১৪১ বছর বয়সে মারা গেছে চিড়িয়াখানার সবচেয়ে বয়স্ক কচ্ছপ

সান দিয়াগো জু ওয়াইল্ডলাইফ অ্যালায়েন্স

দীর্ঘ এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগো চিড়িয়াখানার সবচেয়ে বয়স্ক বাসিন্দা ছিল গ্র‍্যাম্মা বা ‘গ্র্যান্ডমা’ নামের কচ্ছপ। ২০ নভেম্বর প্রতিদিনের মতোই প্রিয় খাবার রোমান লেটুস ও ক্যাকটাস ফল খাচ্ছিল। হঠাৎই দীর্ঘ ১৪১ বছর বয়সে গ্র্যান্ডমা শেষনিশ্বাস ত্যাগ করে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এত বছর ধরে সবার প্রিয় এই প্রাণীর চলে যাওয়াই কর্মী ও দর্শকদের মন ভারাক্রান্ত।

গ্র্যান্ডমা ছিল বিরল গ্যালাপাগোস প্রজাতি কচ্ছপ। গ্যালাপাগোস নামটা এসেছে ইকুয়েডরের গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ থেকে। এটি এদের আদি বাসস্থান। চিড়িয়াখানার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন গ্র্যান্ডমার জন্ম হয়েছিল আদি প্রাকৃতিক বাসস্থানেই। যদিও সে ঠিক কোন বছর সান দিয়েগো চিড়িয়াখানায় এসেছিল, সে তথ্য স্পষ্ট নয়। তবে কর্মকর্তারা জানান, ১৯২৮ বা ১৯৩১ সালের দিকে নিউইয়র্কের ব্রঙ্কস চিড়িয়াখানা থেকে গ্যালাপাগোস কচ্ছপের যে প্রথম দলটি এসেছিল, গ্র্যান্ডমা ছিল তারই অংশ। অর্থাৎ চিড়িয়াখানায় আসার আগেই সে প্রায় ৪০ বছর প্রকৃতির মধ্যে কাটিয়েছিল।

আরও পড়ুন

কচ্ছপ যে খুব ধীরে চলে, তা আমরা সবাই জানি। একটি গ্যালাপাগোস কচ্ছপ সবচেয়ে জোরে হাঁটলেও সেটি ঘণ্টায় মাত্র শূন্য দশমিক ১৫ মাইল গতিতে এগোয়। চিন্তা করো, এই গতিবেগ সাধারণত আমাদের মতো মানুষের হাঁটার গতির ২০ ভাগের মাত্র ১ ভাগ। তাই চিতা বা বাজপাখির মতো দ্রুতগামী প্রাণীদের সঙ্গে এদের তুলনা করা একেবারেই চলে না। কিন্তু শেষ হাসিটি কচ্ছপই হাসে। অন্যান্য প্রজাতির সদস্যরা অল্প সময়েই মারা যায়। আর কচ্ছপ বছরের পর বছর ধরে এই ধীরগতিতেই হাঁটতে থাকে। অর্থাৎ গতিতে পিছিয়ে থাকলেও দীর্ঘ জীবনে এরা পৃথিবীর প্রায় সব প্রাণীকে ছাড়িয়ে যায়।

গ্র্যান্ডমার চারপাশের পৃথিবী যখন দ্রুত বদলে যাচ্ছিল, তখন এটি নিজের মিষ্টি ও লাজুক স্বভাব দিয়ে দর্শকদের আনন্দিত করে গেছে। শুধু তা–ই নয়, দীর্ঘ জীবনে দুটি বিশ্বযুদ্ধ, মহামারি এবং ২০ জন মার্কিন রাষ্ট্রপতির শাসনকাল পার করেছে। পৃথিবীর এত বড় বড় পরিবর্তন এর জীবনকালে হলেও এটি বছরের পর বছর ধরে একই ধরনের শান্ত ও ধীরগতিতে সান দিয়েগো চিড়িয়াখানায় ঘুরে বেড়িয়েছে।

আরও পড়ুন

দীর্ঘ জীবনের কারণে গ্র্যান্ডমার যত্ন বিশেষজ্ঞরা একে ‘চিড়িয়াখানার রানি’ উপাধি দিয়েছিলেন। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এটি বার্ধক্যজনিত হাড়ের রোগে বেশ কিছু দিন ভুগছিল, যা সম্প্রতি মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। তাই সেই কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ মানবিক সিদ্ধান্ত নিয়ে গ্র্যান্ডমাকে ইউথানাইজ করে শান্তিতে বিদায় দেয়।

ইউথানাইজ (Euthanasia) কথাটির অর্থ হলো শান্তিপূর্ণ মৃত্যু। এটিকে সাধারণত প্রাণীদের জীবনাবসানের একটি মানবিক উপায় হিসেবে দেখা হয়। কোনো প্রাণী যখন খুব মারাত্মক ও নিরাময়–অযোগ্য রোগে ভোগে অথবা যখন এদের দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা বা আঘাতে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়, তখন প্রাণীটিকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পশুচিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। মূলত, যখন প্রাণীর বেঁচে থাকার চেয়ে তার কষ্ট পাওয়া বেশি হয়, তখনই চূড়ান্ত বিবেচনার পর এটি করা হয়। গ্র্যান্ডমার ক্ষেত্রেও এমন মানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন

গ্র্যান্ডমার মৃত্যুর খবরটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর বহু মানুষ আবেগঘন স্মৃতিচারণা করেছেন। অনেকেই লিখেছেন, ছোটবেলায় যখন তাঁদের মা–বাবা বলতেন, ‘চলো, গ্র্যান্ডমার সঙ্গে দেখা করে আসি,’ তখন তাঁরা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কে আমাদের গ্র্যান্ডমা?’ জবাবে মা–বাবা হেসে বলতেন, ‘ও আমাদের সবার গ্র্যান্ডমা।’ এই দর্শনার্থীরাই জানিয়েছেন, তাঁরা কিছুদিন আগেও নিজেদের সন্তানদের নিয়ে সেই গ্র্যান্ডমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। কিন্তু খুব কষ্ট লাগছে, এখন আর সে সেখানে নেই। মূলত সান দিয়েগোর আশপাশের শহরের সবার কাছে গ্র্যান্ডমা ছিল টাইম ক্যাপসুল।

গ্যালাপাগোস কচ্ছপরা যে কত বছর বাঁচে, তা শুনলে অবাক হতে হয়। জঙ্গলে এরা ১০০ বছরের বেশি বাঁচে, আর চিড়িয়াখানায় ভালো যত্ন পেলে এরা এর দ্বিগুণও বাঁচতে পারে। সবচেয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকার রেকর্ড আছে হ্যারিয়েট নামের একটি কচ্ছপের। সে অস্ট্রেলিয়ার একটি চিড়িয়াখানায় ১৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিল। তাকে ১৮৩০ সালে ছোট অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল এবং সে মারা যায় ২০০৬ সালে।

আরও পড়ুন

গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে মোট ১৫ ধরনের কচ্ছপ পাওয়া যেত। কিন্তু দুঃখের বিষয় এর মধ্যে ৩ ধরনের কাছিম এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকি কচ্ছপগুলোও এখন ঝুঁকিতে আছে। তবে বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়েননি। গ্যালাপাগোস সংরক্ষণ সংস্থা কয়েক দশক ধরে চিড়িয়াখানায় কচ্ছপের বাচ্চা উৎপাদন করার জন্য কাজ করছে। এর ফলে ১৯৬৫ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ১০ হাজারটির বেশি ছোট কচ্ছপকে আবার জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই চেষ্টার ফলেই কিছু প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া চিড়িয়াখানায় প্রায় ১০০ বছর বয়সী গ্যালাপাগোস প্রজাতির আবরাজ্জো ও মমি নামের কচ্ছপজোড়া প্রথমবারের মতো মা-বাবা হয়। চিড়িয়াখানাটির ১৫০ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসে এমন ঘটনা ‘প্রথম’ ঘটে। এ ছাড়া মা কচ্ছপটি তার প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বয়সে প্রথমবারের মতো মা হয়েছিল। এরা মোট চারটি বাচ্চা জন্ম দেয়।

সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস, সিএনএন

আরও পড়ুন