সাবান কীভাবে ময়লা পরিষ্কার করে
অনেক বছর আগের কথা। পাঁচ হাজার বছর তো হবেই! কোনো এক পূর্বপুরুষ মাংস রান্না করছিলেন। এমন সময় কিছু মাংস চুলার আগুনে পড়ে যায়। মাংসে ছিল চর্বি। চর্বি চুলায় পড়ে ছাইয়ের সঙ্গে মিশে একটা অন্যরকম জিনিস তৈরি হয়। এই জিনিস দিয়ে কোনো কিছুকে ঘষলে সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়। শুনতে ম্যাজিকের মতো। গল্পটা অবশ্য রূপকথার গল্পের মতো। আসলেই হাজার পাঁচেক বছর আগে এমন হয়েছিল কি না, নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে এটা ঠিক, ৫ হাজার বছর আগে প্রাচীন ব্যাবিলনে (বর্তমান ইরাক) প্রথম সাবান আবিষ্কার হয়েছে। সেই সাবান ওপরের গল্পের সাবানের মতোই।
এরপর ধীরে ধীরে সারা বিশ্বের মানুষ সাবান ব্যবহার করতে শুরু করে। এখন কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন সাবান ব্যবহার করলেও বেশিরভাগ মানুষ জানে না, সাবান কীভাবে কাজ করে! মানে গায়ে সাবান মাখলে কেন ময়লা পরিষ্কার হয়ে যায়! এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন একজন রসায়নবিদ। পপুলার সায়েন্সে লেখা তাঁর সেই সাবানের রহস্য তোমাদের সামনে এখন তুলে ধরছি।
পরিষ্কারের পেছন যা আছে
পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু এর আসল নাম ডাই-হাইড্রোজেন মনোঅক্সাইড। জটিল নাম শুনে ভেবো না এটা অন্য কোনো পানি। আমরা নিয়মিত যে পানি খাই, ওটারই বৈজ্ঞানিক নাম। পানির সংকেত তো তোমরা জানো, H₂O। এই সংকেতের মানে হলো, পানিতে দুটো হাইড্রোজেন আর একটা অক্সিজেন পরমাণু থাকে। এই ছোট্ট অণু আমাদের পৃথিবীর সব জীবের জন্য খুব দরকারি।
রসায়নবিদরা অণুকে দুই ভাগে ভাগ করেন। যেসব অণু পানির সঙ্গে মিশতে পারে, সেগুলোকে বলে হাইড্রোফিলিক। আর যারা পানিতে মিশতে চায় না, তাদের বলে হাইড্রোফোবিক। যদি তোমরা শুধু পানি দিয়ে হাত ধোও, তাহলে তোমাদের হাতের সঙ্গে লেগে থাকা অনেক হাইড্রোফিলিক ময়লা হয়তো চলে যাবে। কিন্তু তেল বা গ্রিজের মতো হাইড্রোফোবিক ময়লা শুধু পানিতে যায় না। কারণ, তেল আর পানি কখনোই মেশে না। ঠিক এখানেই সাবান আমাদের সাহায্য করে!
সাবান হলো একটা জটিল অণু। মানে সাবান একইসঙ্গে হাইড্রোফিলিক ও হাইড্রোফোবিক। দেখতে অনেকটা ব্যাঙাচির মতো। সাবানের অণুর একটা গোল মাথা আর লম্বা লেজ থাকে। মাথাটা হলো হাইড্রোফিলিক আর আর লেজটা হাইড্রোফোবিক। এই বিশেষ গুণের কারণেই সাবান পিচ্ছিল হয়। আর এটাই সাবানকে ময়লা ধুয়ে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে।
তোমাদের কাছে মাইক্রোস্কোপ থাকলে একটা পরীক্ষা করা যেত। তবে তুমি পরীক্ষা করে দেখতে না পারলেও বিজ্ঞানীরা কিন্তু ঠিকই পরীক্ষা করেছেন। সেগুলোর ছবিই তোমাদের দেখাচ্ছি। চলো দেখি, সাবান আর পানি দিয়ে হাত ধুলে আসলে কী ঘটে।
সারাদিনে তোমরা যা কিছু ধরো, তার অনেক ময়লা তোমাদের হাতে লেগে থাকে। খাবারের দাগ, মাঠের কাদা, এমনকি তোমাদের শরীরের ঘাম আর তেলও থাকে। এই ময়লাগুলোর মধ্যে কিছু অণু হাইড্রোফিলিক, আর কিছু হাইড্রোফোবিক। ধুলা আর মরা চামড়ার কোষ হলো হাইড্রোফিলিক। আমাদের শরীরের তেল হলো হাইড্রোফোবিক। আর বাইরের যে ময়লা হাতে বা শরীরে লাগে, তার মধ্যে দুটোই থাকতে পারে।
যদি তোমরা শুধু পানি দিয়ে হাত ধোও, তাহলে অনেক ময়লা কিন্তু থেকেই যাবে। কারণ পানি শুধু হাইড্রোফিলিক ময়লাগুলোকেই ধুয়ে নিতে পারে। কিন্তু যখন তোমরা একটু সাবান ব্যবহার করো, তখন পুরো ব্যাপারটা বদলে যায়! কারণ সাবানের অণুতে একই সঙ্গে হাইড্রোফিলিক ও হাইড্রোফোবিক গুণই আছে।
সাবানের অণুগুলো একসঙ্গে মিলে মাইসেল নামে এক ধরনের গঠন তৈরি করে। অনেকটা ময়লার চারপাশে বুদ্বুদের মতো। এই বুদ্বুদের ভেতরের দিকে থাকে সাবানের হাইড্রোফোবিক লেজগুলো। এগুলো ময়লার হাইড্রোফোবিক অংশকে ধরে রাখে। আর বুদ্বুদের বাইরের দিকে থাকে সাবানের হাইড্রোফিলিক মাথাগুলো। এগুলো পানির সঙ্গে মিশতে পারে। এভাবেই সাবান ময়লাগুলোকে ধরে ফেলে, আর যখন তোমরা পানি দিয়ে হাত ধোও, তখন সেই ময়লার বুদবুদগুলো পানির সঙ্গে ভেসে চলে যায়!
ভালো করে পরিষ্কার হওয়ার জন্য অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান মেখে হাত ধোয়া উচিত। দুই হাত ঘষাঘষি করলে সাবানের অণুগুলো ময়লার ভেতরে ভালোভাবে ঢুকে এগুলো ভেঙে ফেলে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলতে পারে।
তবে শুধু ময়লা নয়, সঙ্গে আমাদের শরীরে অনেক ছোট ছোট জীবও লেগে থাকে। যেমন, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস আর ছত্রাক। এদের বেশিরভাগই ক্ষতিকর নয়, বরং কিছু আমাদের অসুস্থ হওয়া থেকে বাঁচায়। কিন্তু প্যাথোজেন নামে কিছু জীবাণু আছে, সেগুলো আমাদের অসুস্থ করতে পারে।
এছাড়াও, কয়েকদিন গোসল না করলে আমাদের শরীর থেকে গন্ধ বের হয়। কারণ, কিছু ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরের জৈব অণুগুলোকে ভেঙে দুর্গন্ধ তৈরি করে। এই জীবাণুগুলোর চারপাশে একটা সুরক্ষা স্তর থাকে। এই স্তরকে বলে মেমব্রেন। কিন্তু সাবান আর পানি সেই মেমব্রেন ভেঙে জীবাণুগুলোকে মেরে ফেলে। তারপর পানি সেই মরা জীবাণু আর গন্ধকে ধুয়ে নিয়ে যায়!
আসলে সাবান যে মানবসভ্যতাকে কতটা বদলে দিয়েছে, তা বলে বোঝানো কঠিন। হাজার হাজার বছর ধরে এটা কোটি কোটি মানুষকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করেছে। তাই পরেরবার হাত ধোয়ার সময় অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুতে ভুলো না!
সূত্র: পপুলার সায়েন্স