হুমায়ূন আহমেদ বললেন, একুশের বইমেলা হবে, লোকেদের ভিড়, আড্ডা, আমি সেখানে থাকব না!
১৩ নভেম্বর বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষ্যে জনপ্রিয় অভিনেতা ফারুক আহমেদের একটি লেখা থাকল কিশোর আলোর পাঠকের জন্য।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় তাঁর জন্ম। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি একজন বহুমাত্রিক সৃজনশীল মানুষ। তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯৭২ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে লিখে। সেই থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি লিখেছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গল্প ও উপন্যাস, যা পাঠকদের আজও মুগ্ধ করে রেখেছে। হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্র হিমু, মিসির আলি ও শুভ্র বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য অবস্থান তৈরি করেছে। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। লেখার মাধ্যমে পাঠকদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন এই নন্দিত লেখক।
অঝোর ধারায় বৃষ্টি হলেই আমার হুমায়ূন ভাইয়ের কথা বেশি মনে পড়ে। তুমুল বৃষ্টি তিনি অসম্ভব ভালোবাসতেন। এক কথায় তিনি ছিলেন বৃষ্টি বিলাসী মানুষ। আজ বিকেলে ঢাকা শহরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। হুমায়ূন ভাইয়ের স্মৃতি একে একে ছবির মতো আমার মনে পড়তে লাগল। বাসায় এসে তাই তাঁর স্মৃতি নিয়ে লিখতে বসলাম। যদিও আমার এই লেখাটি বৃষ্টির কোনো ঘটনা নিয়ে লেখা নয়। আজকের এই বিষয়টি পাঠকদের কাছে আমার বিবেচনায় নতুন মনে হবে। লেখার কারণ এটাই। বকবক না করে লেখার বিষয়ে আসি।
হুমায়ূন ভাই তখন কর্কট রোগে আক্রান্ত। আমেরিকায় কয়েকটি কেমোথেরাপি নিয়েছেন। হঠাৎ তাঁর মন ছুটে গেল দেশের টানে। নুহাশপল্লীর টানে। ডাক্তারদের আপত্তি ছিল এই শরীরে দেশে যাওয়ার ব্যাপারে। তিনি তখন ডাক্তারদের বললেন মাত্র পনেরো দিনের জন্য তিনি তাঁর প্রিয় নুহাশপল্লী দেখে আবার চলে আসবেন। হুমায়ূন ভাইয়ের আবেগ, অনুভূতির কথা বিবেচনা করে আমেরিকার ডাক্তাররা তাঁকে দেশে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
হুমায়ূন ভাই দেশে ফিরেই নুহাশপল্লী চলে গেলেন। আমি নুহাশপল্লী যাব হুমায়ূন ভাইকে দেখতে। এর মধ্যে নুহাশপল্লী থেকে ফোন এলো হুমায়ূন ভাই নতুন নাটক করবেন, আমাকে লাগবে। আমি অবাক। একজন মানুষ কর্কট রোগে আক্রান্ত অথচ কী তাঁর প্রাণশক্তি! নাটক লিখবেন, নাটক বানাবেন। পরদিন সকালবেলা আমি একরকম ছুটে গেলাম নুহাশপল্লী।
গিয়ে দেখি হুমায়ূন ভাই ড্রয়িংরুমে বসে সকলের সাথে নাস্তা করছেন। আমি আসতে আসতে ভাবছিলাম এতদিন পর অসুস্থ হুমায়ূন ভাইকে কেমন দেখব? হয়তো দেখব তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন।
কিন্তু না। আমাকে দেখেই তিনি অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বললেন, ফারুক এসেছো? বসো। নাস্তা করো। আমি তাঁর কথায় বিস্মিত। একজন অসুস্থ মানুষ। কী স্বাভাবিকভাবে কথা বলছেন। আমি নাস্তা খেতে তাঁর পাশে বসলাম। তিনি এক টুকরা আম নিয়ে চুষতে লাগলেন। তারপর আমেরিকার গল্প শুরু করলেন। ট্রিটমেন্টের সময় আমেরিকার ডাক্তারদের সাথে কী কী মজার ঘটনা ঘটেছে সেইসব গল্প। গল্প শেষে হুমায়ূন ভাই আমার দিকে তাকালেন।
তারপর বলা শুরু করলেন, আমি একটা নাটক লিখছি। নাটকের নাম 'পিপীলিকা'। ফারুক, তুমি এই নাটকে অভিনয় করবে। আগামীকাল থেকে শুটিং।
আমি বললাম, জি হুমায়ূন ভাই।
পরদিন থেকে নাটকের শুটিং শুরু হলো। শুটিং এর ফাঁকে ফাঁকে গল্প। হুমায়ূন ভাই বলেন। আমার মুগ্ধ হয়ে শুনি। হুমায়ূন ভাইয়ের গল্পবলার ঢং ঠিক আগের মতো। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় না তিনি এক কঠিন রোগে আক্রান্ত।
এক বিকেলে শুটিং শেষ। তিনি তাঁর প্রিয় লিচু গাছের নিচে বসে গাছের দিকে তাকিয়ে আছেন। ডালে ডালে পাকা লিচু ঝুলছে। তিনি দেখছেন। আমি দূর থেকে বিষয়টা লক্ষ করলাম। আস্তে আস্তে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। হুমায়ূন ভাই আমাকে দেখে বললেন, ফারুক বসো। আমি পাশে একটা খালি চেয়ারে বসলাম।
তিনি বললেন, মুশাররফকে ডাকো। মুশাররফ নুহাশপল্লীর কেয়াটেকার।
আমি চিৎকার করে ডাকলাম, মুশাররফ ভাই। মুশাররফ ভাই আশেপাশেই ছিলেন। তিনি দৌড়ে এসে হুমায়ূন ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন।
হুমায়ূন ভাই মুশাররফ ভাইকে বললেন, মুশাররফ তুমি একটা কাজ করো।
গ্রামের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের আমার কাছে নিয়ে আসো। সময় পঁচিশ মিনিট। মুশাররফ ভাই মাথা নিচু করে বললেন, জি স্যার। বলেই ছুটলেন ছেলেমেয়েদের খোঁজে। আমি হুমায়ূন ভাইয়ের পাশে চুপ চাপ বসে রইলাম।
হুমায়ূন ভাই একসময় কথা শুরু করলেন, কী আশ্চর্য তাই না ফারুক!
আমি বললাম, কী আশ্চর্য ভাই? তিনি বললেন, এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেয়া যায়! হায়রে জীবন!
আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। এক সময় তাকিয়ে দেখলাম হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি। আমার বুকটা তখন হু হু করে উঠল। কিছু বলতে পারলাম না।
কিছুক্ষণ পর হুমায়ূন ভাই স্বাভাবিক গলায় বললেন, পঁচিশ মিনিট শেষ হয় নাই? কই মুশাররফ? এত দেরি করছে কেন?
হুমায়ূন ভাই এই কথা জিজ্ঞেস করতেই আমি দেখি নুহাশপল্লীর গেইট দিয়ে বারো চোদ্দজন ছেলেমেয়ে নিয়ে মুশাররফ ভাই দ্রুত হেঁটে আসছেন।
আমি বললাম, মুশাররফ ভাই আসছে।
মুশাররফ ভাই এসেই বললেন, স্যার আমি আসছি। পুলাপান জোগাড় করতে দেরি হয়ে গেল। গ্রামের পুলাপানতো দুষ্টু। খেলা দুইয়া আসতে চায় না।
হুমায়ূন ভাই মুশাররফ ভাইয়ের কথার উত্তর না দিয়ে ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করলেন, আছো কেমন তোমরা?
ছেলেমেয়েরা সবাই এক সাথে বলল, ভালো আছি ছার। আপনে কেমন আছেন?
হুমায়ূন ভাই মৃদু হেসে বললেন, আমিও ভালো আছি। শোনো, তোমার কে কে গাছে উঠতে পারো হাত তুলো। গ্রামের ছয় সাত বছরের ছেলেমেয়ে। প্রায় সবাই হাত তুলে জানাল তারা গাছে উঠতে পারে।
হুমায়ূন ভাই দেরি না করে বলা শুরু করলেন, এখন একটা মজার কাণ্ড হবে।
তোমরা এই লিচু গাছে উঠবে। তারপর যত পারো লিচু খাবে। আমি ওয়ান, টু, থ্রি বলব তোমারা লিচু গাছে উঠা শুরু করবে। ঠিক আছে?
সবাই আনন্দে হইহই করে বলল, ঠিক আছে।
হুমায়ূন ভাই সাথে সাথে বললেন, ওয়ান, টু, থ্রি।
মাঝারি সাইজের লিচু গাছ। ছেলেমেয়েরা অতি দ্রুত গাছে উঠে লিচু খাওয়া শুরু করল। হুমায়ূন ভাই অবাক হয়ে ছেলেমেয়েদের লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন। গাছের পাকা লিচু তারা খাচ্ছে আর হইচই করছে। কেউ আবার পকেটে ভরছে। যে কয়জন গাছে উঠতে পারে না তাদের জন্য নিচে ফেলছে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য!
হুমায়ূন ভাই এক সময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালোলাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়?
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালোলাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।
হুমায়ূন ভাই আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, শোনো ফারুক একে বলে আকাশসমান ভালোলাগা। একে বলে আকাশছোঁয়া ভালোবাসা।
সূত্র: লেখাটি নেওয়া হয়েছে অভিনেতা ফারুক আহমেদের বই 'আমার না বলা কথা' থেকে।