এআই কি বিজ্ঞানীদের মতো নতুন আবিষ্কার করতে পারবে

এআই আপনাকে কোনো কাজ করার সঠিক ধাপগুলো নিখুঁতভাবে বলে দিতে পারবে, কিন্তু সেই কাজ করতে গেলে বাস্তবে কী কী সমস্যা হতে পারে, তা বলতে পারবে নাএআই আর্ট

চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা এখন কমবেশি সবার আছে। একটি জটিল প্রশ্ন করলেও এই এআই সঠিক উত্তর দিতে পারে। এটি উত্তর দেয় নিজের ডেটাবেজ ঘেঁটে। দরকার হলে ইন্টারনেট থেকে উত্তর খুঁজে বের করে। এতে চ্যাটজিপিটির তেমন কৃতিত্ব নেই, অনেকটা যান্ত্রিক ব্যাপার। বলা যায়, কম্পিউটার আগেও এমনটা করত, এআই ছাড়াই।

কিন্তু যেকোনো এআই, ধরা যাক চ্যাটজিপিটি একটি প্রশ্ন যেভাবে বুঝতে পারছে, এর আগে কোনো কম্পিউটার সফটওয়্যার, কোনো সার্চ ইঞ্জিন, এমনকি এই যে দুনিয়ার সেরা সার্চ ইঞ্জিন গুগল, সেও জটিল ও দীর্ঘ প্রশ্ন বুঝতে পারত না। ফলোআপ প্রশ্ন তো নয়ই।

তাহলে কি এআই প্রশ্নের অর্থ ‘বুঝতে’ পারে? এর কি একটি বিষয় অনুধাবনের ক্ষমতা আছে? যাঁরা এর ভেতরের খবর জানেন, তাঁরা বলছেন, এ তো শুধু শব্দের পর শব্দ বসানো! এসব এআই চ্যাটবটের ভেতরে যে জেনারেটিভ প্রিট্রেইন্ড ট্রান্সফরমার (জিপিটি) আছে, তা অনেক হিসাব করে বের করছে পরবর্তী শব্দটা বা অক্ষরটা কী হলে ভালো হয়। তার এই হিসাবের ভেতরে এমনকি অক্ষরও নেই, আছে কিছু সংখ্যা। সে হিসাব–নিকাশ করে যা বের করছে, তাকে বলে হচ্ছে ‘নেক্সট টোকেন’!

কিন্তু এর যে আউটপুট, যে উত্তর চ্যাটজিপিটি দিয়েছে, সেটা দেখে মনে হতে পারে, মেশিনটি ‘বুঝতে’ পারে। তুমি যদি একে বলো, আমি বাসায় ঢুকতে পারছি না, আমার আম্মু অফিসে। চাবি হারিয়ে ফেলেছি। এখন কী করা যায়? এটি উত্তর দেবে, এটা তো একটা খারাপ পরিস্থিতি। তবে চিন্তা কোরো না। কয়েকটা ভালো উপায় আছে, তুমি চেষ্টা করে দেখতে পারো–

১. বাড়ির অন্য কোনো দরজা বা জানালা খোলা থাকতে পারে। সেগুলো চেক করে দেখো।

২. তোমার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করো। কাজে থাকলেও সে হয়তো এসে দরজা খুলে আবার কাজে চলে যেতে পারবে।

৩. অন্য কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর কাছে ডুপ্লিকেট চাবি থাকলে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করো।

৪. না হলে তালাচাবির মিস্ত্রির সঙ্গে যোগাযোগ করো। সে এসে খুলে দেবে।

এসব উত্তর আমি চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞাসা করে মাত্র পেয়েছি। বলে রাখা ভালো, প্রশ্ন করেছিলাম ইংরেজিতে।

আরও পড়ুন

এই যে পরামর্শগুলো এটি দিল, প্রশ্ন না বুঝলে এটি কি উত্তর দিতে পারত? ‘মা অফিসে’ মানে তাঁর কাছে চাবি আছে। তিনি অফিসে থাকায় আসতে পারছেন না। প্রশ্নে এসব সরাসরি বলা নেই। কিন্তু এআই পরিস্থিতি বুঝেই যেন উত্তর দিল। এআই ছাড়া কোনো একটি সফটওয়্যার কি এটি পারবে? যদি না এর ভেতরে হুবহু প্রশ্ন এবং উত্তর আগেই ইমপুট দিয়ে রাখা না হয়? মানুষই পারে সমস্যাটা বুঝে উত্তর দিতে, আর এখন পারছে এআই।

এআইয়ের উত্তর দেখে কেন মনে হয়, এটি ‘বুঝতে পেরেছে’? মানুষের বোঝা আর এআইয়ের বোঝা কি এক? হুট করে সিদ্ধান্ত না নিয়ে বরং আপাতত ‘এআই না বুঝেই কাজ করছে’ ধরে নিই। বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ এটাই মনে করছেন।

এখন আরেকটি প্রশ্নে যাওয়া যাক। এআই কি নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারবে? বিজ্ঞানের নতুন কোনো ধারণা? যেমন নতুন কোনো ওষুধ, নতুন পদার্থ? নতুন নক্ষত্র বা ধূমকেতু? বিজ্ঞানের নতুন কোনো সূত্র এআইয়ের পক্ষে আবিষ্কার করা সম্ভব হবে?

বাস্তবে এআইকে কাজে লাগিয়ে এরই মধ্যে নতুন এনজাইম তৈরি করা হয়েছে। নতুন যৌগ আবিষ্কার হচ্ছে, নতুন ওষুধ তৈরির প্রস্তুতি চলছে। নানান ভাবে এটা গবেষকদের সহায়তা করছে। জেনেরেটিভ ক্যামিস্ট্রি নামে একটি শাখা তৈরি হয়েছে।

এআই–নির্ভর বায়োটেক কোম্পানি ‘ইনসিলিও’এরই মধ্যে ১৮টি বিভিন্ন ওষুধের ফর্মুলা আবিষ্কার করেছে, যা বর্তমানে ক্লিনিক্যাল প্রিট্রায়ালে আছে।

নাসা এআইকে নতুন নক্ষত্র আবিষ্কারের কাজে ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব অ্যানার্জির বার্কলে ল্যাব তো প্রায় স্বয়ংক্রিয় আবিষ্কারের একটি প্রক্রিয়াই তৈরি করেছে, যেখানে মানুষের দেখভাল করারও প্রয়োজন পড়ছে না। তাদের ল্যাবে এআই নতুন যৌগ পদার্থের ফর্মুলা দেবে (আণবিক গঠন), আর রোবট সেই ফর্মুলা অনুযায়ী যৌগ তৈরি করে পরীক্ষা করে দেখবে। এর ফলে নতুন ফর্মুলা তৈরি এবং তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য যে সময় লাগে, তা অনেক কমে যাচ্ছে। অনেক বেশি ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ করার সুযোগ হচ্ছে। মানে ভুল হবে আবার নতুন করে চেষ্টা করে দেখা হবে। এভাবে এমন বস্তু আবিষ্কার হয়ে যেতে পারে, যার নতুন গুণাগুণ এবং কার্যকর ব্যবহার আছে। হতে পারে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, হতে পারে নতুন সাশ্রয়ী জ্বালানি পদার্থ। একে তাঁরা নাম দিয়েছেন ‘অটোমেটেড ম্যাটেরিয়াল ফ্যাসিলিটি ল্যাব’। এভাবে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় এআইয়ের সহায়তায় কাজ করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন
এজিআই অকল্পনীয় রকমের বড় নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করবে, বর্তমান এআইয়ের থেকে হাজার গুণ শক্তিশালী হবে।

যে কোম্পানি চ্যাটজিপিটি তৈরি করেছে, তার নাম ‘ওপেনএআই’। এর সিইও হলেন স্যাম অল্টম্যান। তিনি বলেছেন, খুব শিগগির এআই নোবেল পুরস্কার পাওয়া বিজ্ঞানীদের মতো সমান প্রতিভায় কাজ করবে। নতুন গবেষণা, নতুন আবিষ্কার করবে। আর এআই শুধু একজন বিজ্ঞানীর সমান নয়, এমন হাজার হাজার ‘বিজ্ঞানী এআই’ একসঙ্গে কাজ করবে। তিনি মনে করেন, ২০২৭ সালের মধ্যেই এটি এসে যাবে। মানে আর মাত্র দুই বছরের মধ্যে।

সবচেয়ে বড় যে সুবিধা এআই পাবে, বলা যায় এরই মধ্যে পাচ্ছে, তা হলো বিজ্ঞানের সব শাখায় এর জ্ঞান আছে, যা একজন বিজ্ঞানীর নেই। একজন বিজ্ঞানী মূলত একটি শাখায় বিচরণ করেন। বায়োটেকনোলজি কোম্পানি ‘বোটা বায়ো’র সিইও ড. শ্যারোল কুইর মতে, বর্তমানে বিজ্ঞানের শাখাগুলো খুবই আবদ্ধ। একজন কম্পিউটেশনাল জীববিজ্ঞানী, যিনি একই সঙ্গে ভালো একজন কেমিস্ট, এমনটা পাওয়া কঠিন। অথচ অনেক আবিষ্কার হয়তো এই দুই শাখায় উন্নত জ্ঞান থাকলেই শুধু কাজ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে এআই খুব ভালো একটি সমাধান হবে।

এ কারণেই এআই দিয়ে নতুন সব আবিষ্কার করার সম্ভাবনা শত গুণ বেড়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

আরেকটি বিষয় হলো ‘আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স’, সংক্ষেপে এজিআই। একে অন্যভাবে বলা যায়, মানুষের সমান সাধারণ জ্ঞান, অর্থাৎ সব বিষয়ে এর জ্ঞান আছে। এই সাধারণ জ্ঞান এখনো এআই অর্জন করতে পারেনি। যখন শুধু কথা বলে, প্রশ্ন করে মানুষ আর এআই এর পার্থক্য বোঝা সম্ভব হবে না, তখন বড় মাইলফলকে এআই পৌঁছে যাবে। এর ব্যবহার শত গুণ বেড়ে যাবে। এ জন্যই বড় বড় টেক কোম্পানি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে এআইয়ের পেছনে। অ্যামাজন শুধু ২০২৫ সালে এআই কাঠামো তৈরির পেছনে ১২৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। সব মিলিয়ে বড় বড় টেক কোম্পানি এ বছরেই ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এখনো বছর শেষ হয়নি। যদি বাকি সময়টাতেও একই হারে বিনিয়োগ চলে, তবে এই পরিমাণে অর্থ ব্যয়, এই পরিমাণে দক্ষযজ্ঞ পৃথিবীর আর কোনো প্রযুক্তির পেছনে হয়নি।

এর কারণ শুধু যে অদূরভবিষ্যতে মানুষ এআইয়ের ব্যবহার অনেক বেড়ে যাবে তা নয়, এর পেছনের আরেকটা কারণ হলো এজিআইতে পৌঁছানো।

এজিআই অকল্পনীয় রকমের বড় নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করবে, বর্তমান এআইয়ের থেকে হাজার গুণ শক্তিশালী হবে। অনেকে মনে করেন এআই ‘এজিআই’ বা কমন সেন্স অর্জন করবে। তখন এর ব্যবহার বহুগুণ বেড়ে যাবে। বড় বড় বিজ্ঞানীর মতো আবিষ্কারের কাজও করতে পারবে।

সবাই অবশ্য এআই নিয়ে ততটা আশাবাদী নন। অনেকে মনে করছেন, এআই দিয়ে একেবারে নতুন কিছুই আবিষ্কার হবে না। এ শুধু পুরোনো জ্ঞানকে নতুন করে সাজানো যাবে।

‘এজিআইতে’ কোনো দিন পৌঁছানো যাবে না। তবে এরই মধ্যে আবিষ্কারে এআই যেভাবে চমক দেখাচ্ছে, ‘সম্পূর্ণ নতুন কিছু করতে পারবে না’ মতবাদটি কত দিন ধোপে টিকবে, তা কে জানে।

মোস্তফা তানিম: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ

আরও পড়ুন