বেজবাবা সুমনের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা তারিখ ৪ অক্টোবর। ৪ অক্টোবর তাঁর মেয়ের জন্মদিন। আবার অক্টেবরের এই ৪ তারিখেই জন্ম তাঁর গীতিকার সত্তার। স্কুলজীবনে গান লেখার চেষ্টা করেছিলেন, হয়নি। কিন্তু ১৯৯২ সালের ৪ অক্টোবর হঠাৎ করেই গানের কিছু লাইন আসে তাঁর মাথায়। সুমন তখন বেজ বাজাচ্ছেন বাংলাদেশের সুপারহিট ব্যান্ড ফিলিংসে। তিনি ভাবলেন, গানগুলো লেখা যাক। যা হওয়ার হবে। সুরও করলেন কয়েকটা গানের। একদিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফয়সাল বললেন, ‘সুমন, তুমি যে গানগুলো করছ, এগুলো কিন্তু ভালো হচ্ছে। গানগুলো বের করা দরকার।’ ‘আরে কী বলো! আমি এমনিই গান লিখছি।’ বন্ধুর কথা হেসেই উড়িয়ে দেন সুমন। ‘আমি একজন বেজ প্লেয়ার। আমি গীতিকারও না, সুরকারও না।’
বন্ধুর চাপাচাপিতে সুমন তখন নিমরাজি। ‘ঠিক আছে, আমি একটা গান করছি, এটা তুমি গাইবে। তুমি রেকর্ড করবে স্টুডিওতে।’ দুজন মিলে চলে গেলেন স্টুডিওতে। ফয়সাল বললেন, ‘সুমন তুমি পুরো গানটা গাও। তোমারটা শুনে আমি ভয়েস দেব।’ রেকর্ডিংয়ের আগে গানের সুরটা বোঝানোর জন্য ‘ডেমো’ হিসেবে গেয়ে কাজ শেষ ভেবে চলে গেলেন সুমন। দুদিন পর গানটি তৈরি করে সুমনকে শোনাতে এলেন ফয়সাল। গানটির প্রথম অংশ শুনলেন সুমন। ভালোই গেয়েছেন ফয়সাল। দ্বিতীয় অংশে আসতেই চমকে উঠলেন তিনি। ‘আরে, এটা তো আমার ভয়েস!’ নিজের কণ্ঠ শুনে মানতেই পারছিলেন না তিনি। ফয়সাল তাঁকে বোঝালেন, ‘তোমার সমস্যা গানটায় তোমার ভয়েস—এটা নিয়ে। কিন্তু গানটায় তো কোনো সমস্যা নেই। তোমার ভয়েসটা ঠিক আছে। সুর, লয়, তালে কোনো সমস্যা নেই। তুমি অভিযোগ করছ কেন?’
তখন সুমন বুঝলেন, গানটা আসলে ভালোই গেয়েছেন। সেই গানটির নাম কোনো এক নিঝুম রাতে। ‘ঝড়’ নামের একটা মিক্সড অ্যালবামে গানটি মুক্তি পেয়েছিল। ওয়ারফেজের গিটারিস্ট ও কি–বোর্ডিস্ট রাসেল আলী গিটার ও কি-বোর্ড বাজিয়েছিলেন গানটিতে। এই গানটিই বদলে দিয়েছিল বেজিস্ট সুমনকে। তখন থেকে তিনি বিশ্বাস করা শুরু করলেন, তিনি শুধু বেজিস্টও নন, গায়কও বটে।
সুমন খেয়াল করেছিলেন, বেজ গিটারকে কেউ পাত্তা দিত না তখন। সে সময় মানুষ ভাবত, বেজ এমন একটা ইন্সট্রুমেন্ট, যেটা একজন কেবল পেছনে দাঁড়িয়ে বাজাবে। কেউ তার দিকে তাকাবে না। কিন্তু সুমনের ভাবনা ছিল ভিন্ন। তিনি চেয়েছিলেন, বেজ গিটারের মাহাত্ম্যটা মানুষকে বোঝাতে হবে। তাই মাঝেমধ্যে মঞ্চের সামনে চলে যেতেন সুমন। ঘাড়ের ওপর গিটার উঠিয়ে বাজাতেন। কখনো বাজাতেন দাঁত দিয়ে। তখন মানুষ বুঝতে শুরু করল, বেজ গিটার দিয়েও এমন করা যায়। ফলে বেজিস্ট হিসেবে চারপাশে তখন বেশ নামডাক সুমনের। অনেক সলো শিল্পীর গানের সঙ্গে বেজ বাজাতেন সারগামের স্টুডিওতে। সারগামের অন্যতম মালিক বাদল একদিন অ্যালবাম করতে বললেন সুমনকে। জোরাজুরির পর রাজি হয়ে গেলেন সুমন।
অদ্ভুত সেই ছেলেটি | তুমুল জনপ্রিয় এই গানটির অর্ধেক অংশ লিখেছেন বেজবাবার ছোট ভাই। বড় ভাই সুমনের কথা ভেবেই গানটি লিখেছিলেন তিনি। বাকি অংশ নিজের কথা ভেবে নিজেই লিখেছেন সুমন। ১৯৯৪ সালের দিকে লেখা হয়েছিল গানটি। কিন্তু প্রকাশিত হয়েছে ২০০০ সালে। গানটির কোরাস অংশে কণ্ঠ দিয়েছিলেন অর্থহীনের তৎকালীন সদস্য শোভন। যদিও অ্যালবাম মুক্তি পাওয়ার আগেই পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছিলেন তিনি। ‘অদ্ভুত সেই ছেলেটি ২’-এ কণ্ঠ দিয়েছিলেন অনেকেই। শেষের ‘জোছনা অজানা পথে চলা’ অংশটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আর্টসেলের ভোকাল লিংকন। কয়েকটা লাইন গেয়েছিলেন জুয়েল, প্রাঞ্জল, দূরে। আরজে অপু হারমোনাইজ করেছিলেন গানটিতে। বেজবাবা চেয়েছিলেন সবাই মিলে একটা কিছু করতে। তিনি বলেন, ‘কে কত বিখ্যাত, কে বিখ্যাত নয় সেটা কোনো ব্যাপার না। সবাই মিলে কিছু একটা করা, ওটা ছিল উদ্দেশ্য। অদ্ভুত সেই ছেলেটি—একটা ব্যাপার আছে!’
অভিশ্রুতি নামের একটি স্টুডিওতে রেকর্ডিং শুরু হলো সুমন ও অর্থহীন অ্যালবামের। অভিশ্রুতির উল্টো পাশেই তখন চলছিল ওয়ারফেজের বিখ্যাত অ্যালবাম ‘অবাক ভালোবাসা’র রেকর্ডিং। ওয়ারফেজের একটা গানের রেকর্ডিং শেষ করেই রাস্তার উল্টো পাশে এসে সুমনের গানে গিটার বাজিয়েছেন রাসেল আলী। দেখা গেল একটা গানে তবলা বাজানোর প্রয়োজন, তবলা বাজাতে ছুটে এলেন ওয়ারফেজের ড্রামার টিপু। এভাবে সবার সমর্থনে তৈরি হয়েছিল সুমন ও অর্থহীন অ্যালবামটি। কিন্তু নানা কারণে মুক্তি পায়নি অ্যালবামটি। সুমন এবং তার বন্ধু-সহকর্মীদের বাসায়, গাড়িতেই কেবল শোনা যেত গানগুলো।
১৯৯৭ সালের রোজার ঈদে ওয়ারফেজের অ্যালবাম ‘অসামাজিক’ মুক্তি পাওয়ার কথা জি সিরিজ থেকে। এর এক বছর আগেই ব্যান্ডটিতে যোগ দিয়েছেন সুমন। সবাই মিলে ঠিক করলেন, রোজার ঈদ নয়, কোরবানির ঈদে মুক্তি পাবে ‘অসামাজিক’। সবেমাত্র যাত্রা শুরু করা জি সিরিজের কর্ণধার খালেদের তখন মাথায় হাত। সবকিছু প্রস্তুত, এখন অ্যালবাম বের হবে না? রোজার ঈদে একটা কিছু তো আনতেই হবে তাঁর। তখন ওয়ারফেজের গিটারিস্ট কমল বলে ওঠেন, ‘সুমনের একটা অ্যালবাম আছে, ওটা আমরা অনেক দিন ধরে গাড়িতে শুনছি। আপনি চাইলে ওটা বের করতে পারেন।’ শুনেই লাফিয়ে উঠলে খালেদ। ‘গান আছে কোনো?’ সুমন জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ আছে, গাড়িতে চলেন।’
গাড়িতে ‘তোমার জন্য নয়’ গানটি একবার শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন জি সিরিজ কর্ণধার। এই অ্যালবাম তিনি বের করবেনই। এভাবেই প্রকাশিত হলো বেজবাবা সুমনের প্রথম অ্যালবাম ‘সুমন ও অর্থহীন’।
সে সময় বিটিভির দুটি অনুষ্ঠান তুমুল জনপ্রিয়—ইত্যাদি আর শুভেচ্ছা। ঈদের বিশেষ শুভেচ্ছায় তোমার জন্য নয় গানটি গাওয়ার সুযোগ হলো সুমনের। রেকর্ডিংয়ের সময় সামনে বসা দর্শকেরা যখন হাততালি দিচ্ছিলেন, গানের মাঝখানে, তখনই সুমন বুঝতে পেরেছিলেন, গানটা মানুষ পছন্দ করেছে। অ্যালবাম বের হয়, সুমন তখন ছিলেন দেশের বাইরে। বহু কষ্টে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে খালেদ বলেন, ‘সুমন ভাই, আপনার অ্যালবাম তো সুপারহিট।’ সুমন তখনো বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। নিজেকে কখনো গায়ক হিসেবে ভাবেননি তিনি। আর তাঁর অ্যালবামই সুপারহিট! তখন থেকেই গায়ক হিসেবেও জনপ্রিয়তা পেয়ে গেলেন সুমন। এই সাফল্যে ওয়ারফেজের অসামাজিক অ্যালবামে যুক্ত করা হলো গাড়িতে লেখা এবং কয়েক ঘণ্টায় সুর করা সুমনের গান ‘প্রতিচ্ছবি’।
যদিও নিজেকে এখনও গায়ক হিসেবে তেমন গুরুত্ব দেন না সুমন। নিজেকে প্রথমত একজন বেজিস্ট, তারপর লিরিসিস্ট এবং সবশেষে একজন গায়ক হিসেবে দেখেন তিনি।
নিকৃষ্ট | অর্থহীনের অধিকাংশ গানই লিখেছেন বেজবাবা সুমন। অকপটেই বললেন, গান লেখার সময় মিথ্যা লিখতে পারেন না তিনি। যা অনুভব করেন, সেটিই উঠে আসে তাঁর গানে। মানুষ কষ্টে থাকলে বিরহের গান লেখে, আনন্দে থাকলে লেখে আনন্দের গান। কিন্তু যখন প্রচণ্ড রেগে থাকে, সেই, মুহূর্তটা নিয়ে কোনো গান লেখা হয় না। ‘নিকৃষ্ট’ সেই রাগেরই বহিঃপ্রকাশ। প্রচণ্ড রাগ নিয়ে কফিশপে বসে ছিলেন বেজবাবা। কোনো একটি কারণে রাগে ফেটে পড়ছিলেন তিনি। ওয়েটারকে তিনি বলেন, ‘আমাকে একটা কলম দাও।’ ওয়েটার এসে কলম দেওয়ার পর সামনে রাখা টিস্যু পেপারে বেজবাবা লিখতে শুরু করেন, ‘কখনো কি তোমার মনে হয় যে তুমি কোথাও নেই…!’ এভাবে পুরো টিস্যু পেপারের ওপর লেখা হয়ে গেল নিকৃষ্ট-১। গানটি লেখার পর বেজবাবার মনে হলো রাগটা আর নেই, তিনি বেশ ভালো বোধ করছেন। অর্থাৎ পুরো রাগ তিনি লিখে প্রকাশ করে ফেলেছেন টিস্যু পেপারের ওপর। সঙ্গে ছিলেন বেজবাবার বন্ধু। লেখাটি পড়ে তিনি বলেন, ‘সুমন ভাই, এটা গান বানাতে হবে। এ রকম জিনিস কখনো হয় নাই।’
ওয়ারফেজ ছেড়ে দেওয়ার পর ‘সুমন ও অর্থহীন’ নামে বেশ কিছু কনসার্ট করতেন বেজবাবা সুমন। হঠাৎ মনে হলো, ব্যান্ডের নাম হিসেবে ‘সুমন ও অর্থহীন’ নামটা ঠিক যাচ্ছে না। ঠিক করলেন ‘সুমন’ ফেলে দিয়ে ‘অর্থহীন’ নাম নিয়েই ব্যান্ড করবেন। ১৯৯৮ সালের অক্টোবরে ব্যান্ড হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ‘অর্থহীন’। প্রাথমিকভাবে সদস্য হিসেবে ছিলেন রুমি (ড্রামস), তন্ময় (গিটার), পনির (গিটার) এবং বেজ ও ভোকাল সুমন।
সেই থেকে অনেক চড়াই–উতরাই পেরিয়ে এখনও ছুটছে অর্থহীন। বেজবাবার সঙ্গে আছেন শিশির (গিটার, কিবোর্ড), মার্ক ডন (ড্রামস) ও মহান ফাহিম (গিটার)। দীর্ঘ চার বছর পর অদ্ভুত সেই ছেলেগুলো আবার শুরু করেছে হাঁটা। ভক্তদের আশা, আরও অনেক দিন একসঙ্গে হাঁটবে অর্থহীন।