৫৬ বছর আগে কীভাবে মানুষ প্রথম চাঁদে গিয়েছিল
১৯৬৯ সালে মার্কিন নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদের মাটিতে পা রাখেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সে যাত্রা সহজ ছিল না। নানা বাঁধা পেরিয়ে কীভাবে সে যাত্রায় সফল হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র?
ছোট্ট বন্ধুরা, মাথার ওপরে যে চাঁদটা দেখে তোমরা অবাক হও, সেটা কত বড় জানো? ওটা দূর থেকে দেখতে ছোট মনে হলেও বাস্তবে বেশ বড়। এত বড় যে মানুষ ওখানে গিয়ে ঘুরে এসেছে। হেঁটেছে ওই চাঁদের মাটিতে। একবার নয়, দুইবার নয়, টানা ছয় বার। প্রথম যেবার মানুষ গিয়েছিল, সেটা আজকের এই দিনে। মানে ২০ জুলাই। আজ থেকে ৫৬ বছর আগে, ১৯৬৯ সালে। কীভাবে মানুষ চাঁদে পৌঁছাল, জানতে চাও? চলো জানার চেষ্টা করি।
চাঁদে যাওয়ার প্রতিযোগিতা যেভাবে শুরু হলো
চাঁদে যাওয়া নিয়ে একটা মজার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। কে আগে চাঁদে যাবে? এই প্রতিযোগিতা কিন্তু গুটিকতক মানুষের মধ্যে নয়, দুটি দেশের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়ন। বর্তমানে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে হয়েছে রাশিয়া ও অন্যান্য দেশ। সে জন্য ১৯৫৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র একটা সংস্থা তৈরি করে। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। সেই সংস্থাকে এখন আমরা সংক্ষেপে নাসা নামে চিনি। ঠিক ওই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে কোনো একক মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ছিল না। সরকারি কিছু সংস্থা সেগুলো পরিচালনা করত। অনেক পরে ১৯৯২ সালে রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা হয়। নাম রাখা হয় রসকসমস। ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়েছে। রাশিয়া দেশটি পরিচিতি পেয়েছে।
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশ গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছুটা এগিয়ে ছিল। ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউরি গ্যাগারিনকে প্রথম মানুষ হিসেবে পৃথিবীর বাইরে প্রদক্ষিণ করতে পাঠায়। তিনি সফলভাবে ফিরে আসেন পৃথিবীতে। এই ঘটনায় সোভিয়েতরা এগিয়ে গেলেও পিছিয়ে পড়ছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাই একই বছর ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি ঘোষণা করেন, ১৯৭০ সালের মধ্যে আমেরিকা চাঁদে মানুষ পাঠাবে! সেই ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই মানুষ প্রথম চাঁদে পা রাখে।
তবে মুখে বললেই তো আর চাঁদে যাওয়া যায় না। সে জন্য দরকার অনেক কিছু। কীভাবে সেগুলো প্রস্তুত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র?
চাঁদে যাওয়ার প্রস্তুতি
মানুষ প্রথম চাঁদে যায় অ্যাপোলো ১১ মিশনে। নামটা খেয়াল করো। অ্যাপোলো ১১। অর্থাৎ, এর আগেও অ্যাপোলো প্রোগ্রামে আরও ১০টি মিশন হয়েছিল। শুধু তাই নয়, অ্যাপোলোর আগে শুরু হয়েছিল ‘মার্কারি প্রোগ্রাম’। এটা ছিল ছোট পরিকল্পনা। এরপর এল ‘জেমিনি প্রোগ্রাম’। সেগুলো কিন্তু সব ব্যর্থ হয়নি। একটু একটু করে সেসব মিশনে মানুষ শিখেছে, কীভাবে মহাকাশে থাকতে করতে হয়। যেমন, জেমিনি প্রোগ্রামে মানুষ ১০ বার মহাকাশে গিয়েছে। তখন শিখেছে কীভাবে বাঁচতে হয়, কাজ করতে হয়, খেতে হয়।
এসব শেখার পরই এসেছিল অ্যাপোলো প্রোগ্রাম। তবে এই প্রোগ্রামের প্রথম মিশন মানে অ্যাপোলো ১ মিশনে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। এই মিশন পরীক্ষার সময় আগুন লেগে ৩ জন নভোচারী মারা যান। তাই অ্যাপোলো ২-৬ মিশনে আর মানুষ না পাঠিয়ে নভোযানের বিভিন্ন অংশ পরীক্ষা করা হয়। এরপর ১৯৬৮ সালে ‘অ্যাপোলো ৭’ মিশনে মানুষ সফলভাবে মহাকাশে পৌঁছায়। এটা ছিল মানুষ নিয়ে অ্যাপোলো প্রোগ্রামের প্রথম সফল যাত্রা।
এরপর আসে ‘অ্যাপোলো ৮’ মিশন। এই মিশনে মানুষ প্রথমবার চাঁদের কাছে গিয়ে আবার ফিরে আসে। তাঁরা শুধু চাঁদের চারপাশ ঘুরে এসেছিল। তারপর ‘অ্যাপোলো ৯’ মিশনে নভোযান পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে চাঁদে নামার জন্য তৈরি মহাকাশযানের একটি অংশ পরীক্ষা করে। আর ‘অ্যাপোলো ১০’ মিশনে মানুষ দ্বিতীয়বার চাঁদের চারপাশে ঘুরে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। সবশেষ ‘অ্যাপোলো ১১’ মিশনে মানুষ প্রথম চাঁদে নামে। এই জয় শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ছিল না, ছিল সমগ্র মানবজাতির।
কীভাবে মানুষ প্রথমবার চাঁদে নেমেছিল
আগেই বলেছি, ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই মানুষ প্রথমবার চাঁদে নামে। কিন্তু এই যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৬ জুলাই। ‘অ্যাপোলো ১১’ নামের বিশাল রকেটটা ফ্লোরিডার কেপ কেনেডি (বর্তমান নাম কেপ ক্যানাভেরাল) থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। এই রকেটে ছিলেন তিনজন সাহসী নভোচারী–নীল আর্মস্ট্রং, বাজ অলড্রিন এবং মাইকেল কলিন্স।
চার দিন পর, অর্থাৎ ২০ জুলাই নীল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন ‘লুনার মডিউল ঈগল’ নামের একটি ছোট্ট মহাকাশযানে করে চাঁদের মাটিতে নেমে এলেন! মাইকেল কলিন্স কিন্তু তাঁদের সঙ্গে চাঁদে নামেননি। তিনি বড় মহাকাশযানটিতে (কমান্ড মডিউল) বসে চাঁদের চারপাশে উড়ছিলেন, যাতে ফেরার সময় বাকি দুজনকে নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারেন।
আর্মস্ট্রং আর অলড্রিন চাঁদের ‘সি অব ট্র্যাঙ্কুইলিটি’ নামে একটা জায়গায় নেমেছিলেন। এই জায়গাটা চাঁদের অন্য জায়গা থেকে একটু সমতল ছিল। চাঁদে পা রেখেই নীল আর্মস্ট্রং খুব বিখ্যাত একটা কথা বলেছিলেন, ‘এটা মানুষের জন্য একটা ছোট্ট পদক্ষেপ, কিন্তু মানবজাতির জন্য এক বিশাল লাফ!’
আর্মস্ট্রং আর অলড্রিন চাঁদের মাটিতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা হেঁটেছিলেন। তারপর তাঁরা আবার মাইকেল কলিন্সের সঙ্গে মূল মহাকাশযানে যোগ দেন। সব কাজ শেষে তাঁরা নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। ১৯৬৯ সালের ২৪শে জুলাই প্রশান্ত মহাসাগরে হাওয়াইয়ের কাছে তাঁরা নেমেছিলেন।
সেই থেকে শুরু, চলছে আজও
এরপর মানুষ আরও পাঁচবার চাঁদে গিয়েছে। মোট ৬টি মিশনে মোট ১২ জন পুরুষ চাঁদে হেঁটেছেন। ১৯৭২ সালে ‘অ্যাপোলো ১৭’ মিশনে মানুষ শেষবার চাঁদে যায়। এরপর ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আর কোনো দেশের কোনো মানুষ চাঁদে পা রাখেনি। তবে ২০১৭ সালে নাসা আবার একটি নতুন পরিকল্পনা শুরু করে। এর নাম আর্টেমিস প্রোগ্রাম। ইতিমধ্যে আর্টেমিস ১ মিশন সফলভাবে সম্পন্ন করেছে নাসা। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘আর্টেমিস ২’ মিশন পরিচালনা করার কথা রয়েছে। আর ২০২৭ সালে আর্টেমিস ৩ মিশনে মানুষ আবার চাঁদে যাবে। সেই মিশনে প্রথমবারের মতো চাঁদে যেতে পারেন একজন নারীও!
সূত্র: নাসা, ইসা ও দ্য উইক জুনিয়র