ছাপাখানা থেকে বই: ম্যানুটিয়াসের যত কীর্তি

এত এত লেখা, এত শব্দ, এত কবিতা—তোমার কাছে এগুলো কীভাবে এসেছে বলো তো? ঠিক বলেছ। ‘বই’। একটা বই তোমার মাঝে এগুলো পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু বইটাই এলো কোথা থেকে? কীভাবে শুরু হলো বইয়ের জীবন, সেটা কিন্তু এক মজার প্রশ্ন।

তোমার এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের যেতে হবে ইতিহাসের পাতার কয়েক শ বছর আগে। লেখার প্রথম ধাপ শুরু মিশরে। এরপর ছাপাখানা চালু হয় চীনে। কেই ল্যান নামের এক চীনা যাজক এটা ব্যবহার করে ধর্মীয় মহাপুরুষদের বাণী ছাপিয়ে রাখতেন। এরপর ধীরে ধীরে নানা সামাজিক প্রয়োজন ও তথ্য সংগ্রহে ভূমিকা রাখতে শুরু করে ছাপাখানা। ছাপাখানার প্রভাবে চীনে জ্ঞানচর্চার মাত্রা বেড়ে গেলেও ইউরোপের পথে এসে বদলে যায় ছাপাখানার রূপ।

১৫৩৮ সালে জোহান্স গুটেনবার্গ নামের এক ব্যক্তি ব্যবসার জন্য ইউরোপে নিয়ে আসেন পরিবহনযোগ্য ছাপাখানা। ইতালির ভেনিসে সেই সময় হুলুস্থুল কাণ্ড বেধে যায়। শহরজুড়ে যেকোনো ঘোষণা ছাপানো হতে থাকে দেদার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার থাকার জন্য এই শহরের মানুষেরা একটু একটু করে নিজেদের অধিকারের কথা বলতে শুরু করেন, যার বাহক ছিল এই ছাপাখানা। নানা রকম ছাপার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি হতে থাকে একেক রকম টাইপোগ্রাফি। টাইপোগ্রাফি বলতে বোঝায় নানা রকম ভঙ্গিমায় কোনো ভাষা লেখা।

ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী হওয়ার কারণে সেই সময়ে ভেনিসে বাণিজ্যিক সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়। আয়ের সুযোগ বাড়ার কারণে সারা বিশ্ব থেকে ব্যবসায়ী, শিল্পীসহ জ্ঞানী মানুষেরা আসতে থাকেন ভেনিসে। যার ফলে ক্রমে ছাপাখানার প্রসার ঘটতে থাকে। প্রতিবছর নিত্যনতুন বিষয়ে ছাপানো হতে থাকে নানা রকম বই, চটি কিংবা দেয়ালে সাঁটা পোস্টার। অনেকে আবার নিজেরাই একটা ছাপার মেশিন কিনে ছাপাখানা চালু করেন।

কন্সটাইন ল্যাসকারিসের লেখা বই এরেটোমাটা।
জ্ঞানীদের বইয়ের পাতায় নিজের ছাপা নাম না থাকলেও, ম্যানুটিয়াস কিন্তু অন্য উপায়ে ইতিহাসের পাতায় নিজের জায়গা করে নেন। তিনি শুধু জ্ঞানী ব্যবসায়ীই নন, পাশাপাশি একজন স্বপ্নদ্রষ্টাও ছিলেন।

তাঁদের ভেতর একজন ছিলেন অ্যালডাস ম্যানুটিয়াস। রোমের ব্যাসিয়ানো শহরে থাকা এ মানুষটি চলে আসেন ভেনিসে। ভেনিসে মুক্ত জ্ঞানচর্চার সুযোগ আকৃষ্ট করেছিল তাঁকে। সেই মোহেই তিনি শুরু করেন অ্যালডিন প্রেস। ১৪৯৫ সালে ম্যানুটিয়াস প্রকাশক হিসেবে তাঁর প্রথম বই প্রকাশ করেন। সেটি ছিল ভাষা গবেষক কন্সটাইন ল্যাসকারিসের লেখা বই এরেটোমাটা। অনেক ইতিহাসবিদই বলেন যে ম্যানুটিয়াসের চেষ্টাতেই বইয়ের জনপ্রিয়তা বাড়ে গোটা ইউরোপে। প্রাচীন গ্রিক ও লাতিন ভাষার ওপর নানা গবেষণামূলক বই তখন প্রকাশিত হতে থাকে অ্যালডিন প্রেস থেকে। দার্শনিক ডেসিডেরিয়াস ইরাসমাস, ইতিহাসবিদ পিয়েট্রো বেম্বো ও ঔপন্যাসিক জিওভানি পিকো ম্যানুটিয়াসের ছাপাখানা থেকেই বই প্রকাশ করতেন। তাঁদের বই ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

জ্ঞানীদের বইয়ের পাতায় নিজের ছাপা নাম না থাকলেও, ম্যানুটিয়াস কিন্তু অন্য উপায়ে ইতিহাসের পাতায় নিজের জায়গা করে নেন। তিনি শুধু জ্ঞানী ব্যবসায়ীই নন, পাশাপাশি একজন স্বপ্নদ্রষ্টাও ছিলেন। সব প্রকাশক যখন বিশালাকার শিট কাগজে বই ছাপাচ্ছেন, তখন ম্যানুটিয়াস প্রথম ছোট আকারের বই ছাপানোর কথা চিন্তা করেন। পাঠক যেন সব সময় বই সঙ্গে রাখতে পারে, সেটাই ছিল ম্যানুটিয়াসের চাওয়া। তিনি ওই সময়কার শিট কাগজকে আট ভাগ করে, সেই আকারে বই প্রকাশ করলেন। এই আকৃতির বইয়ের নাম দিয়েছিলেন তিনি ‘ফরম্যাটো ইন অট্যাভো’। এই আকৃতির বইকে এখন আমরা বলি পেপারব্যাক। বিদেশি লালচে কাগজের ছোট বইগুলোই কিন্তু ওই পেপারব্যাক। ওজন কমে ছোট আকারে আসায় এবার ইউরোপে ছাপা বই সহজেই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে সারা বিশ্বে।

পাঠককে সব রকম সুবিধা দিতে নানা রকমভাবে চেষ্টা করতে থাকেন ম্যানুটিয়াস। এবার তাঁর নজর পড়ে টাইপোগ্রাফিতে। গুটেনবার্গের সময় থেকে প্রেসগুলো গোথিক টাইপ নামের এক মোটা ফন্টে বই ছাপাত। কিন্তু ম্যানুটিয়াস তাঁর প্রেসে ব্যবহার করতেন ‘অ্যালদিনো’ নামের এক বিশেষ ফন্ট। এটি ছিল সরু দাগের। কয়েক বছরের চেষ্টায় ইতালির ফ্রান্সেসকো গ্রিফোর সঙ্গে মিলে ম্যানুটিয়াস অ্যালদিনো ফন্টকে এক নতুন রূপ দেন, যা এখনকার ইতালিক ফন্ট। তিনি লক্ষ করলেন, এই ফন্ট সরু দাগের, হালকা ধাঁচের। বইয়ে কম জায়গায় এই ফন্ট ব্যবহার করে বেশি শব্দ ছাপানো যায়।

ইতালিতে তখন নানা দেশের জ্ঞানী ব্যাক্তিদের সমাগম ঘটে বই প্রকাশনায় যুক্ত হওয়ার জন্য।

অ্যালদিনো ফন্ট আর ফরম্যাটো ইন অট্যাভো মিলে ছাপাখানার বইকে সারা বিশ্ব ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন ম্যানুটিয়াস। এর আগে বই ছিল অভিজাতদের ঘরে। কিন্তু ম্যানুটিয়াস কম দামে, যত্রতত্র পরিবহনযোগ্য বই ছাপিয়ে, জ্ঞানচর্চার পথ উন্মুক্ত করে দিলেন সবার জন্য। সব বয়সের মানুষই কমবেশি বই পড়তে শুরু করলেন। তাঁকে অনুসরণ করলেন দ্য সিসে, দ্য গিউন্টা, দ্য স্কোটো ও দ্য জিওলোটোর মতো প্রকাশকেরা। ১৫-১৬ শতকে সারা ইউরোপে চালু হয় ছোট-বড় প্রায় ২৫০টি ছাপাখানা, যারা প্রায় ২৫ হাজার বই প্রকাশ করে। ইউরোপ সারা বিশ্বে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে জ্ঞানচর্চার প্রাণবিন্দু হিসেবে।

জ্ঞানীগুণী মানুষ, সম্পাদক, লেখক, অনুবাদকসহ বই নিয়ে নানা পেশার মানুষের সমাগম হতে থাকে ভেনিসে। পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে পৃথিবীর সব থেকে বড় ও সমৃদ্ধ জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। নানা জাতির, ভাষার, বর্ণের, গোত্রের মানুষ এক হতে শুরু করে এখানে। তাঁদের সম্মিলিত চেষ্টায় গ্রিক, হিব্রু, জার্মান, আরবি, আর্মেনিয়ানসহ গ্ল্যাগোলিটিক ভাষায় অনুবাদ হতে থাকে বিশ্বের সব নামকরা সাহিত্য, গবেষণা ও দর্শনের বইগুলো।

এদের ভেতর ছাপাখানার সঙ্গে সবচেয়ে আপন হয়ে ওঠে আর্মেনিয়ানরা। তাঁরা কারিগরিভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার কারণে সহজেই বানাতে পেরেছিলেন এই মেশিনগুলো। তাঁরা এই জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন সবার মধ্যে। এখনো ভেনিসে অনেক ছাপাখানা চালান এই আর্মেনিয়ানরা। তাঁদের ওখানে প্রতিবছরই অনেকে শিখছে কীভাবে বই বানাতে হয়, মলাট বানাতে হয়, ছাপাতে হয় ইতিহাসের শব্দগুলো। তাই তাঁদের মধ্যেই এখনো বেঁচে থাকেন ইতিহাসের সেই ম্যানুটিয়াস।

আরও পড়ুন