বেজবাবা সুমন | একজন আয়রনম্যান

বেজবাবা সুমন—যেন এক আয়রনম্যান!অলংকরণ: সাদাত

‘সুমন ভাই, আপনার এত খারাপ অবস্থা! আমরা তো কিছুই জানি না।’ সাইদুস সালেহীন খালেদ সুমনের দিকে তাকিয়ে বললেন ইমিগ্রেশন অফিসার। ‘বেজবাবা’ নামে খ্যাত ব্যান্ড তারকা সুমন তখন স্ট্রেচারে শোয়া। শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। ফিরে এসেছে অসুখ। মেরুদণ্ডের ব্যথায় তিনি তখন প্রায় অচেতন। তার ওপর আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হবে তাঁকে। তার ঠিক আগমুহূর্তে ইমিগ্রেশন অফিসারের কথাটা শুনলেন অর্ধচেতন সুমন। অর্থহীন ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা, ভোকাল ও বেজিস্ট তিনি। দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করেছেন জীবনঘাতী ক্যানসারের সঙ্গে। জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন অসংখ্যবার, দমে যাননি কখনোই। কিন্তু এবার চোখ ছলছল করে উঠল তাঁর। মনে হলো, এবার বোধ হয় আর দেশে ফিরতে পারবেন না…জীবিত অবস্থায়।

কাগজপত্র যাচাইয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হলো সুমনকে। রানওয়ে থেকে ডানা মেলে উড়ল বিমান। সুমনের মনে হলো, কেন তিনি ভাবলেন বেঁচে ফিরতে পারবেন না? নিজের ওপরই রাগ হলো তাঁর। মনে মনে বলে উঠলেন, ‘নাহ্, পারব।’ ঠিকই পেরেছেন তিনি। জার্মানিতে দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে ফিরে এসেছেন দেশে। ফিরে এসেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গান আর অর্থহীন নিয়ে। এটাই চিরচেনা বেজবাবা সুমন—আমাদের আয়রনম্যান।

বেজবাবা সুমন
ছবি: পাভেল মহিতুল আলম

আয়রনম্যান বেজবাবা সুমনের খুব প্রিয় একটি চরিত্র। জনপ্রিয় এই মার্ভেল চরিত্রের ভক্ত তিনি—এমনটা জানার পর বিদেশি একটি গিটার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান আয়রনম্যান থিমে বেজ গিটার বানিয়ে পাঠিয়েছে বেজবাবা সুমনের জন্য। কিন্তু তিনি নিজেও কি আয়রনম্যান নন? ২০১২ সাল থেকে তাঁর শরীরে বারবার আঘাত হেনেছে ক্যানসার। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। অস্ত্রোপচার (সার্জারি) হয়েছে ৩৬ বার। কিন্তু প্রতিবারই সুমন ফিরে এসেছেন অসামান্য মনের জোর আর ভক্তদের ভালোবাসার টানে। ঠিক যেভাবে ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসে সুপারহিরোরা। কোনো রোগবালাই তাদের সাময়িকভাবে কাবু করলেও ঠিকই তা মোকাবিলা করে বেরিয়ে আসে তারা। বেজবাবা সুমনের গল্পটাও সে রকম। তাঁর মনোবল এতটাই দৃঢ় যে ক্যানসারের মতো মরণব্যাধিকেও পরাজিত করেছেন বারবার। ব্যান্ডের নাম অর্থহীন হলেও জীবনকে অর্থহীন হতে দেননি তিনি। উপভোগ করছেন প্রতিটি মুহূর্ত।

ঢাকার উত্তরায় বাড়ির বেজবাবা সুমনের বসার ঘরে বসে ‘কিশোর আলো’র সাক্ষাৎকারে বারবার ফিরে আসছিল এই গল্পগুলো। এ সময়ের কিশোর-কিশোরীদের কী বলবেন, তা নিয়ে শুরুতে একটু ইতস্তত বোধ করছিলেন। তিনি মনে করেন, এখনকার কিশোর-কিশোরীরা অনেক প্রতিভাবান। ‘আমরা অনেক বোকা ছিলাম’—বলে বসলেন তিনি। কেমন ছিল ছোটবেলা? এই প্রশ্নে যেন টাইম মেশিনে করে চলে গেলেন নিজের কৈশোরে।

হাওয়াইন গিটার থেকে স্প্যানিশ গিটার

মাত্র সাত বছর বয়সে হাওয়াইন গিটার দিয়ে গানের সঙ্গে বন্ধুত্ব সুমনের। এরপর ১০ বছর বয়সে সেই গিটার বাজান বিটিভিতে, শিশুশিল্পী হিসেবে। লাজুক হেসে বললেন, ‘হাওয়াইন গিটার কিছু মাস বাজানোর পর মনে হচ্ছিল, স্প্যানিশ গিটার বাজাই। তখন ব্যান্ড মিউজিক শুনতাম। কিন্তু বাড়িতে তো নতুন গিটার কিনে দেবে না। তখন শুনলাম, কিছু টাকা দিলে আমার হাওয়াইন গিটারকে স্প্যানিশ গিটার বানানো যাবে। তাই মায়ের কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে হাওয়াইন গিটারকে স্প্যানিশ গিটার বানিয়ে নিলাম। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়কার কথা। হাওয়াইন গিটার শিখেছিলাম মিসেস জামানের কাছ থেকে, কিন্তু স্প্যানিশ গিটার যে কোনো টিচারের কাছে শিখব, তেমনটা বাসা থেকে দেবে না জানতাম। আর তখন তো বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা ছিল না, বইও ছিল না যে দেখে দেখে শিখব। যেহেতু আমি গিটারে যেকোনো গানের সুর তুলতে পারতাম, ফলে নিজে নিজেই শিখে ফেললাম স্প্যানিশ গিটার বাজানো।’

ছোটবেলায় সুমন

গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ব্যান্ড গড়ে তোলেন সুমন। তখন ভাবলেন, নিজেরা মৌলিক গান করবেন। কোনো কভার গান করবেন না। শুরুতে ইংরেজিতে গান লিখে সুর করলেন। ‘গানগুলো আসলে খুব খারাপ হয়েছিল। তাতে কী, নিজেরা তো করেছি।’ হেসে বলেন সুমন।

১২ বা ১৩ বছর বয়সে বিখ্যাত ব্যান্ড আয়রন মেইডেনের একটি ভিডিও দেখেন তিনি। ব্রিটিশ এই ব্যান্ডটির বেজিস্ট স্টিভ হ্যারিসের বেজ বাজানো দেখেই সুমন ঠিক করে ফেললেন, তাঁকে বেজই বাজাতে হবে। আর লিড বাজাবেন না। কিন্তু বাড়ি থেকে তো অ্যাকুয়িস্টিক বেজ গিটার কিনে দেবে না। বুদ্ধি এল মাথায়। বেজ গিটার তো চার তারের। সুমন স্প্যানিশ গিটার থেকে দুটি তার খুলে ফেললেন। আয়রন মেইডেনের গানগুলো শুনে শুনে বেজ বাজানোর চেষ্টা শুরু করলেন তিনি।

স্টিভ হ্যারিস থেকে কমল

কিশোর সুমনের মনের মধ্যে তখনো একটা দ্বিধা, মনে হতো বাংলাদেশে এগুলো বাজানো কঠিন। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় একটা ঘটনা ঘুরিয়ে দিল সুমনের জীবনের মোড়। স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের একটি অনুষ্ঠান শেষে কনসার্ট হবে। ওই দিন স্কুল বন্ধ, সুমন লুকিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে ঢুকে পড়লেন কনসার্ট দেখতে। খোলা মাঠে কনসার্ট। রকস্ট্রাটা, ওয়ারফেজসহ আরও বেশ কিছু রক ব্যান্ড পারফর্ম করবে। সেখানে হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ে ছোটখাটো দেখতে একটা ছেলে দুর্দান্ত বেজ বাজাচ্ছে। বেজবাবার চোখ দিয়ে সেই কনসার্টের উত্তেজনা আমরাও দেখতে পাচ্ছিলাম। কারণ, সেদিনের সেই বেজিস্ট ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা গিটারিস্ট কমল। বেজবাবা সুমন গল্প বলেই চলেছেন, ‘আসলে কমল ভাইকে (ওয়ারফেজ ব্যান্ডের গিটারিস্ট) ওই দিন মনে হয়েছিল আমাদেরই বয়সী। আয়রন মেইডেনের সব গান তিনি এত অবলীলায় বাজাচ্ছিলেন, সেটা দেখে আমি পুরোপুরি প্রভাবিত যে আমাকে বেজ বাজাতেই হবে। আসলে আয়রন মেইডেনের স্টিভ হ্যারিসকে দেখে আমি প্রথম অনুপ্রাণিত হই বেজ বাজানোর জন্য। কিন্তু কমল ভাই-ই বাংলাদেশের একমাত্র শিল্পী, যাঁকে দেখে আমি বেজ বাজানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই দুজন আমাকে ভয়ংকরভাবে অনুপ্রাণিত করেন, তখন আমি শিওর যে আমি বেজ বাজাবই। আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না।’

জেমসের ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডে ১৯ বছর বয়সী সুমন (ডানে)
ছবি: ইমতিয়াজ আলম বেগ

ফিলিংসের ডাক

সুমন তখন পেরিয়েছেন স্কুলের গণ্ডি। এসএসসি পরীক্ষার পর তিন মাস অবসর। নিজের গিটার নিয়ে অনুশীলন করতেন, আর বন্ধুদের বেজ গিটার নিয়ে এসে বাজাতেন মাঝেমধ্যে। সেই সময় একদিন এক বন্ধু তাঁকে নিয়ে গেলেন তখনকার সুপারহিট ব্যান্ড ফিলিংসের প্র্যাকটিস প্যাডে। ব্যান্ড তারকা জেমসের সঙ্গে একটু হাই-হ্যালো হয়েছিল। তার কিছুদিন পরই এক বন্ধু ফোন করে সুমনকে বললেন, ‘জেমস ভাই তোকে ডেকেছেন।’

‘জেমস ভাই ডেকেছেন শুনে আমি বন্ধুকে বলেছিলাম, আমাকে কেন ডাকছে? তারপর আমি আরেক বন্ধুর কাছ থেকে বেজ গিটার নিয়ে গেলাম। জেমস ভাইয়ের দিলু রোডের বাসায় গিয়ে দেখি ফান্টি ভাই ড্রাম বাজাচ্ছেন, কি-বোর্ড বাজাচ্ছেন শাহীন ভাই আর গিটার বাজাচ্ছেন জেমস ভাই। আমাকে দেখে তিনি বললেন, “সুমন আসছ, বাজাও আমাদের সঙ্গে।” আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কী বাজাব ওনাদের সঙ্গে। যত দূর মনে পড়ে, গানটা ছিল রবার্ট ক্রের ‘ডোন্ট বি অ্যাফরেইড অব দ্য ডার্ক’। জেমস ভাই একটু বিরতি নিয়ে বাইরে গেলেন। আমি তখনো বাজাচ্ছিলাম কিন্তু খেয়াল করিনি কখন তিনি আবার রুমে ফিরে এসেছেন। জেমস ভাই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “জোশ... জোশ।” সেই ঘটনা আমার জন্য বিশাল বড় ব্যাপার, ভয়ংকর অনুপ্রেরণার। সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া একজন কিশোরকে জেমস ভাইয়ের মতো গিটারিস্ট মাথায় হাত বুলিয়ে ‘জোশ’ বলেছেন! কল্পনা করা যায় না।’

সে কারণেই ব্যান্ডের নতুনদের সব সময়ই খুব আন্তরিকভাবে, ভালোবাসা দিয়ে উৎসাহিত করেন বেজবাবা। অলটারনেটিভ মিউজিক বা আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড সবার পাশে থাকতে চান। একদিন তিনিও যে এমন ভালোবাসা আর উৎসাহই পেয়েছিলেন কিংবদন্তি জেমসের কাছ থেকে।

বেজবাবা নামটি কীভাবে এল? | ‘এটা খুবই আজব একটা ব্যাপার।’ প্রশ্নটি শুনেই জবাব দিলেন বেজবাবা। ‘১৯৯৭ এর শেষে যেদিন আমার ছেলে আহনাফের জন্ম হয়, সেদিন আমার এক ছাত্র আমাকে বলেছিল “কংগ্র্যাচুলেশন, বেজবাবা”।’ এই বাবা মানে ‘ফাদার অব বেজ’ নয়, বাবা হওয়ায় সুমনকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন তাঁর ছাত্র। সেখান থেকে অন্য ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে যায় নামটি। তাদের কাছে শুনে শুনে আশপাশের অনেকেই এই নামে ডাকা শুরু করেছিল তাঁকে। তারপর অর্থহীনের একটি কনসার্টে কিছু ছেলে ‘বেজবাবা! বেজবাবা!’ বলে চিৎকার শুরু করে। নামটি আরও ছড়িয়ে যায়। কিন্তু একটি গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল নামটি। কিছু দিন পর আইআরসি অ্যাকাউন্ট খোলেন সুমন। তখন সেই অ্যাকাউন্টের নিকনেম হিসেবে রাখেন ‘বেজবাবা’ নামটি। ২০০১ সালে নতুন রূপ পায় নামটি। অর্থহীনের বিবর্তন অ্যালবামের কাজ চলছিল তখন। অ্যালবাম কভারের দায়িত্বে ছিলেন ড্রামার শুভ। প্রচ্ছদের চূড়ান্ত ডিজাইন যখন অডিও প্রতিষ্ঠান জি সিরিজের কাছে যায়, তখন সুমন আবিষ্কার করেন তাঁর নামের পাশে লেখা ‘বেজবাবা’। তিনি বিস্মিত হয়ে শুভকে জিজ্ঞেস করেন, এখানে বেজবাবা এল কীভাবে? ‘নামটা ঢুকিয়ে দিয়েছি।’ হেসে বললেন শুভ। পাশ্চাত্য সংগীতে অনেক শিল্পীরই একটি ‘স্টেজ নেম’ থাকে। শুভ বললেন, ভাই, আপনি নামটা অফিশিয়াল করে ফেলেন। নামের পাশে ‘বেজবাবা’ দেখে কিছুটা বিব্রত হলেও সুমন ঠিক করলেন, ঠিক আছে, এখন থেকে আমার স্টেজ নেম বেজবাবা। যদিও নিজেকে ‘ফাদার অব বেজ’ মনে করেন না তিনি।’

ফিলিংসে সুমন বাজালেন আড়াই বছরের মতো। তখন একসঙ্গে বেশ কয়েকটি ব্যান্ডে বাজাচ্ছেন তিনি। ফিলিংস তত দিনে আরও পেশাদার ব্যান্ড হয়ে উঠেছে। ঠিকমতো সময় দিতে পারছিলেন না সুমন। আবার মাথায় মেটাল বাজানোর ভূত। ফিলিংস থেকে সরে দাঁড়ালেন নিজেই। এসেইসসহ বেশ কয়েকটা ব্যান্ডে বাজালেন। বেজিস্ট হিসেবে বেশ নামডাক হয়ে গেছে তাঁর। অনেক সলো শিল্পীর অ্যালবামেও বাজিয়েছেন সুমন। তারপর ১৯৯৬ সালে যোগ দিলেন ওয়ারফেজে। দুই বছর পর ছেড়ে দেন ওয়ারফেজও। শুধু ওয়ারফেজ নয়, গানবাজনাই ছেড়ে দিয়েছিলেন সুমন। বেজ গিটারসহ অন্যান্য ডিভাইস বিক্রিও করে দিয়েছিলেন।

অর্থহীনের শুরু

তিন মাস পরই সুমন বুঝতে পারেন কত বড় ভুল করেছেন তিনি। গান ছাড়া থাকার মানুষ নন তিনি। কাছের বন্ধুদের নিয়ে আবার শুরু করলেন শো করা। ১৯৯৮ সালে অক্টোবরে জন্ম হলো ‘অর্থহীন’-এর। সঙ্গে ছিলেন পনির, তন্ময়, পিকলু, শোভনসহ আরও অনেকে। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় অর্থহীনের প্রথম অ্যালবাম ‘ত্রিমাত্রিক’। অর্থহীনের লাইনআপে পরিবর্তন এসেছে বারবার। কিন্তু কারও সঙ্গেই বিরোধ নেই বেজবাবা সুমনের। সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব রয়েছে অটুট। অর্থহীন করার সময় দুবার বেজবাবা সুমনের চোখে পানি এসেছিল। প্রথমে অর্থহীন করার সময় কোনো একটা কারণে অর্থহীনকে কনসার্টে নেওয়া হতো না, কোনো একটা ব্যান্ড বা কেউ কেউ বলত, অর্থহীন বাজালে আমরা পারফর্ম করব না। ‘ওই সময় আমি কেঁদেছিলাম।’ স্মৃতি হাতড়ে বলেন সুমন। ‘আরেকবার চোখে পানি এসেছিল, যেদিন রাফা ব্যান্ড ছেড়ে দিল। আজ থেকে রাফা থাকবে না—এটা খুব কষ্টের ছিল। তবে রাফা ব্যান্ড ছাড়ার আগে খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করেছিল বিষয়টি। কোনো ভুল–বোঝাবুঝি ছিল না আমাদের মধ্যে। ওকে মিস করছিলাম।’

কিশোর আলোর জন্য অটোগ্রাফ দিতে ভুললেন না সুমন

ব্যান্ড সদস্যদের এই পরিবর্তনের ব্যাপারটিকে ইতিবাচকভাবেই দেখেন সুমন। ব্যান্ড যেহেতু পরিবারের মতো, ফলে এখানেও ভাঙা-গড়ার বিষয়টি থাকে। একেকজন একেক মানসিকতার। ফলে পরিবর্তন হবেই। ‘এই ব্রেকআপটা ভালো বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে হতে পারে, আবার খুব বাজেভাবেও হতে পারে। আমার ক্ষেত্রে এটা খুব ভালো বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে হয়েছে। ফলে আমি খুব ভাগ্যবান এ ব্যাপারে।’ বলেন সুমন।

ক্যানসারের নিশিকাব্য

সুমনের শরীরে প্রথম ক্যানসার ধরা পড়ে ২০১২ সালে। মেরুদণ্ডে দুটো টিউমার ছিল। তখন তিনি ক্যানসারের প্রথম পর্যায়ে ছিলেন। কিন্তু সেটাই সবচেয়ে বেশি ভাবিয়েছিল তাঁকে। ক্যানসারের পুরো ব্যাপারটি একা সামলেছেন বেজবাবা। প্রথম দুই সপ্তাহ নানা রকম চিন্তা মাথায় ঘুরছিল তাঁর। কান্নাকাটি করেছেন। কিন্তু পরিবারের কাউকে জানাননি। অপারেশনের পর সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন সুমন। কিন্তু এর কিছুদিন পর ২০১৩ সালে তাঁর পাকস্থলীতে ক্যানসার ধরা পড়ে। এবার তৃতীয় পর্যায়ে। বেশ খারাপ একটা ক্যানসার ছিল সেটা। রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি সবকিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তখন। একপর্যায়ে ক্যানসার থেকে বাঁচাতে তাঁর পাকস্থলীর ৮৫ শতাংশই কেটে ফেলে দেওয়া হয়। ভয়ংকর অবস্থা। কিন্তু তত দিনে ক্যানসারের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে বেজবাবা সুমনের। ভয়ংকর ক্যানসারটিকে তাই সহজভাবেই নিয়ে নেন তিনি। ফলে এই ক্যানসারও জয় করে ফিরে আসেন আবারও।

কিন্তু ক্যানসার তাঁর সঙ্গ ছাড়ে না। ২০১৬ সালে পুনরায় ফিরে আসে পাকস্থলীর ক্যানসার। চিকিৎসক পাকস্থলীর বাকি ১৫ শতাংশও কেটে ফেলে দেন। এই মুহূর্তে পাকস্থলী বলে কিছু নেই বেজবাবার। আছে ইনটেস্টাইন বা অন্ত্র। অর্থাৎ পাকস্থলীর কাজটা করে খাদ্যনালি। এর সঙ্গে যোগ হয় আরেকটি সমস্যা। মেরুদণ্ডের ভেতরে একটা হাড়ের টুকরা পড়ে আছে। সেটার কারণে প্রচণ্ড ব্যথায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি। সাড়ে তিন বছর বিছানায় শুয়ে থেকে ওজন বেড়ে যায় তাঁর। কিন্তু কোনো ধরনের ব্যায়াম করার মতো অবস্থায় ছিলেন না তিনি। এমনকি সাঁতার কাটাও ছিল অসম্ভব। অথচ চিকিৎসার উপযোগী করতে তাঁকে ওজন কমাতে হবে প্রায় ৩৫ কেজি। চিকিৎসক জানালেন, উপায় আছে দুটি। হয় অপারেশন করে শরীরের বাড়তি চর্বি কেটে ফেলা, অথবা খাওয়া প্রায় বাদ দিয়ে ওজন কমানো। কঠিন হলেও দ্বিতীয় অপশনটাই বেছে নিলেন সুমন। ‘খাওয়া কমানো—এটা তো আমি জানি। আগেও করেছি। তাহলে আমি না খেয়েই ওজন কমাব।’ ওই জেদ থেকেই ৫ মাসে ৩৫ কেজি ওজন কমিয়ে ফেললেন সুমন।

নিজের স্টুডিওতে বেজবাবা
ছবি: পাভেল মহিতুল আলম

জেদ

বেজবাবা সুমন অসম্ভব রকমের জেদি। কোনো একটা কিছু মনে ধরলে সেটি করেই ছাড়েন তিনি। তবে এই জেদ ইতিবাচকতাই এনে দিয়েছে তাঁর জীবনে। ছোটবেলা থেকে খুব মোটা ছিলেন। একসময় সুমনের ওজন গিয়ে দাঁড়ায় ৩৮৪ পাউন্ডে! ‘এত ওজন ছিল যে বাজারে আমার মাপে পোশাক পাওয়া যেত না। আমাদের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ছিল, সেখান থেকে আমার মাপে পোশাক বানানো হতো।’ হেসে বলছিলেন সুমন। ওজন কমানোর চেষ্টাও সেই জেদের বশেই। তিনি থাইল্যান্ডে গিয়েছিলেন লাইপোসাকশনের মাধ্যমে ওজন কমাবেন বলে। চিকিৎসক তাঁকে দেখে বলেছিলেন, ‘আপনার ওজন এত বেশি যে আমরা লাইপোসাকশন করতে পারব না। আপনি ৩০ কেজি কমিয়ে আসেন।’

চিকিৎসকের কথাটা অদ্ভুত লেগেছিল বেজবাবার কাছে। কিন্তু ওই যে, তিনি তো অসম্ভব জেদি। হাল ছেড়ে দেন না, যা শুরু করেন, শেষ পর্যন্ত তা করে দেখান। ২০০৪ সালের অক্টোবরের ৪ তারিখ। দিনটি বেজবাবার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন তাঁর মেয়ের জন্মদিন। ‘জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমি কোক খাচ্ছিলাম।’ বললেন সুমন। ‘তখন কী মনে করে আমি আর্টসেলের সাজুর হাতে কোকের বোতল দিয়ে বললাম, সাজু, এই নাও কোকের বোতল। আজ থেকে আমি আর কোক খাব না। আমি ওজন কমাব।’ ৬ মাসে ৪২ কেজির মতো কমিয়ে ফেলেছিলেন সুমন। তখন তাঁকে অনেকেই চিনতে পারত না। তিনি সঙ্গে করে প্রথম আলোর কাটিং নিয়ে ঘুরতেন, সেখানে প্রকাশিত তাঁর ছবি দেখিয়ে বলতেন, ‘এটাই আমি। শুকিয়ে গেছি।’

তারপর আবার থাইল্যান্ডের সেই চিকিৎসকের কাছে গেলেন সুমন। গিয়ে বললেন, ‘আপনি আমাকে বলেছিলেন ৩০ কেজি কমিয়ে আসতে। দেখুন, আমি ৪২ কেজি কমিয়ে এসেছি।’ চিকিৎসক বললেন, ‘হ্যাঁ, এখন আমরা আপনার লাইপোসাকশন করাতে পারব।’

‘সরি, আমি এটা বলতে আসিনি।’ জবাব দিলেন সুমন। ‘আমি বলতে এসেছি যে আমি লাইপোসাকশন করাব না। আমি এমনিতেই ওজন কমাতে পারি।’ চিকিৎসককে ওই কথাটি বলার জন্যই জেদ করে ওজন কমিয়েছিলেন বেজবাবা। সত্যি সত্যি দেড় বছরের সাধনায় ৯০ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলেছিলেন সুমন।

সাক্ষাৎকার শেষে বেজবাবা হাসিমুখে ছবি তুললেন কিশোর আলো নিয়েও
ছবি: পাভেল মহিতুল আলম

হ্যাপিনেস ইজ আ চয়েস

এই যে বারবার ক্যানসার আসে, অপারেশন, কেমো, রেডিওথেরাপি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আরও কত কিছু। ক্যানসার যে আবার আসবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কখনো কি রাগ হতো না? হতাশ হতেন না বেজবাবা? ‘শুরুর দিকে খুব রাগ হতো, বিরক্ত লাগত। কিন্তু একটা সময়ে এসে বিরক্ত, রাগ কিছুই হতাম না। একটা সময়ে এসে আমার উপলব্ধি হয় যে, এই সবকিছুর পেছনে একটা কারণ আছে। আমি যে বেঁচে আছি, এটাই বড় ব্যাপার, এখানে রাগ বা বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। আমার তো খুশি হওয়ার কথা যে আমি বারবার বেঁচে ফিরছি। তাই আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে খুব কৃতজ্ঞ যে আমি এখনো বেঁচে আছি, বারবার রোগের হাত থেকে বেঁচে ফিরছি।’

সেই অর্ধেক পানিভর্তি গ্লাসের উপমাটা দিলেন সুমন। কোনো বিষয়কে আমরা দুভাবেই দেখতে পারি। পানিভর্তি গ্লাস বা অর্ধেক খালি গ্লাস। বেজবাবা সব সময় ইতিবাচকভাবেই দেখেন। গ্লাসটা খালি নয়, তিনি দেখেন গ্লাসটি অর্ধেক পানিতে পূর্ণ। ‘হ্যাপিনেস ইজ আ চয়েজ’—এটা বেজবাবার জীবনের মন্ত্র। ‘আমি ঠিক করব যে আমি সুখী না দুঃখী।’ সবাইকে সব সময় এটাই বলেন তিনি। ‘জীবনে প্রতিটি বিষয়ের খারাপ–ভালো দুই দিকই থাকে। কে কোনটা বেছে নেবে, সেটা নির্ভর করে ওই ব্যক্তির ওপর। জীবনে সমস্যা থাকবেই। কিন্তু কেউ খুশি থাকবে, না দুঃখ–কষ্টে দিন কাটাবে, সেটা আসলে ওই ব্যক্তিই ঠিক করবে।’ বেজবাবা মনে করেন, সবার জীবনেই সমস্যা আছে। প্রত্যেকের সমস্যাটাই তার দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা। একজনের সমস্যা অন্যদের কাছে হয়তো কোনো সমস্যাই না। কিন্তু ওই ব্যক্তির জন্য ওটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। কেউ হয়তো গান গেয়ে খ্যাতি চায়, কেউ একটা গান বের করতে পারলেই খুশি হয়। আবার কারও কাছে গান, খ্যাতি সবকিছুই অর্থহীন, তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সারা দিন পরিশ্রম করে পরিবারের জন্য খাবার জোগাড় করা। ফলে জীবনে সমস্যার কোনো শেষ নেই। ভাবতে হবে ইতিবাচকভাবে। জীবনকে উপভোগ করতে হবে নিজের মতো করে।

ছবি: মেহেদী রহমান ইহাব

‘এই যেমন ২০১২ সাল থেকে আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা যেকোনো সময় আবার ক্যানসার ফিরে আসতে পারে।’ বললেন সুমন। ‘চিকিৎসকের ভাষায়, আমার শরীর ক্যানসার প্রন। তিন মাস পরপর আমাকে পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রতি ছয় মাসে পিইটি সিটি স্ক্যান করাতে হয়। পিইটি সিটি স্ক্যানের হাই রেডিয়েশনের কারণে আবার ক্যানসার আসতে পারে। সেখানেও একটা ঝুঁকি থেকে যায়। এসব ভেবে তো বসে থাকা যাবে না। এসব নিয়ে চিন্তা করি না। ভাবি, আমি যে জীবনটা এখন চালাচ্ছি, এটা তো বোনাস লাইফ। আমি দুবার কোমায় গিয়েছি। একবার দুই মিনিটের মতো পালস ছিল না। আমি জীবন-মৃত্যু দুটোর স্বাদই পেয়েছি। ফলে জীবন নিয়ে হাহুতাশ করার কিছু নেই।’

‘আয়হায়, আমার যদি ফেব্রুয়ারিতে আবার ক্যানসার ধরা পড়ে’—এই ধরনের নেতিবাচক চিন্তা করার সময়ই নেই বেজবাবার। নিজের পরিবার, ছেলেমেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতেই ব্যস্ত তিনি। এ ছাড়া সময় দিচ্ছেন ব্যবসাকে। বাকি সময়টা বেজবাবা ব্যয় করছেন অর্থহীনের ভক্তদের জন্য। ‘অথহীন যে আবার ব্যাক করেছে, এটা কিন্তু ভক্তদের জন্যই।’ জোর গলায় বললেন বেজবাবা।

সাড়ে তিন বছর পর যখন সুস্থ হয়ে দেশে ফিরলেন, ব্যান্ডের সদস্যদের ফোন দিয়ে বললেন, ‘চলো অর্থহীন আবার শুরু করি।’ ব্যান্ড সদস্যরাও একদম প্রস্তুত ছিলেন এমন কিছুর জন্য। একবাক্যে সবাই বলেছেন, ‘সুমন ভাই, আমরা রেডি।’ নিজের ব্যান্ডের সদস্যদের নিয়েও গর্বিত বেজবাবা। সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে অর্থহীনের কোনো কার্যক্রম নেই। কেউ জানত না সুমন আবার সুস্থ হয়ে ফিরবেন কি না। চাইলেই বাকি সদস্যরা অন্য ব্যান্ড করতে পারতেন। কিন্তু সবাই অপেক্ষা করেছেন। এ জন্য নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করেন সুমন। একই সঙ্গে ভক্তদের প্রতিও কৃতজ্ঞ তিনি। কারণ, ভক্তরা এত দিন বিরতির পরও মনে রেখেছে অর্থহীনকে। তাই অর্থহীন এবার ফিরেছে শুধুই ভক্তদের জন্য।

ভক্তদের টানে আবারও কনসার্টে বেজবাবা
ছবি: ফাহিম হাসান

ভক্তদের টানেই প্রায় চার বছর পর গত ডিসেম্বরে একেবারে সুপারহিরোর মতোই মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন বেজবাবা। কনসার্টে প্রিয় বেজবাবাকে ফিরে পেয়ে উচ্ছ্বসিত ভক্তরা। ২০২১-এর শেষে মুক্তি পেয়েছে তাঁর গান ‘বয়স হলো আমার’। সব ঠিক থাকলে মার্চেই আসবে নতুন অ্যালবাম ‘ফিনিক্সের ডায়েরির গান’। করোনা পরিস্থিতির কারণে এখন বন্ধ সব কনসার্ট। কিন্তু ভক্তদের সঙ্গে অর্থহীন সরব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কারণ, তাঁরা তো ভক্তদের সঙ্গে সরাসরি যু্ক্ত থাকতে চান সব সময়।

বেজবাবা জানালেন, বোনাস লাইফের প্রতিটি ক্ষণ তিনি উপভোগ করতে চান। ইতিবাচক থাকতে চান। এ প্রজন্মের তরুণদের উদ্দেশে বেজবাবা বলেন, ‘আমাদের জীবন হলো ষড়ঋতুর মতো। বিশ্বাস রাখতে হবে, খারাপ সময় গেলে ভালো সময় আসবে। শীত গেলে বসন্ত আসবে। ফলে বেশি শীতে যেন কষ্ট না পাই, তার আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে গ্রীষ্মেই, আবার বেশি গরমে যেন হাঁসফাঁস না লাগে, তার প্রস্তুতি নিতে হবে শীতে। আবার বসন্তের ভালো লাগাও অল্প সময়ের। মন যদি সব পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকে, তাহলে মোকাবিলা করা সহজ হবে। এই মন্ত্রেই প্রতিনিয়ত খারাপ সময়কে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন বেজবাবা সুমন—আমাদের আয়রনম্যান।

আরও পড়ুন