মুঠোফোনের স্ক্রিনে গ্রিন লাইন পড়ে কেন, বাঁচার উপায় কী
লাখ টাকার ফোন কিনলে, আর হুট করে স্ক্রিনে ভেসে উঠল সবুজ দাগ! কেন এমন হয়? এ থেকে বাঁচার উপায় কী? গ্রিন লাইন পড়ে গেলেই–বা কী করবে?
শখ করে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে হয়তো একটা ফ্ল্যাগশিপ ফোন কিনেছ। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলে যে পর্দার ঠিক মাঝামাঝি একটা উজ্জ্বল সবুজ দাগ! ফোনটা তোমার হাত থেকে কখনো পড়েনি, পানিতেও ভেজেনি। তবুও এই দাগ। রিস্টার্ট ও ফ্যাক্টরি রিসেট দিলে, কিন্তু দাগ আর গেল না।
গত কয়েক বছরে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের কাছে স্ক্রিন ভেঙে যাওয়ার চেয়ে বড় আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে এই গ্রিন লাইন সমস্যা। স্যামসাং, ওয়ানপ্লাস, অ্যাপল বা মটোরোলার মতো নামীদামি ব্র্যান্ডের ফোনেও দেখা যাচ্ছে এই সবুজ দাগ।
কিন্তু কেন এমন হয়? আমাদের এই বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ায় কি এর প্রকোপ বেশি? এ থেকে বাঁচার উপায়ই–বা কী? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে চাইলে একটু টেকনিক্যাল দুনিয়া থেকে ঘুরে আসতে হবে।
গ্রিন লাইন কী
সহজ কথায়, এটা হলো আপনার ফোনের ডিসপ্লের হার্ডওয়্যার ফেইলিওর বা মৃত্যুঘণ্টা। আজকালকার দামি ফোনগুলোয় ব্যবহার করা হয় ওলেড বা অ্যামোলেড ডিসপ্লে। এই ডিসপ্লেগুলোয় প্রতিটি পিক্সেল আলাদাভাবে জ্বলে। ডিসপ্লের পিক্সেলগুলো মূলত লাল, নীল ও সবুজ রঙের মিশ্রণ। যখন ডিসপ্লের ভেতরের কানেকশনে কোনো গন্ডগোল হয়, তখন ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল ঠিকমতো পিক্সেলে পৌঁছাতে পারে না। টেকনিক্যাল ভাষায় বললে, ডিসপ্লের যে ড্রাইভার আইসি বা কন্ট্রোলার থাকে, সেটা যখন ভোল্টেজ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন পিক্সেলগুলো উল্টাপাল্টা কাজ করতে শুরু করে। সাধারণত সবুজ রঙের পিক্সেলগুলো জ্বলে থাকার জন্য সবচেয়ে কম ভোল্টেজ দরকার হয় এবং এগুলো সবচেয়ে বেশি স্থায়ী হয়। তাই কন্ট্রোল যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন সবুজ পিক্সেলগুলো সর্বোচ্চ উজ্জ্বলতায় জ্বলে ওঠে এবং আর নেভে না। ফলে তোমার স্ক্রিনে স্থায়ী সবুজ দাগ পড়ে।
কেন এই দাগ পড়ে
বেশির ভাগ মানুষ অভিযোগ করেন, সফটওয়্যার আপডেট দেওয়ার পর এমন অবস্থা হয়েছে। মানে সবুজ দাগ পড়েছে। মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি কোম্পানিগুলো ইচ্ছা করে আপডেটের মাধ্যমে ফোন নষ্ট করে দিচ্ছে? ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। এখানে ভিলেন হলো তাপ বা হিট। সফটওয়্যার আপডেট হওয়ার সময় প্রসেসরের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। ফোন তখন খুব গরম হয়ে যায়। ডিসপ্লের সঙ্গে মাদারবোর্ডের সংযোগ থাকে একটা পাতলা রিবন দিয়ে। আধুনিক ফোনগুলোয় বেজেল বা বর্ডার কমানোর জন্য এই ফ্লেক্স কেব্লকে বাঁকিয়ে খুব সরু জায়গার মধ্য দিয়ে নেওয়া হয়। ডিসপ্লের গ্লাসের সঙ্গে এই ফ্লেক্স কেব্লের সংযোগস্থলে যে আঠা বা বন্ডিং থাকে, অতিরিক্ত গরমে সেটা আলগা হয়ে যেতে পারে।
তুমি যখন সফটওয়্যার আপডেট দাও, তখন ফোন গরম হয়। আর ওই গরমে যদি ফ্লেক্স কেব্লের কোনো একটি সূক্ষ্ম কানেকশন লুজ হয়ে বা ছিঁড়ে যায়, তাহলে তোমার স্ক্রিনে গ্রিন লাইন দেখা দেবে। অর্থাৎ আপডেটের কারণে ফোনটা গরম হয় ঠিকই, কিন্তু মূল সমস্যাটা হার্ডওয়্যার বা ডিজাইনের।
বাংলাদেশ বা এই অঞ্চলে কি বেশি দাগ পড়ে
আপনি যদি সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপগুলো দেখেন, মনে হবে বাংলাদেশ, ভারত বা এই অঞ্চলের মানুষের কপালই খারাপ। আসলে কপাল খারাপ নয়, খারাপ হলো আমাদের আবহাওয়া।
গ্লোবাল টেক ফোরাম ও রিপেয়ার এক্সপার্টদের মতে, গ্রিন লাইন ইস্যুর সঙ্গে তাপমাত্রার একটা বড় সম্পর্ক আছে। ইউরোপ বা আমেরিকার তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় পরিবেশের তাপমাত্রা অনেক বেশি। আমাদের দেশে গরমের সময় এমনিতেই তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রির ওপরে থাকে। এর মধ্যে তুমি যদি আবার হেভি গেমিং করো বা ফাস্ট চার্জিং অবস্থায় ফোন আপডেট দাও, তাহলে ফোনের ভেতরের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়।
স্যামসাং বা ওয়ানপ্লাসের মতো কোম্পানিগুলো ডিসপ্লে তৈরির সময় যে হিট টলারেন্স বা তাপ সহ্য করার ক্ষমতা নির্ধারণ করে, আমাদের দেশের আবহাওয়ায় দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহারে সেটা অনেক সময় ফেল করে। তা ছাড়া অনেক সময় কোম্পানিগুলো নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য নির্দিষ্ট লটের ফোন পাঠায়। ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদনের সময় কোনো নির্দিষ্ট ব্যাচে ত্রুটি থাকলে সেটার ভুক্তভোগী হয় নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের মানুষ।
ভারতে ওয়ানপ্লাস ব্যবহারকারীদের ব্যাপক অভিযোগের পর কোম্পানি সেখানে আজীবন ওয়ারেন্টি দিতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশেও প্রচুর স্যামসাং এস–সিরিজ ও ওয়ানপ্লাস ব্যবহারকারী এ সমস্যায় পড়েছেন।
বাঁচার উপায় কী
সত্যি বলতে হার্ডওয়্যার ডিজাইন যদি দুর্বল হয়, তবে তোমার করার মতো খুব বেশি কিছু থাকবে না। তবে ঝুঁকি কমানোর জন্য টেকনিশিয়ানরা কিছু পরামর্শ দেন। সেগুলো মেনে চলতে পারো।
১. ফোন গরম থাকা অবস্থায় আপডেট দেবে না
ফোন যদি গেম খেলে বা চার্জে দিয়ে গরম হয়ে থাকে, তবে সে অবস্থায় সফটওয়্যার আপডেট দেবে না। ফোন ঠান্ডা হওয়ার পর চার্জার থেকে খুলে আপডেট দেবে।
২. কাভার খুলে আপডেট
আপডেট দেওয়ার সময় ফোনের ব্যাক কাভার খুলে ফেলতে পারো। সম্ভব হলে ফ্যানের নিচে বা এসি রুমে বসে আপডেট দাও, যাতে তাপ দ্রুত বেরিয়ে যেতে পারে।
৩. চাপ লাগা থেকে সাবধান
অনেক সময় পকেটে বা ব্যাগে চাপ লেগেও ডিসপ্লের ফ্লেক্স কেব্ল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। টাইট জিনস প্যান্টের পকেটে ফোন রাখা এড়িয়ে চলো।
৪. ব্রাইটনেস নিয়ন্ত্রণ
সব সময় শতভাগ ব্রাইটনেসে ফোন ব্যবহার না করাই ভালো। এতে ডিসপ্লের ওপর চাপ পড়ে এবং ডিসপ্লের আয়ু কমে।
দাগ পড়লে সমাধান কী
যদি দাগ পড়েই যায়, তবে টুথপেস্ট ঘষে বা ফ্রিজে রেখে কোনো লাভ নেই। ইউটিউবের টোটকা তোমার ফোনকে আরও নষ্ট করতে পারে। এর সমাধান মূলত তিনটি।
১. ডিসপ্লে পরিবর্তন
এটি সবচেয়ে সহজ, কিন্তু ব্যয়বহুল সমাধান। অথরাইজড সার্ভিস সেন্টার থেকে ডিসপ্লে বদলালে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
২. ফ্লেক্স বন্ডিং
বর্তমানে বাংলাদেশের রিপেয়ার মার্কেটগুলোয় একধরনের লেজার মেশিন এসেছে। একে বলা হয় ফ্লেক্স বন্ডিং মেশিন। ঢাকার মোতালেব প্লাজা বা ইস্টার্ন প্লাজায় এখন এই মেশিন পাওয়া যায়। এই মেশিনের সাহায্যে পুরো ডিসপ্লে না বদলে শুধু ডিসপ্লের রিবন বা ফ্লেক্স কেব্লটা বদলে নতুন করে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এতে খরচ অনেক কম হয়। মডেলভেদে তিন থেকে আট হাজার টাকা খরচ হতে পারে। তবে এতে ঝুঁকিও থাকে। অনেক সময় ডিসপ্লে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
৩. কোম্পানি ক্লেইম
তোমার ফোনের যদি ওয়ারেন্টি থাকে, তবে সোজা কাস্টমার কেয়ারে চলে যাও। এমনকি ওয়ারেন্টি শেষ হয়ে গেলেও যদি খেয়াল করো যে তোমার মডেলের অনেক ফোনে একই সমস্যা হচ্ছে, তবে কাস্টমার কেয়ারে গিয়ে জোরালোভাবে কথা বলতে পারো। অনেক সময় কোম্পানি ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট স্বীকার করে বিনা মূল্যে বা কম খরচে ডিসপ্লে বদলে দেয়।
প্রযুক্তি আমাদের জীবন সহজ করেছে ঠিকই, তবে মাঝেমধ্যে পকেটও হালকা করে। গ্রিন লাইন ইস্যু এখন স্মার্টফোন কোম্পানিগুলোর জন্য একটা বড় লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এত দাম দিয়ে ফোন কিনে যদি আপডেটের ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়, তবে তা মেনে নেওয়া কঠিন। তাই ফোন কেনার সময় একটু খোঁজ নিয়ে দেখ, ওই নির্দিষ্ট মডেলে গ্রিন লাইনের বদনাম আছে কি না।
সূত্র: অ্যান্ড্রয়েড অথরিটি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, স্যামমোবাইল এবং এক্সডিএ ডেভেলপারস