গত পর্বে ল্যাবরেটরি বানানোর কথা বলেছিলাম। কী অবস্থা সেটার? কী কী জোগাড় করতে পেরেছ? যা যা জোগাড় হয়েছে, তার তালিকা করেছ তো? লিখে রেখেছ তোমার জার্নালে? জার্নালে লেখার সময় কোনটা কত তারিখে তোমার ল্যাবরেটরিতে ঢুকল, কবে শেষ হলো, আর কবে হারিয়ে গেল, তা–ও কিন্তু লিখে রাখতে হবে।
সামনেই শীতকাল, একজন বিজ্ঞানী হিসেবে কী চিন্তা করছ? বিজ্ঞানী হলে তোমাকে চারপাশ দেখতে হবে। মনে তৈরি হওয়া প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। শীত ও শীতকাল নিয়ে একটু ভাবো তো। কী কী প্রশ্ন আসে তোমার মনে? এই প্রশ্নগুলো গুছিয়ে লিখে ফেলো তোমার জার্নালে।
এবার প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার পালা। চেষ্টা করো চিন্তা করেই উত্তর বের করতে। যে প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে, সেগুলোতে টিক দাও। যেগুলোর উত্তর পাবে না, মাঝেমধ্যে জার্নাল খুলে সেগুলো দেখো। প্রশ্নগুলো মাঝেমধ্যে দেখলে ওগুলোর উত্তর অবচেতনে খুঁজবে তোমার মাথা। এখন আমরা দেখব একটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার বুদ্ধি।
জ্বর বা ছোটখাটো অসুখ হলে তুমি যখন ডাক্তারের কাছে যাও, তিনি তোমার হাতে ধরে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করেন। কী বুঝতে চান তিনি? তিনি মূলত পালস রেট মাপেন। আমাদের হৃৎপিণ্ড রক্ত পাম্প করে। হৃৎপিণ্ডের এই ওঠানামাকে বলে হৃদস্পন্দন। যেহেতু সারা শরীরে রক্ত চলাচল করে, তাই তুমি চাইলে এক হাত দিয়ে অন্য হাতের ধমনীর রক্ত চলাচল বুঝতে পারবে। এক মিনিটে কতবার হার্টবিট হচ্ছে, তা–ই হলো পালসরেট। প্রশ্নটা হলো, এই পালসরেট কি সবার জন্য সমান?
পালসরেট বের করা খুব সোজা। একটা ঘড়ি হলেই তুমি বের করে ফেলতে পারবে। এক হাতের তর্জনী আর মধ্যমা, এই দুটো আঙুল দিয়ে অন্য হাতের মাঝের ধমনী চেপে ধরো ডাক্তারের মতো। প্রথমে পালস বুঝতে একটু অসুবিধা হবে। ২০-৩০ সেকেন্ড ধরে রাখলে বুঝতে পারবে, কিছু একটা কেঁপে উঠছে। ওটাই পালস। এবার দেখো এক মিনিটে মোট কতবার কেঁপে ওঠে। সহজ বুদ্ধি হলো, ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা কোথায় আছে দেখে পালস গুনতে শুরু করা। সেকেন্ডের কাঁটা আবারও আগের জায়গায় ফিরে এলে গোনা বন্ধ করে দাও। যে সংখ্যা গুনলে, সেটাই তোমার পালসরেট। আমি মাত্রই গুনে দেখলাম, এখন আমার পালসরেট ৮০।
পালসরেট গুনতে কিন্তু তোমাকে এক মিনিটই হাত ধরে বসে থাকতে হবে না। বুদ্ধি করে তুমি ১৫ সেকেন্ডে কতটা পালস হয় তা গুনে দেখো। এরপর একে ৪ দিয়ে গুণ দিলেই তো পেয়ে যাবে এক মিনিটের পালস।
একটা কাজ করো তো, তোমার পালসরেট আবারও বের করো। কত এসেছে? একটু আগে বের করা পালসরেটের সমান? নাকি ভিন্ন কিছু? আমি মাত্রই আবারও মাপলাম। এবার পেলাম ৮২। একটু আগেই ছিল ৮০, এখন ৮২। হচ্ছেটা কী? আসলে আমরা যেকোনো কিছু মাপতে গেলেই নানান কারণে পরিমাপটা একটু এদিক–সেদিক হয়।
এ কিন্তু ভারি ঝামেলা! আমার পালসরেট তাহলে কত? আমি আবারও মাপলাম উত্তরটা পেতে। এবার এল ৮১। এ দেখি আরও বিপদ। পালসরেট তাহলে ৮০, ৮১ নাকি ৮২?
এই সমস্যা এড়াতে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেন যেকোনো কিছু কয়েকবার মাপতে। সাধারণত তিনবার মাপাকেই যথেষ্ট মনে করা হয়। তারপর তিনবারের পাওয়া তথ্যগুলোর গড় করা হয়। খাঁটি বিজ্ঞানীর মতো আমার পালসরেট বের করতে যোগ করতে হবে ৮০+৮১+৮২=২৪৩। যেহেতু তিনটা সংখ্যা যোগ করেছি, তাই ভাগ করতে হবে ৩ দিয়ে। অর্থাৎ ২৪৩-৩=৮১। এর মানে আমার পালসরেট ৮১ বিপিএম। ওহো, বলাই তো হয়নি, বিপিএম হলো পালসরেটের একক। বড় করে বললে বিটস পার মিনিট (বিপিএম)।
এবার আসা যাক আমাদের আসল প্রশ্নে। সবার পালসরেট কি সমান? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে কী করতে হবে? কিছু মানুষের পালসরেট মেপে দেখতে হবে।
বিজ্ঞানীরা উত্তর খুঁজতে পরীক্ষামূলক নকশা করেন। আমাদেরও উচিত এই প্রশ্নের উত্তর বের করতে একটা নকশা করা। আগে একটা সম্ভাব্য উত্তর ধারণা করে নিতে হয়। একে বলে হাইপোথিসিস দেওয়া। পরীক্ষামূলক নকশার জন্য একটা হাইপোথিসিস ধরতে হবে। তারপর পরীক্ষা করতে হবে, হাইপোথিসিসটা সত্য কি না। সত্য হলে তো উত্তর পেয়েই গেলাম। আর সত্য না হলে জানলাম, অন্য হাইপোথিসিস লাগবে।
চলো, আমরা হাইপোথিসিস দিই, মানুষভেদে পালসরেট ভিন্ন হবে। এখন প্রশ্ন হলো, এই পার্থক্যটা কাদের মধ্যে হবে? ছোট-বড় কোনো পার্থক্য হবে? ছেলে-মেয়ে? খেলার মাঠে দৌড় দিলে আমরা কিছুক্ষণ হাঁপাই। তখন কি পালসরেট বেড়ে যায়? অর্থাৎ পরিশ্রম করলে কি পালসরেট বাড়ে?
এখানে দেখো, তিনটা ভিন্ন ক্ষেত্র আমরা পেলাম। তুমি যদি তিনটাই একই সঙ্গে বের করতে যাও, তাহলে কঠিন হবে। এমন অনেকগুলো ব্যাপার ঘটার সম্ভাবনা থাকলে আমরা প্রথমে যেকোনো একটা বেছে নিই। যেমন প্রথমে বেছে নেওয়া যাক ‘ছেলে-মেয়ে’। এ ক্ষেত্রে বয়স আর পরিশ্রম দুইটা ব্যাপার পরিবর্তন করা যাবে না। তোমার কাছাকাছি বয়সের কয়েকজন বন্ধুর পালসরেট মাপো। এর মধ্যে কয়েকজন ছেলে ও কয়েকজন মেয়ের পালসরেট নিতে হবে। মনে আছে তো, একবার পালসরেট নিলেই কিন্তু হবে না, তিনবার নিয়ে গড় করে বের করতে হবে। একজন ছেলে আর একজন মেয়ের পালসরেট মাপলেই কিন্তু তুমি নিশ্চিত হতে পারবে না। প্রত্যেক দফায় অন্তত তিন-চারজনের পালসরেটের তথ্য নিতে হবে। কী পেলে, কোনো পার্থক্য কি পেয়েছ?
এবার পরের ধাপে যাওয়া যাক। এবার দেখব বয়সের কারণে পালসরেটে কোনো পরিবর্তন আসে কি না। আগের এক্সপেরিমেন্টে যদি ছেলেমেয়ের মধ্যে পালসরেটে পার্থক্য পেয়ে থাকো, তাহলে এই ধাপে উচিত হবে শুধু ছেলে বা মেয়ে নেওয়া। যাতে তুমি নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারো, ছেলেমেয়ে হওয়ার কারণে ফলাফলে পার্থক্য এলে তা বয়সের পার্থক্য বোঝার জন্য ঝামেলা তৈরি না করে।
তোমার বাবা-চাচা বা মা-খালা, যাদের পালসরেট মাপতে পারো, মেপে নাও। তারপর একই সময়ে তোমার, তোমার বন্ধুদের কয়েকজনের পালসরেট মাপো। আগের মতো ছক করে তথ্যগুলো লেখো। মনে আছে তো, প্রতিজনের অন্তত তিনবার পালসরেট নিয়ে গড় বের করতে হবে। এবার তো সহজেই বের করে ফেলতে পারবে, বয়সের কারণে পার্থক্য হয় কি না।
পালসরেট নিয়ে অনেক কথা হলো, এই তথ্যগুলো সম্ভব হলে বের করো। এই তথ্যগুলো বের করতে গেলে তুমি নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। সেগুলো জয় করতে হবে, তবেই তুমি বিজ্ঞানী।
অ্যাকটিভিটি ২.১: তোমার নিজের পালসরেট
তোমার পালসরেট বের করতে নিচের ছকটা ব্যবহার করো।
অ্যাকটিভিটি ২.২: ছেলে নাকি মেয়েদের পালসরেট বেশি?
নিচের ছকটা ব্যবহার করতে পারো ছেলেমেয়ের পালসরেটে কোনো পার্থক্য আছে কি না, বের করতে। আমি চারজনের তথ্য নেওয়ার ফাঁকা ঘর দিয়েছি, তোমার সুযোগ থাকলে আরও অনেক বেশিজনের তথ্য নিতে পারো।
অ্যাকটিভিটি ২.৩: বয়স্কদের পালসরেট কি বেশি?
এই অ্যাকটিভিটির তথ্য সংগ্রহের জন্য ছকটা কেমন হবে, তুমি নিজেই নিশ্চয় বের করতে পারবে। চেষ্টা করে দেখো।
অ্যাকটিভিটি ২.৪: পরিশ্রম করলে কি পালসরেট বাড়ে?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য ছোট্ট একটা বুদ্ধি দিই, তুমি এবং তোমার কয়েকজন বন্ধু, সিঁড়ি দিয়ে তিন বা চারতলা ওঠার আগে একবার এবং পরে একবার পালসরেট নিয়ে দেখো, পালসরেটে পরিবর্তন হয় কি না। এবার ছকটা বানাও। নিজেই করো বাকি এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন।
অ্যাকটিভিটি ২.৫: আরও প্রশ্ন
পালসরেট নিয়ে আরও কতগুলো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারো। সুস্থ আর অসুস্থ থাকার সময় পালসরেটে কী পরিবর্তন হয়। পালসরেট কত হলে ভালো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অবশ্য তোমাকে একটু পড়াশোনা করতে হবে। হাতের শিরা না ধরে আর কীভাবে পালসরেট মাপা যায়? হার্টবিট আর পালসরেট কি সমান? বুকের যে জায়গায় হৃৎপিণ্ড, সেখানে হাত দিলেই বুঝতে পারবে হার্টবিট।