মহাকাশে আটকে পড়ে ৯ মাস
মাত্র আট দিনের এক মিশনে গিয়ে প্রায় ৯ মাস মহাকাশে আটকে পড়েছিলেন দুই মার্কিন নভোচারী সুনিতা উইলিয়ামস ও ব্যারি উইলমোর। ১৮ মার্চ তাঁরা পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন। তাঁদের এই দীর্ঘ ৯ মাসের মহাকাশ ভ্রমণের কথাই থাকছে এই লেখায়।
পৃথিবী থেকে যাত্রা শুরু
২০২৪ সালের ৫ জুন। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল স্পেস ফোর্স স্টেশন থেকে মহাকাশের উদ্দেশে রওনা দেন ব্যারি উইলমোর ও সুনিতা উইলিয়ামস। তাঁরা মাত্র ৮ দিনের জন্য আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন গিয়েছিলেন। যাওয়া-আসাসহ মোট ১০ দিনের মিশন। মিশনের লক্ষ্য স্টারলাইনার নভোযানের পরীক্ষা চালানো। বিষয়টা বোঝার জন্য একটু বিস্তারিত বোঝা দরকার।
আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন নামে মহাকাশে একটা স্টেশন আছে। সেটি সব সময় পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। এই স্টেশনে সব সময় কিছু নভোচারী থেকে গবেষণা করেন। প্রতি ছয় মাস পরপর স্টেশন থেকে নভোচারীদের পরিবর্তন করা হয়। তবে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এই সময়সীমা কমবেশি হতে পারে। একদল পৃথিবী থেকে স্টেশনে যান এবং অন্য দল স্টেশন থেকে ফিরে আসেন পৃথিবীতে। আনা-নেওয়ার কাজটা যৌথভাবে পরিচালনা করে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ও ইলন মাস্কের মালিকানাধীন কোম্পানি স্পেসএক্স। নভোচারীরা একবার আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে গিয়ে ছয় মাস থাকেন। তারপর পৃথিবী থেকে নতুন নভোচারী স্টেশনে যান এবং স্টেশনে থাকা নভোচারীরা ফিরে আসেন পৃথিবীতে। নভোচারীদের এই আনা-নেওয়ার কাজটা করানো হয় স্পেসএক্সের তৈরি ক্রু ড্রাগন মহাকাশযানের সাহায্যে। কিন্তু ইলন মাস্কের কোম্পানি চাইছিল, নভোচারীদের এখন থেকে আনা-নেওয়ার কাজটা করবে বোয়িং স্টারলাইনার নভোযানের সাহায্যে।
ব্যারি উইলমোর ও সুনিতা উইলিয়ামস এই বোয়িং স্টারলাইনার নভোযানে চড়েই মহাকাশে গেছেন। মূলত তাঁদের মহাকাশে পাঠানো হয়েছে এটা পরীক্ষা করতে যে স্টারলাইনার ঠিকভাবে কাজ করছে কি না, নিরাপদে মহাকাশ স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য।
যাহোক, ৫ জুন পৃথিবী থেকে রওনা দিয়ে ৬ জুন তাঁরা মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছে যান। কিন্তু প্রথমবার চেষ্টা করেও মহাকাশ স্টেশনের সঙ্গে নভোযানটি যুক্ত হতে পারেনি। কারণ, স্টারলাইনার নভোযানের থ্রাস্টারে সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় মহাকাশ স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
রতে কেন দেরি হলো
স্টারলাইনার নভোযানের প্রপালশন সিস্টেমে সমস্যা দেখা দেওয়ায় নাসা ও বোয়িং সেটি পরীক্ষা ও মেরামত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে পরে নাসা নভোচারীদের ফেরানোর পরিকল্পনা বদলে ফেলে এবং স্পেসএক্সের ক্রু ড্রাগন ক্যাপসুলে তাঁদের ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রপালশন সিস্টেমের সমস্যাটা কী?
আসলে স্টারলাইনারের প্রপালশন সিস্টেম ছিদ্র হয়ে হিলিয়াম গ্যাস বেরিয়ে যাচ্ছিল। এই গ্যাস বেরিয়ে গেলে পৃথিবীতে ফিরতে পারত না নভোযানটি। কারণ, পৃথিবীতে ঢোকার জন্য হিলিয়াম গ্যাস ব্যবহার করে নভোযানে ধাক্কা দিতে হয়। গ্যাস বেরিয়ে গেলে আর ধাক্কা দেবে কীভাবে?
এটি তাঁদের প্রথম মহাকাশভ্রমণ ছিল না। এর আগে আরও দুবার করে মহাকাশভ্রমণে গিয়েছিলেন দুজনই। তিনবার মিলিয়ে সুনিতা মোট ৬০৮ দিন ও উইলমোর ৪৬৪ দিন মহাকাশে কাটিয়েছেন।
সে জন্য দুই নভোচারীকে মহাকাশ স্টেশনে আরও কিছুদিন রাখার সিদ্ধন্ত নিল নাসা ও স্পেসএক্স। এই সময়ের মধ্যে স্টারলাইনার নভোযান ঠিক করা হবে। এতে ১০ দিনের যাত্রার নতুন সময়সীমা ঠিক হলো ৪৫ দিন, মানে দেড় মাস। কিন্তু যে নভোযানে সমস্যা হয়েছে, সেই নভোযানেই আবার নভোচারীদের পৃথিবীতে ফেরাতে ভরসা পেল না নাসা। তাই নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, স্টারলাইনার নভোযান নভোচারীদের ছাড়াই পৃথিবীতে ফিরে আসবে। আর সুনিতা ও ব্যারি পৃথিবীতে ফিরবেন স্পেসএক্সের ক্রু ড্রাগন ক্যাপসুলে। অর্থাৎ যে নভোযানে মহাকাশ স্টেশনের যাত্রীদের আনা-নেওয়া করা হয়।
৭ সেপ্টেম্বর স্টারলাইনার খালি সিট নিয়ে ফিরে এল পৃথিবীতে। ২২ সেপ্টেম্বর সুনিতা উইলিয়ামস আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওই দিন রুশ নভোচারী ওলেগ কোনোনেনকো পৃথিবীতে তাঁর আরও দুই সহকর্মী নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। তবে সুনিতা ও ব্যারি তখনো মহাকাশে ছিলেন।
এখন ভাবতে পারো, ওই সময় কেন সুনিতা ও ব্যারি ফিরে এলেন না। কারণ, সুনিতাদের পৃথিবীতে ফেরানোর জন্য ক্রু-৯ মিশন রেডি করা হয়েছিল। ক্রু-৯ মিশনে মহাকাশে যাওয়ার কথা ছিল চার নভোচারীর। কিন্তু সেখানে পাঠানো হয় দুজনকে। আর বাকি দুটি সিট ফাঁকা রাখা হয় সুনিতা ও ব্যারির জন্য।
এই নভোযান চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পৃথিবীতে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু ক্রু-১০ মিশনের দেরির জন্য তখন তাঁরা ফিরতে পারেননি। কারণ, ক্রু-১০ মিশনের নভোচারীরা মহাকাশ স্টেশনে না পৌঁছালে তাঁরা ফিরতে পারবেন না। যেহেতু আবহাওয়ার সমস্যার কারণে ক্রু-১০ মিশন মহাকাশে যেতে দেরি হয়, তাই আবার পিছিয়ে যায় সুনিতাদের ফেরা। নানা জটিলতা কাটিয়ে ১৪ মার্চ উৎক্ষেপণ করা হয় ক্রু-১০ মিশন। সেটি মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছানোর পরই পৃথিবীতে ফেরেন সুনিতারা।
৯ মাস মহাকাশে তাঁর কী করেছেন
মহাকাশে ৯ মাস আটকে থাকলেও শুধু শুয়েবসে কাটাননি এই দুই নভোচারী। তাঁরা মহাকাশযানের যন্ত্রপাতি পরীক্ষাসহ নানা বিষয়ে গবেষণা করেছেন। প্রায় ৯০০ ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। পাশাপাশি মহাকাশে হেঁটেছেন (স্পেসওয়াক) অনেক সময়। সুনিতা উইলিয়ামস তো মহাকাশে হাঁটার বিশ্ব রেকর্ড করেছেন। নারী নভোচারীদের মধ্যে তিনিই সর্বোচ্চ মোট ৬২ ঘণ্টা ৬ মিনিট মহাকাশে হেঁটেছেন। তবে নারী-পুরুষ মিলিয়ে এই রেকর্ড চতুর্থ।
সুনিতা উইলিয়ামস ও ব্যারি উইলমোর মহাকাশে কাটিয়েছেন ২৮৬ দিন। এই সময়ের মধ্যে ১২ কোটি ১৩ লাখ ৪৭ হাজার ৪৯১ মাইল ভ্রমণ করেছেন তাঁরা। আর পৃথিবীর চারপাশে ঘুরেছেন ৪ হাজার ৫৭৬ বার।
এটি তাঁদের প্রথম মহাকাশভ্রমণ ছিল না। এর আগে আরও দুবার করে মহাকাশভ্রমণে গিয়েছিলেন দুজনই। তিনবার মিলিয়ে সুনিতা মোট ৬০৮ দিন ও উইলমোর ৪৬৪ দিন মহাকাশে কাটিয়েছেন।
পৃথিবীতে ফিরে কী করবেন তাঁরা
দীর্ঘ সময় মহাকাশে থাকার ফলে শরীরে অনেক পরিবর্তন আসে। তাই পৃথিবীতে ফিরে আসার পর তাঁদের শরীরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। মহাকাশে দীর্ঘদিন থাকলে মানুষের হাড় ও পেশি দুর্বল হয়ে যায়, রক্ত সঞ্চালনে পরিবর্তন আসে, এমনকি দৃষ্টিশক্তিতেও প্রভাব পড়তে পারে। এ জন্য ব্যারি ও সুনিতাকে বিশেষ ব্যায়ামের মাধ্যমে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হবে। তবে মহাকাশে থাকা অবস্থায়ও তাঁরা যেহেতু নিয়মিত ব্যায়াম করেছেন, তাই খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
ব্যারি ও সুনিতার এই দীর্ঘ অনাকাঙ্ক্ষিত মহাকাশযাত্রা দেখিয়েছে, মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জ যেকোনো সময় আসতে পারে। তবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই মানুষ মহাকাশ অভিযানে এগিয়ে চলেছেন। তাঁদের এই ফিরে আসা ভবিষ্যতের মহাকাশ মিশনগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হয়ে থাকবে।
মহাকাশে থাকলে দেহের কী পরবর্তন হয়
মহাকাশে দীর্ঘদিন কাটালে শরীরে নানা পরিবর্তন আসে। সেগুলো কাটিয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে অনেক বছর লেগে যেতে পারে। তবে মহাকাশে প্রথম দিকে শরীরের পরিবর্তনগুলো বেশ আনন্দদায়ক মনে হতে পারে। প্রথম দিকে মনে হয় যেন ছুটি কাটাচ্ছি। হৃৎপিণ্ড কম পরিশ্রম করছে, পেশি ও হাড়ের ওপর চাপ নেই, আর পুরো শরীর একদম হালকা হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে! যেন দিনের পর দিন বিছানায় শুয়ে আছ।
মহাকাশে শরীর ধীরে ধীরে পেশির শক্তি হারাতে থাকে। ব্যবহার না করলে যেকোনো জিনিস যেমন নষ্ট হয়ে যায়, পেশির জন্য এ কথাটা একদম সত্যি। মহাকাশে থাকার সময় নভোচারীরা প্রতিদিন দুই ঘণ্টা ব্যায়াম করেন, যাতে তাঁদের শরীর স্বাভাবিক থাকে। ব্যায়ামের মধ্যে থাকে ট্রেডমিল, সাইক্লিং আর ওজন তোলার মতো কার্যক্রম। তবু পৃথিবীতে ফিরে আসার পর তাঁদের পেশিশক্তি পুরোপুরি ফিট হতে কয়েক মাস লেগে যায়।
শুধু পেশিই নয়, হাড় এবং হৃৎপিণ্ডও দুর্বল হয়ে যায়। মাধ্যাকর্ষণ না থাকলে হাড়ের ওপর চাপ পড়ে না। ফলে হাড় ধীরে ধীরে ভঙ্গুর ও দুর্বল হয়ে পড়ে।
তবে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, পৃথিবীতে ফিরে আসার পর হাড় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে বছরের পর বছর লেগে যায়। অনেকের শরীর পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ও না। হৃৎপিণ্ডের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। পৃথিবীতে আমাদের হৃৎপিণ্ডকে রক্ত মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে টেনে তুলতে হয়। কিন্তু মহাকাশে সেই পরিশ্রম করতে হয় না, ফলে হৃৎপিণ্ডও দুর্বল হয়ে পড়ে।
এ ছাড়া মহাকাশে শরীরের তরল পদার্থ ওপরের দিকে উঠে যায়। ফলে মুখ ফোলা ফোলা দেখায়। কিন্তু এর চেয়েও ভয়ংকর হলো, মস্তিষ্কে চাপ বেড়ে যায়। বদলে যায় চোখের গঠন। এমনকি দৃষ্টিশক্তিও দুর্বল হয়ে যেতে পারে! মাঝেমধ্যে দেহের এই পরিবর্তন স্থায়ী হয়ে যেতে পারে। নভোচারীদের জন্য এটা বড় চ্যালেঞ্জ। নভোচারীরা যখন পৃথিবীতে ফেরেন, তখন শুধু বাহ্যিক পরিবর্তন নয়, দেহের ভেতরেও পরিবর্তন দেখা যায়। শরীরের ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলো বদলে যায়। ফলে নষ্ট হয়ে যায় ভারসাম্য রক্ষা করার ক্ষমতা।
তাহলে সুনিতা উইলিয়ামস ও ব্যারি উইলমোরের জন্য কী অপেক্ষা করছে? তাঁরা আপাতত এখন বিশ্রামে আছেন। কিন্তু তাঁদের সামনে রয়েছে কঠোর পুনর্বাসনপ্রক্রিয়া। তাঁদের পেশিশক্তি ঠিক হতে কয়েক মাস লেগে যাবে। হাড়ের ঘনত্ব আগের অবস্থায় ফিরতেও সময় লাগবে। এমনকি দেহের কিছু পরিবর্তন কখনোই আগের অবস্থায় ফিরবে না!
সূত্র: স্পেস ডটকম, লাইভ সায়েন্স ও বিবিসি