ড্রাগনের ধারণা এল কোথা থেকে
একটি প্রাণী আছে, যেটি মুখ দিয়ে আগুন বের করে। প্রাণীটি আবার আকাশের ওড়ে! সবার মনে ভয় ধরায়! প্রাণীটির নাম ড্রাগন।
আকাশে উড়তে থাকা ও মুখ দিয়ে আগুন বের করা ড্রাগন বিশ্বের এক কাল্পনিক প্রাণী। যাকে লোককথা বা ফোকলোরে পাওয়া যেতো বলে এক সময় বিশ্বাস করা হতো। কিন্তু এখন আমরা জানি পৃথিবীতে ড্রাগন বলে সত্যি একটা প্রাণী আছে।
বিশ্বের অনেক দেশে ড্রাগনের কাহিনি শোনা যায়, যার বয়স হাজার হাজার বছর পুরোনো, যদিও সব ড্রাগনের চরিত্র কিন্তু এক নয়।
প্রাচীন ব্যাবিলন, মিশর ও ইউরোপে যে সব ড্রাগনের ছবি ও গল্প পাওয়া যায় সেগুলো চীন,জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ড্রাগনের চেয়ে আলাদা ।
কোথা থেকে এল এই ড্রাগন
ইংরেজি ড্রাগন শব্দটি এসেছে ফ্রেঞ্চ ভাষা থেকে, যেটি আবার এসেছে প্রাচীন গ্রিক থেকে ল্যাটিন ভাষার মাধ্যমে। গ্রিক ভাষায় ড্রাগন মানে সাপের মত দেখতে প্রাণী।
প্রাচীন সিরিয়ার উগার্টি নামের মিথ বা কল্প কাহিনীতে লাটানু নামের এক ধরনের প্রাণীর দেখা মেলে। এই প্রাণীটি অবশ্য মাটিতে বা আকাশে নয়, সমুদ্রে বাস করতো। এই ড্রাগনের ছিল সাতটি মাথা। হিব্রু বাইবেলেও লেভিয়াথন নামের যে প্রাণীটিকে দেখা যায় সেটি সমুদ্রের দৈত্য ওরফে সমুদ্রের ড্রাগন।
প্রাচীন ইরাক, মিশর, গ্রিক ও ইউরোপের সব গল্প কাহিনীতে একটা মিল আছে, আর সেটা হচ্ছে ড্রাগন মানে এক ভয়ংকর এক প্রাণী। এই সব অঞ্চলে ড্রাগনকে হত্যা করে অনেকে বীর হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে সে সব দেশের রূপকথার কাহিনীতে।
পূর্ব এশিয়ার ড্রাগন
মিশর, গ্রিক বা ইউরোপে ড্রাগনকে ভয়ের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। আর পূর্ব এশিয়া বা প্রাচ্যে মানে চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এই সব দেশে ড্রাগনকে ঠিক উলটো ভাবে দেখা হয়। এই অঞ্চলে ড্রাগন হচ্ছে ভক্তি ও শক্তির প্রতীক।
যদিও কল্পনার প্রাণীটির ইংরেজি নাম ড্রাগন, কিন্তু পূর্ব এশিয়ায় দেশ ভেদে এর ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। চীনে এর নাম লং, জাপানে এর নাম পিনইন, আবার ইকুচি হচ্ছে ইয়োকাই ড্রাগন, এছাড়াও আছে ড্রাগন দেবতা রিয়ু, রিইয়ুজুন। কোরিয়াকে একে ইউইয়িজু বলে ডাকা হয়। ভিয়েতনামে এই প্রাণীটির নাম রং। আর ইন্দোনেশিয়া এর নাম নাগা বা নগ।
এই অঞ্চলের বেশির ভাগ ড্রাগনের নামের উৎপত্তির সাথে বজ্রপাত বা বিদ্যুতের একটা যোগসূত্র আছে। আবার এই অঞ্চলের রাজাদের অনেকেই এই প্রাণীটিকে নিজেদের পূর্ব পুরুষ হিসেবে দাবি করে।
চীনের ড্রাগন
চীনের সংস্কৃতিতে ড্রাগন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। চীন দেশের ড্রাগন বৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। চীনা প্রবাদে আছে, ড্রাগন ময়লা ও বাঘকে পছন্দ করে না। তাই এদের তাড়ানোর জন্য সে বৃষ্টি নিয়ে আসে।
চীনে বসন্ত উৎসব ও লন্ঠন উৎসবের সময় দেশটির নাগরিকেরা ঘাস, বাঁশ, কাপড়, কাগজ ইত্যাদি দিয়ে প্রায় ১৬ ফুটের মত লম্বা ড্রাগন বানিয়ে সারা এলাকা জুড়ে ড্রাগন নাচের আয়োজন করে। এই নাচের উদ্দেশ্যে ড্রাগনকে খুশি করা। তাতে আবহাওয়া ভালো থাকবে আর ফসল বেশি হবে।
চীনারা বছরের পর বছর ড্রাগনকে ভক্তি করত। আর চীনা রাজারা ড্রাগনকে তাদের প্রতীক হিসেবে দেখতেন। চাইনিজ প্রবাদে আছে যখন ড্রাগন পানিতে থাকে তখন সে পাঁচটি রঙে নিজেকে ঢেকে রাখে।
চীনে ড্রাগন হচ্ছে পরিবর্তনের প্রতীক। মানে সে তার রূপ বদলে ফেলতে পারে। সে নিজেকে পানিতে রূপান্তরিত করতে পারে। সে আবার নিজের চেহারাকে আগুনের বানিয়ে ফেলতে পারে।
ছবিতে আমরা চীনা যে ড্রাগনের চেহারা দেখি তা অনেকটা সাপের মতো । তবে তার আবার থাবা আছে। আর দেহের শেষে তিমি মাছের মতো একটা লেজ আছে। তার মাথায় হরিণের শিংয়ের মত শিং আছে। তার মুখটা দেখতে অনেকটা উটের মতো । তার কানগুলো দেখতে ষাঁড়ের মতো । তার পা বাঘের মতো আর চোখ গুলো চিংড়ি মাছের মতো। আর এই ড্রাগনের বাদুড়ের মতো পাখা আছে । এই পাখা দিয়ে সে উড়ে যায়। আর মুখ দিয়ে সে আগুন ছুড়ে মারে।
অনেক সময় একটা ড্রাগনের চিবুকে একটা মুক্তো থাকে। তার এই চিবুকের মানে হলো সে চাইলে যে কোন ইচ্ছে পূরণ করতে পারে। এছাড়াও চীনের গল্প অনুসারে ড্রাগনেরা চাদের কলা-বৃদ্ধি , সমুদ্রের ঢেউ , বৃষ্টি, বজ্র ঝড়, জন্ম মৃত্যু এ সব কিছুর জন্য দায়ী।
অনেক সময় অনেক ড্রাগনের মুক্তো তার কাছে থেকে পড়ে যায় । তখন মুক্তোর চারপাশ জ্বলে উঠে। এই কারণে অনেক সময় অন্ধকারেও ড্রাগনরা জ্বলজ্বল করে।
ড্রাগনের একটা পুরুষ চেহারা রয়েছে যা ইয়াং বলে ডাকা হয়। এরা বৃষ্টি নামিয়ে আনে। কোন কোন ড্রাগনের মাথায় শিং থাকে না। তাদের বলা হয় মেয়ে ড্রাগন। এদের নাম জিওইয়াও।
একসময় চীনে উইয়ুইয়ে নামের এক রাজা বাস করতো। তাকে সবাই ড্রাগন কিং বলেই ডাকতো।
তবে প্রবাদে চার রকমের ড্রাগন কিং রয়েছে। চীনে অনেক মন্দির ড্রাগনের নামে তৈরি হয়েছিল । যখন চীন দেশে বন্যা বা বৃষ্টি হতো তখন সবাই ড্রাগনের কাছে প্রার্থনা করতো।
পাওয়া গেলো সত্যিকারের ড্রাগন
যদিও সারা বিশ্বে ড্রাগনের গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। কিন্তু রূপকথার এই প্রাণীটিকে কেউ বাস্তবে এনে হাজির করতে পারেনি।
তবে ইন্দোনেশিয়ার এক দ্বীপে এক ধরনের প্রাণীর কথা ইন্দোনেশিয়ার অনেক জেলের মুখে মুখে ফিরত।
যে সমস্ত জেলের হয়তো ঝড়ে সেই নির্জন দ্বীপে আটকা পড়ে গেলে দেখতে পেত একটা লম্বা প্রাণী লকলকে জিভ নিয়ে তাদের তাড়া করত।
ইন্দোনেশীয় তখন ছিল ডাচ ওরফে নেদারল্যান্ডের এক উপনিবেশ। ১৯১০ সালে একজন ডাচ লেফটেনেন্ট ভ্যান স্টেইন ভ্যান হেন্সব্রোক কমোডোর দ্বীপে হানা দেন। তিনি লোকমুখে শুনেছিলেন এই দ্বীপে নাকি মাটিতে বাস করে এমন কুমির পাওয়া যায়।
তিনি সেই দ্বীপে আবিষ্কার করেন, আরে এ কুমির কোথায়? এটা এমন একটা প্রাণী যাকে এতদিন রূপকথায় পাওয়া যেত।
তিনি শুধু নিজ চোখে দেখেননি, সেই সাথে এর ছবি ও ড্রাগন মেরে তার চামড়া নিয়ে জাভার বোগোর দ্বীপের জুওলজিকাল মিউজিমায়ের ডিরেক্টর পিটার ওয়েন্সকে। এরপর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে কমোডোর দ্বীপের ড্রাগনের কথা।