বলের খোঁজে পরমাণুর গভীরে

ম্যাক্সওয়েল প্রাকৃতিক বলগুলোর একত্র করার যে পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন, অনেকটা একই রকম পথে হেঁটেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতা প্রকাশের আগে কতগুলো সিদ্ধান্তে আসেন। সেগুলো নিউটনের মহাকর্ষ বল আর গতীয় বলকে একত্রে গেঁথে ফেলে। ষষ্ঠদশ শতকে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও দেখান জড়তা আর গতি আসলে একই বলের দুটি আলাদা রূপ। তার মানে বস্তু যে স্থির থাকে, তার জন্য তার ভেতরে সঞ্চিত থাকে শক্তি। সেটাকে স্থিতিশক্তি বলে। এই শক্তিই জড়তার জন্য দায়ী। আর এই শক্তির জোগান দেয় বস্তুর ভর। বস্তুকে যদি গতিশীল করতে হয়, তাহলে এর স্থিতিশক্তিকে পরাজিত করতে পারে, এমন বল প্রয়োগ করতে হবে। সেটা হতে পারে ধাক্কা দিয়ে কিংবা কোনো যন্ত্রের সাহায্যে বল প্রয়োগ করে। বস্তুর ভেতর এই যে বল ঘুমিয়ে আছে, এটাই আসলে জড়তার বল।

সপ্তদশ শতাব্দীতে নিউটন দেখান মহাকর্ষ আর অভিকর্ষ আসলে একই বল। অর্থাৎ যে বলের কারণে গাছের আপেল মাটিতে পড়ে, সেই একই বলের কারণে পৃথিবী ঘোরে সূর্যের চারপাশে। এখানেও সেই একীভূত করার খেলা। সেই খেলাই আবার পরে খেলেন আইনস্টাইন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই তিনি বলেন, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গতি-জড়তার কারণে যত রকম যান্ত্রিক বল তৈরি হচ্ছে, সেগুলো আসলে মহকর্ষ বলেরই ভিন্ন রূপ। মহাকর্ষ বলহীন কোনো স্থানে গতি-জড়তার বল তৈরি হওয়া সম্ভব নয়।

গত শতাব্দীর তিরিশের দশক। কণা পদার্থবিজ্ঞানের জয়জয়কার তখন। বিজ্ঞানীরা তত দিনে নিশ্চিত নিউট্রন ও প্রোটন কণা দিয়েই গড়ে উঠেছে পরমাণুর নিউক্লিয়াস। কিন্তু এক উটকো ঝামেলা উদয় হয় তখন পদার্থবিদ্যার জগতে। সমস্যাটার সূত্রপাত তেজস্ক্রিয় পরমাণুর নিউক্লিয়াসে। এ ধরনের নিউক্লিয়াস তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করে। ফলে ভাঙন ধরে নিউক্লিয়াসে। সেই ভাঙনে এক মৌলের নিউক্লিয়াস বনে যায় সম্পূর্ণ আলাদা মৌলের আলাদা চরিত্রের নিউক্লিয়াসে। কেন এমনটা ঘটছে? কী এর রহস্য?

বিজ্ঞানীরা যখন ভেবে কূল পাচ্ছেন না, তখন ইতালীয়-মার্কিন বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি দিলেন সমাধান। বললেন, একধরনের বল এর জন্য দায়ী। সেই বলের কারণে ভেঙে যায় তেজস্ক্রিয় পরমাণুর নিউক্লিয়াস। আর নির্গত হয় তেজস্ক্রিয় রশ্মি। সেই বলের নাম দেওয়া হয় দুর্বল নিউক্লীয় বল। এই বল তেজস্ক্রিয় পরমাণুর নিউট্রনকে ভেঙে প্রোটনে পরিণত করে। সে কারণে তা থেকে নির্গত হয় বিটা রশ্মি। আর বিটা রশ্মি আসলে ইলেকট্রনের স্রোত। তাত্ত্বিকভাবে এসব ঘটনা বুঝতে হলে আমাদের কোয়ান্টাম তত্ত্বে যেতেই হবে। এই দুই ধরনের বল নিউক্লিয়াসের ব্যাসের সমান বা তার চেয়ে ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্য-সীমার মধ্যে কাজ করে।

(বাঁ থেকে) রিচার্ড ফাইনম্যান ও স্টিভেন ওয়াইনবার্গ

দুর্বল নিউক্লীয় বলের রহস্য সমাধানের জন্য ফার্মি কোয়ান্টামের জগতে হাত বাড়িয়েছিলেন। অনেক খেটেখুটে দাঁড় করিয়েছিলেন গাণিতিক খসড়া। খসড়া মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ও সহজবোধ্য ছিল। কিন্তু ত্রুটিও ছিল তাতে। মূল কণিকাগুলো গতিশক্তি কম হলে ফার্মির তত্ত্বে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু যেসব মূল কণিকা অনেক বেশি গতিশক্তি নিয়ে ছোটে, ফার্মি তত্ত্বে গন্ডগোল লেগে যায় তখন।

পরের ২০ বছরে কোয়ান্টাম মেকানিকসে আসে বৈপ্লবিক গতি। বিদ্যুতের গতিপ্রকৃতির জন্য গঠিত হয় কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। নাম তার কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকস। রিচার্ড ফাইনম্যান, জুলিয়েন সুইংগার ও সিন-ইটিরো তোমোনাগা এর পেছনের কারিগর। কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকসের কণিকাদের চরিত্র ব্যাখ্যা করে। সম্পর্ক তৈরি করে আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা আর কোয়ান্টাম বলবিদ্যার। ইলেকট্রনের মতো খুদে কণাদের গতিপ্রকৃতি ও বিদ্যুৎ–চুম্বক বলের কোয়ান্টাম ব্যাখ্যা দিতে পারে এই গতিবিদ্যা। কিন্তু ঝামেলা বাধে নিউক্লিয়াসের ভেতরে। প্রোটন ধনাত্মক চার্জযুক্ত আর নিউট্রন চার্জ নিরপেক্ষ। এদের মধ্যে তাই বৈদ্যুতিক আকর্ষণ বল থাকার কথা নয়। এরপরও নিউক্লিয়াসের ভেতরে এদের বন্ধন মজবুত। এর রহস্য কী? সঙ্গে যোগ হয় আরেকটি অদ্ভুত সমস্যা। একটা নিউক্লিয়াসের ভর এর ভেতরের প্রোটন ও নিউট্রনগুলোর আলাদা ভরের যোগফলের সমান হওয়ার কথা। কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখলেন, বস্তুর নিউক্লিয়াসে সেটা হয় না। নিউক্লিয়াসের ভর প্রোটন ও নিউট্রনগুলোর আলাদা ভরের যোগফলের সমান নয়। বেশ খানিকটা কম। তাহলে বাকি ভরটুকু গেল কোথায়?

এ সমস্যার সমাধান হয় আইনস্টাইনের ভর-শক্তির সমীকরণ থেকে। নিউক্লিয়াসের ভেতর থেকে নিউক্লিয়নগুলো আলাদা করতে হলে বিপুল পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়। এবার এই ব্যাপারটাকে উল্টো দিক থেকে হিসাব করলে দাঁড়ায়, নিউক্লিয়নগুলো নিজেদের ভেতর যখন বন্ধন তৈরি করে, তখন তারা ওই একই পরিমাণ শক্তি ছেড়ে দেয়।

(বাঁ থেকে) আবদুস সালাম ও শেলডন গ্ল্যাশো

এই শক্তি নিউক্লিয়নগুলো কোথায় পায়?

এই শক্তি উত্পাদন করার জন্য নিউক্লিয়নগুলো তাদের সামগ্রিক ভর কিছুটা কমিয়ে ফেলে। তাই নিউক্লিয়াসে ভর ঘাটতি দেখা দেয়। সেই ঘাটতি ভরটুকু আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2 অনুসারে বিপুল পরিমাণ শক্তিতে পরিণত হয়। সেই শক্তি দিয়েই নিউক্লিয়াসে ধনাত্মক চার্জযুক্ত প্রোটন আর চার্জনিরপেক্ষ তৈরি করে নিউট্রন পরস্পরের সঙ্গে শক্তিশালী বন্ধন। আবার সুগঠিত নিউক্লিয়াসকে ভাঙতে গেলে তাই সেই পরিমাণ শক্তি বাইরে থেকে প্রয়োগ করতে হয়। তখন নিউক্লিয়নগুলো সেই শক্তি গ্রহণ করে তাদের হারানো ভর ফিরে পায় এবং ভেঙে যায় তাদের নিউক্লীয় বন্ধন। তখন বেরিয়ে আসে আরেকটি বলের ধারণা, সেটা হলো সবল নিউক্লীয় বল। এই বলই আসলে আটকে রাখে প্রোটন আর নিউট্রনকে। এই বলকে ব্যাখ্যা করার জন্য জন্ম হয় কোয়ান্টাম ক্রোমোডায়নামিকসের। সবল নিউক্লীয় বল আর কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে বিজ্ঞানের এই শাখা।

আরও পড়ুন

তখন আরেকটা প্রশ্ন দেখা দেয়, সবল বলের জন্য যদি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রতিষ্ঠিত হয়, দুর্বল নিউক্লীয় বলের জন্য কেন নয়? এই ভাবনা যখন চলছে, তখনই আবিষ্কৃত হলো দুর্বল বলের এক আশ্চর্য ধর্ম। দুর্বল বলের কারণে বিটক্ষয় থেকে যে ইলেকট্রনের জন্ম হয়, সেগুলো কণিকার স্পিনিং ধর্ম ডান-বাঁয়ের সাম্যবস্থায় থাকে না।

একটা বিষয় জানা ছিল বিজ্ঞানীদের। ইলেকট্রন সব সময় নিজ অক্ষের ওপর লাটিমের মতো ঘোরে। যদিও কোয়ান্টাম মেকানিকস ঠিক লাটিমের মতো ঘোরার ব্যাপারটা সমর্থন করে না। তবু ব্যাপরটা যা দাঁড়ায়, তা কিছুটা হলেও লাটিমের মতো ঘূর্ণন বলে ধরে ধরে নেওয়া যায়। মোটকথা, ইলেকট্রনের একটা নিজস্ব ‘কৌণিক ভরবেগ’ থাকে, যার কারণ হচ্ছে ঘূর্ণনপ্রক্রিয়া বা স্পিন।

এই ঘূর্ণন দুই দিকে হতে পারে। ডানহাতি ও বাঁহাতি স্ক্রু নিয়মে। ডানহাতি স্ক্রু নিয়ম হলো, ডান হাতের সাহায্যে স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে স্ক্রু আটতে গেলে হাতটাকে যেভাবে ঘোরাতে হবে। আর বাঁহাতি স্ক্রু নিয়ম হলো, বাঁ হাতের সাহায্যে স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে স্ক্রু আটতে গেলে হাতটাকে যেভাবে ঘোরাতে হবে।

বিটা রশ্মি থেকে যেসব ইলেকট্রন বেরিয়ে যায়, সেগুলো পরীক্ষা করে আশ্চর্য ফল পেলেন বিজ্ঞানীরা। এই ইলেকট্রনগুলোর সবই বাঁহাতি স্ক্রু নিয়মে ঘোরে। এই আবিষ্কার ফার্মির তত্ত্বকে এগিয়ে দেয় আরও এক ধাপ। তবে ফার্মির তত্ত্বে নতুন বিষয়টা যোগ করার দরকার হয়—তত্ত্বটার মধ্যে একটা ডান-বাঁয়ের অসাম্য থাকতে হবে।

এ কাজে এগিয়ে এলেন চার-চারজন মার্কিন বিজ্ঞানী। জর্জ সুদর্শন, রবার্ট মার্শাক, মারে গেলমান ও রিচার্ড ফাইনম্যান। তাঁদের প্রচেষ্টায় আরও সুন্দর কাঠামো পায় ফার্মির তত্ত্ব। কিন্তু ইলেকট্রোয়নামিকস বা ক্রমোডায়নামিকসের মতো সর্বাঙ্গ সুন্দর কোয়ান্টাম তত্ত্ব তখনো পাওয়া যায়নি।

কোনো বিশেষ কারণে বিজ্ঞানীরা হন্যে হয়ে কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকসের আদলে দুর্বল প্রক্রিয়ার তত্ত্বকে সাজাতে চাইছিলেন? ধরা যাক, দুটি ইলেকট্রন ছুটে পরস্পরের কাছাকাছি আসে। কিন্তু তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিকর্ষণের ফলে আবার ছিটকে চলে যায় দুদিকে। এ রকম ঘটনা কী হারে ঘটতে পারে? ইলেকট্রনগুলোর কোনো বিশেষ দিকে ছিটকে যাওয়ার সম্ভাবনা কী রকম? অঙ্ক কষে এগুলোর উত্তর বের করতে গেলে ফল আসবে ‘অসীম’! এক-কে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে যেমন কোনো অর্থবহ ভাগফল পাওয়া যায় না। ইলেকট্রন ছিটকে যাওয়ার হার কষতে গেলে সে রকমই হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকস এই আশঙ্কা দূর করে। এর কতগুলো গাণিতিক বৈশিষ্ট্যও আছে, যার ফলে ওই জাতীয় উদ্ভট পরিণাম সব সময়েই এড়ানো যায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানীরা চাইলেন দুর্বল নিউক্লীয় বলকেও একই রকম গাণিতিক ছাঁচে ফেলতেন।

মার্কিন পদার্থবিদ শেলডন গ্ল্যাশো প্রথম এ ধরনের একটা গাণিতিক কাঠামো প্রস্তাব করালেন। ষাটের দশকে কিন্তু সেই কাঠামোকে সম্পূর্ণ চেহারা দিতে লেগে যায় বেশ কয়েক বছর। পাকিস্তানি-আমেরিকান পদার্থবিদ আবদুস সালাম ও মার্কিন বিজ্ঞানী স্টিফেন ওয়াইনবার্গ—এই দুজনের হাত দিয়ে সম্পূর্ণ চেহারাটা বেরিয়ে আসে দুর্বল বলের কোয়ান্টাম তত্ত্ব তড়িৎ-দুর্বল তত্ত্ব। সত্তর দশকের শুরুর দিকে দুই ডাচ বিজ্ঞানী জি টি হুফ ও এম ভেল্টম্যান নামের দুজন বিজ্ঞানী প্রমাণ করলেন, তত্ত্বটার গাণিতিক গঠন অভ্রান্ত। সুতরাং মহাবিশ্বের চারটি মৌলিক বলের দুটিকে একত্র করা সম্ভব হলো।

কিন্তু বিজ্ঞানীরা এতেও সন্তুষ্ট নন। মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব ব্যাখ্যায় সবচেয়ে সফল তত্ত্ব হলো বিগ ব্যাং থিওরি বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব। সেই তত্ত্বমতে, মহাবিশ্বের জন্মের সময় মহাকর্ষ, বিদ্যুৎ–চুম্বকীয়, সবল ও দুর্বল নিউক্লীয়—এ চারটি বলই একসঙ্গে ছিল। পরে বলগুলো আলাদা হয়েছে। কীভাবে আলাদা হয়েছে তা এখনো জানেন না বিজ্ঞানীরা। সেটা জানতে হলে আমাদের চারটি বলকে ঐক্যবদ্ধ করতে শিখতে হবে। আর সেটা তখনই সম্ভব যখন সাধারণ আপেক্ষিকতার সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা একীভূত করা সম্ভব হবে। আর সেই কাজটা করার দৌড়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে এগিয়ে আছে স্ট্রিং তত্ত্ব। স্ট্রিং তত্ত্বের গভীরে ঢুকতে হলে কোয়ান্টামের কিছু অদ্ভুতুড়ে আইনের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। কোয়ান্টামে মজার অদ্ভুত জগতের সঙ্গে আমরা পরিচিত হব আগামী কয়েকটি পর্বে।