হয়। নতুন পোপ নির্বাচনের এই প্রক্রিয়াকে বলে কনক্লেভ। কার্ডিনালরা একবার সিস্টেন চ্যাপেলে প্রবেশ করলে নতুন পোপ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত আর সেখান থেকে বের হতে পারবেন না। এই সময়ে যোগাযোগও করতে পারবেন না বাইরের কারও সঙ্গে। কনক্লেভ শব্দটির মানেই ‘চাবি দিয়ে বন্ধ’।

কীভাবে জানব যে নতুন পোপ নির্বাচিত হয়েছেন?

ভ্যাটিকানে নিজ বাসভবন কাসা সান্তা মার্তায় পোপ ফ্রান্সিসের মরদেহ রাখা হয়েছে
ছবি: রয়টার্স

কনক্লেভ চলাকালে প্রতিবার ভোট শেষ হওয়ার পরে সিস্টিন চ্যাপেলের চিমনি দিয়ে ধোঁয়া ছাড়া হয়। যদি ভোটে কেউ নির্বাচিত না হন, তাহলে কালো ধোঁয়া দেখা যায়। আর যদি নতুন পোপ নির্বাচিত হন, তাহলে বের হয় ধোঁয়া সাদা। এর আগেই অবশ্য নতুন নির্বাচিত পোপ এই দায়িত্ব গ্রহণ করবেন কি না, তা জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি সম্মতি দিলে নতুন পোপকে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি নতুন পোপ হিসেবে কোন নাম রাখতে চান। এরপর তাঁকে সাদা পোশাক ও লাল চাদর পরিয়ে দেওয়া হয়, এবং তিনি সব কার্ডিনালের সঙ্গে দেখা করেন। সবশেষে তিনি বেরিয়ে আসেন সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ব্যালকনিতে। আর একজন সিনিয়র কার্ডিনাল ঘোষণা করেন, ‘হাবেমুস পাপাম!’ মানে আমাদের একজন পোপ আছেন!

এভাবেই বিশ্বের কাছে চার্চের নতুন নেতাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়!

আরও পড়ুন