রাতের নিস্তব্ধ আকাশ হঠাৎ আলোয় ভরে উঠেছে। সুরের তালে তালে নাচতে শুরু করেছে শতাধিক ড্রোন। সেগুলো মিলে আকাশে তৈরি করেছে এক জীবন্ত ক্যানভাস! হ্যাঁ, এসব বিশেষণ ড্রোন শো নিয়েই।
এবার আমাদের নববর্ষের আয়োজনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে সংসদ ভবন এলাকার আকাশে ড্রোন লাইট শো। এরই মধ্যে প্রস্তুতির ছবিগুলো ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমো। নববর্ষের সন্ধ্যায় আলো ছড়াবে চীন থেকে আসা দলের ড্রোন লাইট শো।
গত কয়েক বছরে তুমি নিশ্চয়ই টিভি কিংবা ইউটিউব ড্রোন শো দেখেছ। কোম্পানির লোগো, পশুপাখির বা বিখ্যাত ব্যক্তিদের মুখের অবয়ব দেখে থাকবে হয়তো! কিন্তু কখনো কি ভেবেছ, এতগুলো ড্রোন একসঙ্গে এমন নিখুঁতভাবে কীভাবে কাজ করে? চলো এবার সেটাই জানা যাক।
ড্রোন লাইট শো কী?
ড্রোন লাইট শো মানে অনেকগুলো ছোট ড্রোন কম্পিউটারের সাহায্যে একসঙ্গে আকাশে ওড়ে এবং নানা ধরনের ছবি তৈরি করে। ড্রোনের সঙ্গে থাকে আলো। আর সেই আলোই আকাশে ফুটে ওঠে জীবন্ত ছবি। কম্পিউটারে আগে থেকেই নির্দেশ দেওয়া থাকে যে কোন ড্রোনটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। প্রতিটা ড্রোন নিজের নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দাড়ালেই পুরো দৃশ্যটা তৈরি হয়।
এই প্রযুক্তি কোথা থেকে এল?
আগে ড্রোন শো শুধু গবেষণাগারের পরীক্ষার বিষয় ছিল। কিন্তু এখন সারা বিশ্বের বড় বড় অনুষ্ঠানে এগুলো দেখানো হয়। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়ার একটা ভিডিওতে দেখা যায়, ছোট ছোট অনেকগুলো ড্রোনের সাহায্যে মজার মজার কসরত দেখাচ্ছিলেন একজন। সেটা সবাইকে বিস্মিত করে তোলে। এরপর ইউরোপের কিছু দল ও ইন্টেল কোম্পানি এই শোগুলোকে জনপ্রিয় করে তোলে। অলিম্পিক গেমসের মতো বিশ্বের বড় বড় সব ইভেন্টে দেখানো হয় ড্রোন শো।
ড্রোন শো কীভাবে কাজ করে?
এই ছোট ছোট ড্রোনগুলোকে টার্মিনেটর মুভির রোবটের মতো বুদ্ধিমান ভেবো না কিন্তু! এগুলো নিজে থেকে কিছুই করতে পারে না। এর পেছনের কলকাঠি নাড়েন কোনো মানুষ। সবকিছু আগেই কেউ ঠিক করে দেয়। সেই নির্দেশ অনুসারে এগুলো কাজ করে। প্রথমে ডিজাইনাররা ঠিক করেন যে শোতে কী কী ছবি বা দৃশ্য দেখানো হবে। তারপর বিশেষ সফটওয়্যারে প্রতিটা ড্রোনের ওড়ার পথ নির্ধারণ করা হয়। গানের ছন্দের সঙ্গে মিলিয়েও দৃশ্যগুলো সাজানো হয়। শোয়ের দিন একটা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে সব ড্রোনকে একসঙ্গে নির্দেশ দেওয়া হয়। ড্রোনগুলো যার যার জায়গায় পৌঁছে গেলেই তৈরি হয় সেই অসাধারণ দৃশ্য!
ড্রোন কি আতশবাজির জায়গা দখল করবে?
অনেকেই মনে করেন, ড্রোন শো একদিন বাজির জায়গা দখল করে নেবে। কারণ বাজি অনেক বেশি শব্দ করে, ধোঁয়া ছড়ায়, পশু-পাখিকে ভয় দেখায়। ফলে পরিবেশের ক্ষতি হয়। অনেক জায়গায় তো এখন বাজি ফোটানোই নিষিদ্ধ! কিন্তু ড্রোন শোতে এসব সমস্যা নেই। এগুলো শব্দহীন, দূষণহীন, আর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। শুধু তাই নয়, ড্রোন দিয়ে যে কল্পনা তৈরি করা যায়, তা বাজির পক্ষে সম্ভবই না। ভাবো তো, আকাশে যদি হঠাৎ সাকিব আল হাসান কিংবা একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ছবি ভেসে ওঠে, তাহলে কেমন হবে? তাই ভবিষ্যতে আতশবাজির জায়গাও দখল করতে পারে ড্রোন শো। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। সে ব্যাপারে আসছি একটু পরে।
অনেক বেশি ড্রোন শো দেখা যায় না কেন?
ড্রোন শো দেখতে খুব ভালো লাগলেও এটা আয়োজন করা অত সহজ নয়। একটা শো দেখাতে নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়। সেগুলো এখনো উন্নত হচ্ছে। আর নতুন কিছু আসতে তো একটু সময় লাগেই। ড্রোন শো এর ব্যাতিক্রম নয়। তাছাড়া এতে খরচ অনেক। ড্রোনগুলো ওড়ানোর জন্য চাই দক্ষ পাইলট। অনুমতি ও নিয়ম মেনে চলার ব্যাপার আছে। ভালো সফটওয়্যার ও নিরাপদ জায়গা লাগে। আর বিশেষ ধরনের ড্রোন তো লাগেই। এ সবকিছু মিলিয়ে এখনো বেশি ড্রোন শো দেখা যায় না।
একটা শো করতে কতগুলো ড্রোন লাগে?
চমৎকার একটা দৃশ্য তৈরি করতে যে হাজার খানেক ড্রোন লাগে, বিষয়টা তেমন নয়। অনেক সময় ৫০ বা ১০০ ড্রোন দিয়েই দুর্দান্ত কাজ করা যায়। আগে ড্রোনগুলো তেমন উজ্জ্বল ছিল না। তাই একটা ছবি আঁকতে অনেক ড্রোন লাগত। এখনকার ড্রোনগুলো অনেক শক্তিশালী ও সঠিকভাবে অবস্থান ধরে রাখতে পারে বলে কম ড্রোন দিয়েও কাজ চলে যায়। এখন পর্যন্ত ইন্টেল ২ হাজার ৬৬টা ড্রোন একসঙ্গে উড়িয়ে রেকর্ড করেছে।
একটা ড্রোন শোতে কত টাকা খরচ হয়?
খরচ মূলত নির্ভর করে কতগুলো ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর। ছোটখাটো শো করতে মানে যদি ৫০টা ড্রোন ব্যবহার করা হয়, তাহলে খরচ হয় প্রায় ২৫ লাখ টাকার মতো। আর বড় শো করলে মানে হাজার খানেক ড্রোন ব্যবহার করে শো করলে তো কোটি কোটি টাকা লাগবেই। আগে আমরা আলোচনা করেছি, আতশবাজি ড্রোনের জায়গা দখল করবে কি না? এখন প্রশ্ন হলো, এত টাকা খরচ করে কি আদৌ কেউ আতশবাজির পরিবর্তে ড্রোন শো করবে?
তবে ভবিষ্যতে প্রযুক্তি আরও উন্নতি হলে খরচ কমতে পারে। তখন সফটওয়্যার উন্নত হবে, দক্ষ মানুষের সংখ্যাও বাড়বে। ফলে খরচ কিছুটা হলেও কমবে। হয়তো তখন আরও বেশি বেশি ড্রোন শো দেখা যাবে!
সূত্র: ভার্জ অ্যারো ডটকম