বইমেলায় কেন যাব

হিমানীশ গোস্বামীর জীবরাম পড়েছ? ডানপিটে জীবরাম শিক্ষক ও সহপাঠীদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। কিন্তু একই সঙ্গে এই ডানপিটে ছেলেটিই নানা সমস্যার সমাধান হয়ে ওঠে। একবার বনভোজনে গিয়ে খাবার কম পড়েছিল। সেই যাত্রায় শসা দিয়ে খাবার বানিয়ে সে রক্ষা করেছিল। আদতে সুবোধ না হলেও সেদিন সে-ই সুবোধের মতো কাজ করেছিল। আবার একেবারে সুবোধ বালক ছিল ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের কঙ্কাবতীর খেতু। শুধু জীবরাম ও খেতু নয়; সুকুমার রায়ের পাগলা দাশু, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালীর অপু-দুর্গা ও রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের বনের ভেতর বেড়ে ওঠা মোগলিসহ এমন অসংখ্য চরিত্র এক আশ্চর্য দুরবিন দিয়ে আমাদের দেখিয়েছে অচেনা পৃথিবীর রূপ। সেই জগতে কল্পনায় ঘুরে ঘুরে জেনেছি, নানা রঙের মানে। মফস্‌সলে বসে এসব বই সংগ্রহ করতে যে কী বেগ পেতে হয়েছে, তা বলার মতো নয়।

তোমাদের হয়তো বই সংগ্রহে বেগ পেতে হবে না। জানো তো, শুরু হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এই মেলায় আরও অসংখ্য বই একসঙ্গে দেখতে পাবে। নতুন মোড়কে পুরোনো বইগুলো ছাড়াও নতুন কমিকসের বই, ছড়া-ছবি, নতুন গল্পের বই, বিজ্ঞানকল্পকাহিনি আর অ্যাডভেঞ্চারের বই পেয়ে যাবে একই মেলার মাঠে। সবার জন্য বিচিত্র সব বইয়ের পসরা সাজিয়ে প্রতিবারের মতো এবারও শুরু হয়েছে বইমেলা। এই মেলায় বইয়ের পাশাপাশি দেখা হবে অসংখ্য চেনা মুখের। দেখবে পরিচিত হাসি। দেখা হবে প্রিয় লেখকদের সঙ্গেও। চাইলে তাঁদের বই কিনে অটোগ্রাফ নিতে পারবে। পারবে প্রিয় লেখকের সঙ্গে ছবি তুলতেও। এসব ছাপিয়ে বড় যে সুযোগটা পাবে তা হলো, বইয়ের পাহাড়। এই পাহাড়ে মিলবে সেই আশ্চর্য দুরবিনের খোঁজ, যা দিয়ে তোমরাও দেখতে পাবে অচেনা পৃথিবীর রূপ। এক অন্য জীবনের সুর।

আরও পড়ুন

প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা শুরু হয়। বড়দের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের পদচারণে চনমন করে ওঠে মেলার মাঠ। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মা–বাবা বা বন্ধুদের সঙ্গে কিশোরেরা মেলায় আসে। আলাদা বোধ, আলাদা অভিজ্ঞতা নিয়ে বইমেলায় এসে সঙ্গে করে নিয়ে যায় ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা। এর মাধ্যমে তোমরাও ঢুকে যেতে পারবে নতুন এক পাঠ পরিধির ভেতর। জানার আশ্চর্য আনন্দ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে সামনের দিকে। বইয়ের নেশায় মেলায় গিয়ে দেখো, কীভাবে চোখের ভেতর ফুটে থাকে ফুলের মতো আলো। তারপর পড়া শুরু করে দেখো, তোমাদের মধ্য দিয়েই সেই আলো-হাওয়া এসে পৌঁছাবে আমাদের কাছে। আর একদিন আমরা শিখব তোমাদের কাছেই। মনে রেখো, এর সবকিছুই করে দিতে পারে বই।

অভিভাবকের সঙ্গে বইমেলায় এসেছে শিশু

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, বইমেলার এত বই একসঙ্গে কিনব কী করে? সব বই কিনতে হবে না। সামর্থ্য অনুযায়ী বই কিনলেই চলবে। সব বই তো তোমার হবে না। কিন্তু এই যে বইমেলার স্টলে স্টলে ঘুরে বিভিন্ন বইয়ের নাম দেখবে, এক পৃষ্ঠা পড়ে দেখবে, কেউ জানতে পারবে না ঠিকই। কিন্তু জানো, এতে গোপনে তুমিই জিতে যাবে। কারণ, তুমি বুঝতে পারবে, কোন বই ভালো। পরে সুযোগ পেলে নির্দিষ্ট সেই বই কিনে পড়তে পারবে।

মেরিলিন মনরোর নাম শুনেছ? পঞ্চাশের দশকের পপ সংস্কৃতির এই আইকনের তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তবু তিনি বই কিনতেন। কবিতা পড়তেন। এক সাক্ষাৎকারে মেরিলিন মনরো জানিয়েছিলেন, তিনি অবসর সময়ে কবিতা পড়েন। তাঁর ব্যক্তিগত পাঠাগারে প্রায় সাড়ে চার শ বই পাওয়া গেছে।

সব বই কিনতে হবে না। সামর্থ্য অনুযায়ী বই কিনলেই চলবে।

পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর সারা বিশ্বের প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রায় ৪০ লাখ বই প্রকাশিত হয়। আর আমাদের বাংলা একাডেমির তথ্য বলছে, বাংলাদেশে গত বছরের বইমেলায় মোট ৩ হাজার ৭৩০টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। এরপরও পৃথিবীব্যাপী শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বড়দের বই পড়া কমে গেছে। সবাই এখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে স্মার্টফোনে। আগে ছোটরা খেলাধুলা, পাখির বাসা খোঁজা, গুলতি বানানো—নানা কিছু নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আর এখন তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে বড় হচ্ছে। সহিংসও হয়ে উঠছে। এ থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে বই পড়তে হবে। বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। আর সেই সুযোগ সহজেই এনে দিচ্ছে এই বইমেলা।

আরও পড়ুন
পৃথিবীব্যাপী শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বড়দের বই পড়া কমে গেছে।

সুকুমার রায়ের জীবনী পড়েছ? পড়লে জানবে, তাঁর ডাকনাম ছিল তাতা। ছোটবেলায় ‘রাগ বানাই’ বলে নিজের তৈরি করা একটা খেলা ছিল তাতার। হয়তো তিনি কারও ওপর রেগে আছেন, কিন্তু শোধ নেওয়ার উপায় নেই। তখন তিনি ‘আয়, রাগ বানাই’ বলে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে অদ্ভুত সব গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলতে থাকতেন। এর মধ্যে কোনো বিদ্বেষ বা হিংস্রভাব থাকত না। ওই ব্যক্তির ক্ষতি হবে, এমন কোনো কথাও থাকত না, ছিল শুধু মজার কথা। এ খেলার ভেতর দিয়েই তাঁর রাগ পানি হয়ে যেত। এমন আদর্শ নিয়েই ছোটদের জন্য লিখতেন সুকুমার রায়। এই শিক্ষাই শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে আমাদের বড়দের নিতে হবে। এর জন্য সুকুমার রায়সহ অন্য সব লেখকের ভালো ভালো বই পড়তে হবে। বইয়ের কাছে ফিরতে হবে।

আদতে শিশুদের বই-ই মূলত আমাকে-আপনাকে শেখাতে পারে—আমরা যা ভুলে গেছি তা নয়, বরং আমরা ভুলে গেছি যে আমরা কী কী ভুলে গেছি, সেসব।
ক্যাথেরিন রান্ডল

ব্রিটিশ লেখক ও শিক্ষাবিদ ক্যাথেরিন রান্ডল বলেছেন, ‘ছোটদের তো শিশুতোষ বই পড়তেই হবে। বড়দেরও এখন পড়তে হবে শিশুদের বই। শিশুতোষ নানা ধরনের লেখার পাশাপাশি শিশুদের জন্য আরেক রকমের লেখা আছে—রূপকথার গল্প। রূপকথার গল্প কেবল শিশুদের জন্য নয়, এসব শিশু, বৃদ্ধ ও যুবক, নারী-পুরুষ—সবার জন্য। প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে আমাদের সেসব পড়তে হবে, শিকড়ের কাছে ফিরতে হবে।’

ক্যাথেরিন রান্ডল বলেছেন, আদতে শিশুদের বই-ই মূলত আমাকে-আপনাকে শেখাতে পারে—আমরা যা ভুলে গেছি তা নয়, বরং আমরা ভুলে গেছি যে আমরা কী কী ভুলে গেছি, সেসব। এসব বইয়ের মধ্য দিয়ে হয়তো আমরা ফিরে পেতে পারি ছোটবেলা, যেখানে রয়েছে আমাদের অনুপ্রেরণার সূত্র।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলা
ফাইল ছবি

তাহলে দেখো, তোমাদের বই পড়ার গুরুত্ব কত বড়! জানো তো, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালীর অপু কৌতূহলী ছিল। তার ছিল বিস্মিত হওয়ার অসীম ক্ষমতা। বিভূতিভূষণের অপরাজিত উপন্যাসের পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদে ভাই-বন্ধু প্রণবকে এক চিঠিতে অপু লিখেছে, ‘কিছুতেই আমাদের দেশের লোকে বিস্মিত হয় না কেন বলতে পারো, প্রণব? বিস্মিত হবার ক্ষমতা একটা বড়ো ক্ষমতা। যে মানুষ কোনও কিছু দেখে বিস্মিত হয় না, মুগ্ধ হয় না, সে তো প্রাণহীন। কলকাতায় দেখেছি কি তুচ্ছ জিনিস নিয়েই সেখানকার বড়ো বড়ো লোকে দিন কাটায়। জীবনকে যাপন করা একটা আর্ট—তা এরা জানে না বলেই অল্প বয়সে আমাদের দেশে জীবনের ব্যবসায় দেউলে হয়ে পড়ে।’ ওই চিঠিতেই অন্য এক বন্ধুর ভরসায় ফিজি ও সামোয়া যাওয়ার কথাও জানিয়েছে অপু। উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে এসে লেখক লিখেছেন, ‘ভবঘুরে অপু আবার কোথায় চলিয়া গিয়াছে। হয়তো লীলার মুখের শেষ অনুরোধ রাখিতে কোনো পোর্তো প্লাতার ডুবো জাহাজের সোনার সন্ধানেই বা বাহির হইয়াছে।’

অপুর মতো পোর্তো প্লাতা না হলেও মুঠোফোনের স্ক্রিন ছেড়ে বাইরে আসো। চারপাশে তাকাও, দেখো নিজের দিকে। বিস্মিত হয়ে দেখো বইমেলা ধুলা। এই বইমেলাতেই করো সোনার সন্ধান। শুরু করো। সব কৌতূহল নিয়ে আশ্চর্য দুরবিন দিয়ে চিনে নাও অচেনা জগৎ।

আরও পড়ুন