মঙ্গল গ্রহের দুটি চাঁদ কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে
১৮৭৭ সাল। এক গ্রীষ্মের রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বসে আকাশ পর্যবেক্ষণ করছিলেন জ্যোতির্বিদ আসাফ হল। তখন মঙ্গল গ্রহ পৃথিবীর খুব কাছে এসেছিল। টেলিস্কোপে আকাশ দেখতে দেখতে তাঁর মনে একটা প্রশ্ন এল। লাল গ্রহটির কোনো চাঁদ বা উপগ্রহ আছে?
প্রশ্নটা মাথায় গেঁথে ছিল হলের। টানা কয়েক রাত ঘনকুয়াশার মধ্যে বসে তিনি মঙ্গল গ্রহের চাঁদ খুঁজলেন। তারপর অবাক হয়ে দেখলেন, একটা নয়, লাল গ্রহটির রয়েছে দুটি চাঁদ। তিনি এদের নাম দিলেন ফোবোস আর ডিমোস। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী, এরা হলো যুদ্ধের দেবতা অ্যারিস আর প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির দুই যমজ সন্তান। এরাও ভয় ও আতঙ্কের দেবতা।
তবে হলের আবিষ্কৃত চাঁদ দুটি আমাদের চাঁদের মতো নয়। আমাদের চাঁদের ব্যাস প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কিলোমিটার। কিন্তু ফোবোস আর ডিমোস অনেক ছোট। ফোবোসের গড় ব্যাস মাত্র ২২ কিলোমিটার। আর ডিমোসের মাত্র ১২ কিলোমিটার। এদের আকার একটু এলোমেলো। কারণ, এরা পুরোপুরি গোল নয়। দেখতে অনেকটা আলুর মতো এবড়োখেবড়ো। রং একেবারে কালো, নতুন পিচঢালা রাস্তার মতো।
আমরা জানি, চাঁদ হলো এমন কোনো বস্তু, যা একটা গ্রহের চারদিকে ঘুরতে থাকে। কিন্তু ফোবোস আর ডিমোসের আকার ও রূপ দেখে অনেক বিজ্ঞানী বললেন, এগুলো চাঁদের চেয়ে বেশি গ্রহাণুর মতো দেখায়। কিন্তু এরা যেহেতু উপগ্রহ হওয়ার শর্ত ভাঙেনি, তাই এই দুটি বস্তুকে মঙ্গল গ্রহের চাঁদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
এখন ছোট্ট বন্ধুদের মনে একটা প্রশ্ন আসতে পারে, এই দুটি চাঁদ এল কোথা থেকে? বিজ্ঞানীদের ধারণা, এগুলো আগে গ্রহাণু ছিল। তারপর মঙ্গল গ্রহের মহাকর্ষশক্তিতে আটকে গেছে। মানে মঙ্গল গ্রহের টান ছেড়ে আর বেরোতে পারেনি।
তবে আরেকটা তত্ত্ব বলে, কোনো বড় বস্তু একসময় মঙ্গলে ধাক্কা মেরেছিল। সেই সংঘর্ষের ধ্বংসাবশেষ থেকে এই দুই চাঁদ তৈরি হয়েছে। আমাদের চাঁদও হয়তো এভাবেই তৈরি হয়েছিল।
তবে দুটো তত্ত্বেরই কিছু সমস্যা আছে। ফোবোস আর ডিমোসের গঠন দেখলে মনে হয় এরা গ্রহাণু ছিল। কিন্তু মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তুলনামূলক কম। দুটো গ্রহাণুকে ধরে রাখা এবং এমন নিয়মিত কক্ষপথে ঘোরানো এই গ্রহের পক্ষে কঠিন। আবার সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, দুই চাঁদের গঠনে সামান্য পার্থক্য আছে। এতে বিষয়টা আরও জটিল হয়ে গেছে।
তবে শিগগিরই হয়তো এ রহস্যের সমাধান পাওয়া যাবে। জাপানের মহাকাশ সংস্থা জাকসা ২০২৬ সালে একটা বিশেষ মিশন পাঠাবে মঙ্গল গ্রহে। মিশনটির নাম রাখা হয়েছে মার্শিয়ান মুনস এক্সপ্লোরেশন বা সংক্ষেপে এমএমএক্স। এ মিশনে মঙ্গলের দুটি চাঁদ পরীক্ষা করা হবে। এমনকি ফোবোস থেকে নমুনা নিয়ে ফিরবে পৃথিবীতে।
সেই নমুনা পরীক্ষা করলেই জানা যাবে, ফোবোস আর ডিমোস আসলে কী। যদি এরা আগে গ্রহাণু হয়ে থাকে, তাহলে তাদের রাসায়নিক গঠন হবে একরকম। আর যদি মঙ্গলের টুকরা থেকে তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে হবে অন্য রকম।
যদি দেখা যায় এই চাঁদগুলো সত্যিই মঙ্গলের সংঘর্ষের ফল, তাহলে আরও রোমাঞ্চকর আবিষ্কার হতে পারে। কারণ, তখন এই নমুনা হবে প্রাচীন মঙ্গলের টুকরা। আর প্রাচীন মঙ্গল হয়তো জীবনের জন্য উপযুক্ত ছিল। এই নমুনা থেকে হয়তো জানা যাবে, মঙ্গলে কখনো প্রাণের অস্তিত্ব ছিল কি না।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মঙ্গলের চাঁদ দুটোর উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই ছোট্ট চাঁদগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে আমাদের সৌরজগতের অনেক রহস্য। হয়তো আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা জানতে পারব এই দুই যমজ চাঁদের আসল পরিচয়।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স