আধা মানুষ, আধা ভ্যাম্পায়ার হিসেবে পরিচিত চুপাকাবরা আসলে কী
পৃথিবীর আনাচকানাচে ছড়িয়ে আছে এমন অনেক গল্প, যা আজও পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায়নি। এর মধ্যে কোনো কোনো গল্প অদৃশ্য কোনো প্রাণীকে জড়িয়ে আছে। এমনই এক রহস্যময় প্রাণীর নাম চুপাকাবরা। এই অদ্ভুত প্রাণীকে নিয়ে মানুষের মনে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য প্রশ্ন আর কৌতূহল। এটি কি সত্যিই কোনো অজানা প্রাণী, নাকি শুধুই লোককথা আর কল্পনা? বছরের পর বছর ধরে চুপাকাবরা লাতিন আমেরিকা থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। চুপাকাবরা কি শুধুই গুজব নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো অজানা প্রাণী?
চুপাকাবরার ঘটনা শুরু হয় ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পুয়ের্তো রিকোতে। সেই সময় পুয়ের্তো রিকোর কানোভানাস শহরে একজন কৃষকের আটটি ভেড়া মারা যায়। তবে মৃতদেহগুলো ছিল রক্তশূন্য ও গলায় ছিল অদ্ভুত কামড়ের দাগ। এ ঘটনার পর থেকেই রহস্যময় রক্তচোষা প্রাণীর গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
তবে এর আগেও কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। ১৯৭৫ সালের দিকে পুয়ের্তো রিকোর মোকা শহরে গবাদিপশুর এমন রহস্যময় মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। যেখানেও মৃত পশুদের কাঁধ ও গলার কাছে একই ধরনের আঘাতের চিহ্ন ছিল। তখন এর কোনো নির্দিষ্ট নাম ছিল না। তবে ধারণা করা হয়েছিল কোনো অজানা শিকারি পশু এর জন্য দায়ী। সেই সময় থেকেই এই ভয়ংকর প্রাণীটি পরিচিতি লাভ করে। এরপর ১৯৯০-এর দশকে আক্রমণের ঘটনা ও সংখ্যা—দুটোই বাড়তে থাকে, আর এটি ‘এল ভ্যাম্পিরো দে মোকা’ অর্থাৎ মোকার ভ্যাম্পায়ার নামে কুখ্যাতি অর্জন করে।
১৯৯৫ সালে পুয়ের্তো রিকোর কৌতুক অভিনেতা ও উদ্যোক্তা সিলভেরিও পেরেজ এই রহস্যময় প্রাণীর নাম দেন ‘চুপাকাবরা’ (Chupacabra), যার অর্থ ‘ছাগলচোষা’। Chupa অর্থ চোষা, Cabra অর্থ ছাগল। এই নামকরণের পরই দ্রুত লাতিন আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে চুপাকাবরা দেখার দাবি ও পশুপাখি মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়।
চুপাকাবরা দেখতে কেমন, তা নিয়ে যাঁরা হামলার শিকার হয়েছেন, তাঁরা একেক সময় একেকভাবে বর্ণনা করেছেন। প্রথম দিকে অনেকে এটিকে আধা মানুষ, আধা ভ্যাম্পায়ার জন্তু হিসেবে ভাবতেন। এ জন্য এটাকে প্রথমে ডাকা হতো ভ্যাম্পিরো।
চুপাকাবরা সম্পর্কে প্রথম দিকের গল্পগুলো ১৯৫০-এর দশকে সংবাদপত্রে ছাপা হতে শুরু করে। উত্তর আমেরিকায় চুপাকাবরা দেখার প্রথম ঘটনা ঘটেছিল ১৯৫৬ সালের দিকে অ্যারিজোনায়। এর মানে প্রায় ৭০ বছর ধরে এই রহস্যময় প্রাণীটি ক্রিপ্টো জুওলজিস্টদের নজরে ছিল। যাঁরা এমন সব প্রাণী নিয়ে গবেষণা করেন, যা বাস্তব হতে পারে বা না-ও হতে পারে, তাঁদের বলা হয় ক্রিপ্টো জুওলজিস্ট। তাঁরা চুপাকাবরার খোঁজে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় বেশ কিছু অভিযান চালান।
অনেকে এই গল্পের সূত্রপাত মনে করেন পুয়ের্তো রিকোর ম্যাডেলিন টোলেন্টিনোর নামের মহিলা বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে। তিনি ১৯৯৫ সালে সান জুয়ানে তাঁর জানালার বাইরে একটি প্রাণী দেখা পান এবং তাঁর বর্ণনা থেকেই এই রহস্যময় প্রাণীর বেশির ভাগ বিবরণ তৈরি হয়েছে। কিছু ঘটনায় তো এমনও বলা হয়েছে, শত শত ছাগল, মুরগি, হাঁস ও কুকুর একসঙ্গে মারা যায়।
প্রথম দিকে এই প্রাণীটিকে ৩ ফুট লম্বা, তীক্ষ্ণ দাঁত এবং জ্বলন্ত চোখবিশিষ্ট হিসেবে বর্ণনা করা করা হতো। এর দেখা পাওয়ার ঘটনা প্রথম ঘটেছিল পুয়ের্তো রিকোতে, কিন্তু খুব দ্রুতই এটি মধ্য আমেরিকা ও দক্ষিণ কিছু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তখনকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, এটি মূলত দক্ষিণ আমেরিকায়, বিশেষ করে চিলিতে, সমসাময়িক লোককাহিনিতে তার জায়গা করে নেয়।
চুপাকাবরাকে নিয়ে মুভি, বই ও ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছে। কিন্তু এর বাস্তব কোনো প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কোনো মৃত চুপাকাবরার দেহাবশেষ বা ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে এর অস্তিত্ব নিশ্চিত করা যায়নি। যে নমুনাগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেগুলো পরিচিত প্রাণীরই দেহাবশেষ।
অনেক বিশ্লেষক বলেছেন, চুপাকাবরা শুধুই মানুষের ভয় আর কল্পনা। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে প্রাণীগুলোকে চুপাকাবরা বলে দাবি করা হয়েছে, সেগুলো আসলে কায়োটি (Coyote)। একধরনের বন্য কুকুর। এই কায়োটিগুলো ম্যাঞ্জ (Mange) নামে এক মারাত্মক ত্বকের রোগে আক্রান্ত ছিল। ম্যাঞ্জ একটি বেদনাদায়ক রোগ, যা প্রাণীদের লোম ঝরিয়ে দেয় ও ত্বক কুঁচকে যায়। যার ফলে এদের দেখতে অদ্ভুত লাগে।
কিছু বিজ্ঞানীর কাছে, চুপাকাবরার এই ব্যাখ্যাই যথেষ্ট। ম্যাঞ্জের কারনি পরজীবী সারকোপ্টেস স্ক্যাবিই নিয়ে গবেষণা করেছেন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ব্যারি ওকনর। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না আমাদের আর কিছু খোঁজার বা এই ধরনের ঘটনাগুলোর অন্য কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন আছে।’
একইভাবে বন্য প্রাণী রোগবিশেষজ্ঞ কেভিন কিল একটি কথিত চুপাকাবরার মৃতদেহের ছবি দেখে এটিকে স্পষ্টত একটি কায়োটি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, সাধারণ মানুষের কাছে এটিকে কায়োটি বলে মনে না হওয়া অস্বাভাবিক নয়। জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কিল বলেন, ‘আমার চোখে এটি এখনো একটি কায়োটিকের মতো মনে হয়, তবে একটি কায়োটি। আমি যদি জঙ্গলে এটিকে দেখতাম, তাহলে এটিকে চুপাকাবরা ভাবতাম না। কারণ, আমি দীর্ঘদিন ধরে ম্যাঞ্জে আক্রান্ত কায়োটি ও শিয়াল দেখে আসছি। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ এর পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্ত হতেই পারেন।’
সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, হাউ স্টাফ ওয়ার্কস, উইকিপিডিয়া