অপরাধী শনাক্ত করার পদ্ধতি মাগশট কীভাবে এল

সন্দেহভাজন অপরাধীদের চেহারা রেকর্ড রাখার জন্য পুলিশ মাগশট ব্যবহার করেফক্স ১৩ সিয়াটল

মাগশট কী?

যখন কেউ অপরাধ করে কিংবা যখন কাউকে সন্দেহভাজন হিসেবে ধরা হয়, তখন পুলিশ সেই ব্যক্তির কয়েকটি ছবি তুলে রাখে। এই ছবিটা হয় মাথা থেকে বুক পর্যন্ত। পুলিশের নথিতে রেকর্ড রাখার জন্য অপরাধী কিংবা সন্দেহভাজন ব্যক্তির এ ধরনের যেসব ছবি তুলে রাখা হয়, তাকেই বলা হয় মাগশট। অনেকে একে পুলিশ ফটোগ্রাফি বা বুকিং ফটোগ্রাফি নামে ডাকে।

মূলত অপরাধী অথবা সন্দেহভাজন অপরাধীদের চেহারা রেকর্ড রাখার জন্য পুলিশ মাগশট ব্যবহার করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ফটো রেকর্ডের জন্যও নাগরিকদের মাগশট তুলতে উৎসাহিত করে ফটোগ্রাফার বা ফটোগ্রাফি কোম্পানিগুলো।

মাগশটের কারণে এখন ছবি দেখে পুলিশ চট করে সহজে বের করে ফেলে আসামির আগের কোনো অপরাধের রেকর্ড আছে কি না। মাগশটের কারণে আসামিকে আবার ধরতে গেলে তাকে চিনতে পুলিশের আর তেমন বেগ পেতে হয় না।

আরও পড়ুন

কোথা থেকে শুরু

ফটোগ্রাফি আবিষ্কারের সঙ্গে মাগশটের যোগ রয়েছে। পুলিশের কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে মাগশট। ফটোগ্রাফি আসার আগে অপরাধী দেখতে কেমন, সেটা পুলিশকে থানার খাতায় লিখে রাখতে হতো। যখন ফটোগ্রাফি ছিল না তখন উপমহাদেশে অপরাধীর চেহারা বর্ণনার জন্য থানায় হুলিয়া শব্দটি ব্যবহার করত। হুলিয়া একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ চেহারা। তবে এ দেশে এসে আরবি এই শব্দটি একটু পাল্টে গেছে। এ দেশে শব্দটির মানে আসামিকে গ্রেপ্তার করার জন্য তার চেহারা কেমন, সেটার বর্ণনা।

যদি আসামির কোনো ছবি না থাকে তাহলে আসামির হুলিয়া বলতে হয়। সে ক্ষেত্রে সমস্যা থেকেই যায়। ভুল আসামিকে ধরে আনার একটা শঙ্কা থাকে। তাই আসামির চেহারাকে ছবিতে ধরে রাখার জন্যই মাগশট। এটি ব্রিটিশ শব্দ। মানুষের চেহারা নিয়ে গালি দেওয়ার জন্য মাগ শব্দটি ব্যবহার করত ব্রিটিশরা।

ক্যামেরা আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনী সেটাকে অপরাধীদের ধরার এক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। ১৮৪৩ সালে বেলজিয়ামের পুলিশ প্রথম অপরাধীদের চিনে রাখার জন্য তাদের ছবি তুলে রাখা শুরু করে। উদ্দেশ্য একদম পরিষ্কার—এরপর যদি আবার অপরাধ করো বাপু, তোমার চেহারা কিন্তু আমাদের কাছে বাঁধা রইল।

১৮৪৬ সালে একই কাজ করা শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ। তবে সেটা পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে শুধু সিডনিতে শুরু হয়। ইংল্যান্ডে শুরু হয় ১৮৪৮ সালে। তবে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে নয়, ছবি তোলার এই কাজ শুরু করেছিল লিভারপুল ও বার্মিংহামের পুলিশ। আমেরিকা অপরাধীদের ছবি তোলা শুরু করে ১৮৫৩ সালে। তবে তখন শুধু ফিলোডেলফিয়ার পুলিশ বিভাগ এই কাজ করত।

আরও পড়ুন

ছবি কথা বলে

পুলিশ অপরাধীদের ছবি তোলা শুরু করলেও মাগশট হিসেবে তারা একটি ছবি তুলত। সামনে ও পাশে দাঁড় করিয়ে অপরাধীর একজোড়া ছবি তোলার কৃতিত্ব দেওয়া হয় আলেকজান্ডার গার্ডেনারকে। তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের দুটি করে ছবি তোলেন। যার একটি সামনে দাঁড় করিয়ে, আরেকটি পাশ থেকে।

বর্তমানে সারা বিশ্বের পুলিশ অপরাধীর ছবি তুলতে যে মাগশট ব্যবহার করে, সেটির উদ্ভাবক প্যারিসের পুলিশ কর্মকর্তা আলফনসো বার্তিলো। ১৮৮০-এর দশকে তিনি ছিলেন প্যারিস পুলিশ বিভাগের অপরাধী চিহ্নিতকরণ বিভাগের প্রধান।

আরও পড়ুন

১৮৭১ সালে প্যারিস কমিউন নামের একদল বিপ্লবীর পরাজয়ের পর প্যারিসে একদল অ্যানার্কিস্ট বা নৈরাজ্যবাদীর উদ্ভব হয়। যারা বিশ্বাস করে রাষ্ট্র মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর প্রতিষ্ঠান। যার ফলে নৈরাজ্যবাদীরা প্যারিসসহ বিভিন্ন এলাকায় রাষ্ট্র ও এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায়ই হামলা চালাত। তাদের চিহ্নিত করতে গিয়ে সন্দেহভাজন নৈরাজ্যবাদীদের পুলিশ অফিসে নিয়ে যান বার্তেলো। তাদের বুক থেকে মাথা পর্যন্ত ও পাশ থেকে কাঁধ ও মাথাসহ তাদের চেহারার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য যেমন কানের দৈর্ঘ্য ও কাঁধের উচ্চতা, চোখের রং ইত্যাদির বর্ণনাসহ ছবি তুলে পুলিশের ফাইলে রেখে দিতেন। আর এর ফরাসি ভাষায় এর নাম দিয়েছিলেন ‘পোর্ট্রেট পাখলে’। অর্থাৎ, ছবি কথা বলে।

দ্রুত এটি ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিছুদিনের মধ্যেই অপরাধীদের চিহ্নিত করতে ইউরোপ ও আমেরিকা এই পদ্ধতি গ্রহণ করে। যদিও এখন বার্তেলোর এই পদ্ধতির চেয়ে উন্নত পদ্ধতিতে অপরাধীদের শনাক্ত করার প্রযুক্তি পুলিশের কাছে রয়েছে, তারপরও বিশ্বের অনেক দেশের পুলিশ অপরাধীদের চিহ্নিত করতে এই মাগশট ব্যবহার করে থাকে। এখন পুলিশ অপরাধীদের সহজে চিহ্নিত করতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙুলের ছাপ সংরক্ষণ করে।

আরও পড়ুন