লাল গ্রহে প্রাণের খোঁজে

রাত ২টা ৫৫। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১। শুক্রবার।

নাসাস পারসেভারেন্স মার্স রোভার অ্যাকাউন্টে ছোট্ট একটা টুইট দেখা গেল। আই অ্যাম সেফ অন মার্স। পারসেভারেন্স উইল গেট ইউ এনিহোয়ার। নিরাপদে মঙ্গলে নেমেছি। অধ্যবসায় আপনাকে যেকোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে। (বলে রাখা দরকার, পারসেভারেন্স কথাটার বাংলা অধ্যবসায়, এখানে সে অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।)

টুইটটা প্রতীকী। এর বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকেই পারসেভারেন্সের অবতরণের পুরো প্রক্রিয়া সরাসরি সম্প্রচার করেছে নাসা। হাজার হাজার উৎসুক মানুষ ডিভাইসে চোখ রেখেছেন। নাসার বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরাও অধীর আগ্রহে, দুরু দুরু বুকে তাকিয়ে ছিলেন পর্দায়। পারসেভারেন্স নামছে। এদিকে শুরু হয়েছে, নাসার বিজ্ঞানীদের ভাষায় যাকে বলে সেভেন মিনিটস অব টেরর। আতঙ্কের সাত মিনিট। একটা টেকনিক্যাল নামও আছে এর—এন্ট্রি, ডিসেন্ট অ্যান্ড ল্যান্ডিং। প্রবেশ, নামতে থাকা এবং অবতরণ।

মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে এই আতঙ্কের প্রহর। ঘণ্টায় ২০ হাজার কিলোমিটার বেগে মাটির দিকে ছুটছে পারসেভারেন্স। আর প্রতিমুহূর্তে প্রচণ্ডভাবে বাড়ছে চারপাশের তাপমাত্রা। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১ হাজার ৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সে জন্য অবশ্য প্রতিরক্ষা আছে। তাপনিরোধক আবরণীতে মোড়ানো আছে পারসেভারেন্সের সবটা। সঙ্গে আছে ২৮টা সেন্সর, প্রতিমুহূর্তে খেয়াল রাখছে তাপমাত্রা ও বায়ুপ্রবাহের পরিমাণের ওপর। আতঙ্কের এই নাটকে যুক্ত হয়েছে ১১ মিনিটের ল্যাগ। অর্থাৎ কোনো কমান্ড দিলে সেটা পারসেভারেন্সের কাছে পৌঁছে পালিত হতে লেগে যাবে ১১ মিনিট! মানে আতঙ্কের এই সাত মিনিটে বিজ্ঞানীরা অসহায়। কিছু একটা সমস্যা হয়ে গেলে কোনো কমান্ড দিয়েও লাভ নেই। এত দিনের সব পরিশ্রম মুহূর্তেই শেষ।

আতঙ্কের ৪ মিনিট পার হওয়ার পর, মাটি থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার ওপরে থাকতেই পারসেভারেন্স প্যারাস্যুট খুলেছে। তখনো সে ছুটছে ঘণ্টায় দেড় হাজার কিলোমিটার বেগে। ৬ মিনিট শেষ হওয়ার একটু আগে, মাটি থেকে ২ কিলোমিটার ওপরে থাকতেই আলাদা হয়ে গেছে প্যারাস্যুট। এতক্ষণে এর বেগ নেমে এসেছে ঘণ্টায় ২ দশমিক ৭ কিলোমিটারে। থ্রাস্টার চালু হয়ে গেছে, আশপাশের ১০-১০০ মিটারের মধ্যে খুঁজে ফিরেছে নিরাপদে নামার স্থান। তারপর বিজ্ঞানী ও সারা বিশ্বের উৎসুক দর্শকদের স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিয়ে লাল মাটি ছুঁয়েছে নিরাপদে।

এত কিসের আগ্রহ পারসেভারেন্সকে ঘিরে? কত রোভার এত দিনে নানা গ্রহে নেমেছে! মঙ্গলেও নেমেছে কিউরিওসিটির মতো রোভার। তাহলে পারসেভারেন্সের বিশেষত্ব কী? বলছি।

সেই ১৯৭০ সালে ভাইকিং মিশনের পর মঙ্গলে জীবনের খোঁজে এ রকম আর কোনো অভিযান চালানো হয়নি। প্রায় ৫০ বছর পর এ রকম আরেকটা অভিযান করছে নাসা। এখানেই পারসেভারেন্সের বিশেষত্ব। তা ছাড়া মানুষের ভবিষ্যৎ আবাস হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই মঙ্গলের কথা ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। স্পেসএক্স ও টেসলার সিইও ইলন মাস্ক নিজেও এ ব্যাপারে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন, শুনিয়েছেন আশার কথা। স্থায়ী আবাস না গাড়লেও মানুষ যদি ভবিষ্যতে কোনো অভিযানে মঙ্গলে যায়, পারসেভারেন্সের পাঠানো বিভিন্ন তথ্য সে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

পারসেভারেন্স যাত্রা করে ২০২০ সালের ৩০ জুলাই, ফ্লোরিডার কেপ কার্নিভ্যালের উৎক্ষেপণকেন্দ্র থেকে। গাড়ি আকৃতির এক টনের এই রোভার মহাকাশের পুরোটা পথ পাড়ি দিয়েছে একটি সুরক্ষা আবরণীর ভেতরে। এই আবরণীর মূলত দুটি অংশ—একটি ব্যাকশেল এবং একটি তাপনিরোধক আবরণী। ব্যাকশেলটি রোভারের যেখানে যুক্ত, থ্রাস্টারের অবস্থান সেখানেই। এই থ্রাস্টারের কাজ, রোভার যেন সঠিক পথে চলে, নির্ধারিত সঠিক স্থানে নামে, তা নিশ্চিত করা।

পৃথিবী থেকে ৪৭০ মিলিয়ন কিলোমিটারের এক দীর্ঘ যাত্রা। প্রায় সাড়ে ছয় মাস ধরে মহাশূন্যের মধ্য দিয়ে অবিরাম ছুটে চলা। তারপর মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ। আর সবশেষে আতঙ্কের সেই সাত মিনিট! এত সব বাধা পেরিয়ে পারসেভারেন্স নেমেছে মঙ্গলের জেজেরো ক্রেটারে। ক্রেটার মানে খাদ। ৪৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাদ মঙ্গলের বিষুবরেখার ঠিক উত্তর পাশে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর আগে এই খাদে হয়তো গড়ে উঠেছিল মঙ্গলীয় নদী ও লেক। সে হিসাবে এখানেই থাকার কথা দারুণ সব মঙ্গলীয় নমুনা—বিভিন্ন ধরনের বালু, পাথর ও জৈব কার্বনের আস্তরণ। শেষেরটি অবশ্য কেবলই বিজ্ঞানীদের ধারণা। আসলেই আছে কি না, সেটাই খুঁজে দেখবে পারসেভারেন্স।

মঙ্গলের আকাশে উড়বে ইনজেনুইটি।

বর্তমানে মঙ্গল এক শীতল, শুষ্ক গ্রহ। খুবই পাতলা বায়ুমণ্ডল একে ক্ষতিকর মহাজাগতিক বিকিরণের হাত থেকে বাঁচাতেও পারে না। কিন্তু এত দিন বিজ্ঞানীরা যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন, তা ইঙ্গিত করে, বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগে গ্রহটিতে পানির অস্তিত্ব ছিল। কাদামাটি জমে তৈরি হওয়া পাথর, পলিমাটির স্তর ইত্যাদি সে ইঙ্গিতই দেয়। তা ছাড়া কিউরিওসিটি রোভার তিন বিলিয়ন বছর আগেকার এক নমুনা পাথরে জৈব অণুর সন্ধানও পেয়েছে। তবে এটি প্রাণের চিহ্ন, নাকি জৈবপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কহীন ঘটনা, তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি।

যদি কখনো এখানে নদী থেকে থাকে, তাহলে ওর মধ্যে জীবনের স্ফুরণ ঘটতে পারে। অতিক্ষুদ্র জীবাণুরা হয়তো একসময় জীবন যাপন করেছে এখানে। আজ হয়তো তারা নেই। কিন্তু মঙ্গলের মাটি-পাথরের মধ্যে তাদের চিহ্ন রয়ে যাওয়ার কথা। পারসেভারেন্সের সংগৃহীত নমুনা থেকে খাদ, আগ্নেয়গিরি ও পানির প্রবাহ এবং এর বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি জানা যাবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। তার মানে এসব নমুনা বিশ্লেষণ করে বোঝা যাবে কালের পরিক্রমায় মঙ্গলের পরিবর্তন। জানা যাবে গ্রহটির ইতিহাস।

পারসেভারেন্স কিন্তু নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসবে না। সাত ফুট লম্বা এক রোবটিক বাহুর মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করে, নমুনা-টিউবে ঢুকিয়ে রেখে আসবে মঙ্গলের মাটিতে। এই নমুনাগুলো সংগ্রহের জন্য আলাদা অভিযান পরিচালনা করবে নাসা। মার্স স্যাম্পল রিটার্ন। এই অভিযানে পাঠানো রোভারটির কাজই হবে পারসেভারেন্সের ছেড়ে যাওয়া নমুনা-টিউবগুলো সংগ্রহ করা। রোভারটি তারপর নমুনাগুলোকে মার্স অ্যাসেন্ট ভেহিকেল নামের একটি রকেটে তুলে দেবে। সেই রকেট নমুনা পৌঁছে দেবে একটি অরবিটারে। অরবিট মানে কক্ষপথ। এ ধরনের যানগুলো মূলত কোনো কিছুকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরতে থাকে, মাটিতে নামে না। মঙ্গলকে ঘিরে ঘুরে চলা সেই অরবিটার তারপর পৃথিবীতে নিয়ে আসবে নমুনাগুলো। ধারণা করা হচ্ছে, এসব নমুনা বিজ্ঞানীদের হাতে পৌঁছাবে ২০৩১ সালে।

পারসেভারেন্স একা মঙ্গলে যায়নি। সঙ্গে নিয়ে গেছে বন্ধু ইনজেনুইটিকে। ১ দশমিক ৮ কেজির এই হেলিকপ্টার আগামী ৩০ দিনে একাধিকবার মঙ্গলে উড়বে। মঙ্গলে মহাকর্ষের মান পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ। তার ওপর এর বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব পৃথিবীর মাত্র ১ শতাংশ। ফলে মাটি থেকে ওপরে ওঠা এবং উড়ে চলা বেশ কঠিন। সেই কঠিন কাজই করার চেষ্টা করবে ইনজেনুইটি।

এখনো অনেক বাধা আছে। পারসেভারেন্সের সংগৃহীত নমুনা হাতে এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সময় লেগে যাবে আরও প্রায় ১০ বছর। কিন্তু বিজ্ঞানীরা ধৈর্য ধরতে জানেন।

এর সঙ্গে ১৩ মেগাপিক্সেলের একটি ক্যামেরা আছে। যেসব জায়গায় পারসেভারেন্স পৌঁছাতে পারবে না, ইনজেনুইটি উড়ে যেতে পারবে সেসব অঞ্চলে। তুলতে পারবে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ সব ছবি। অর্থাৎ ওড়ার ব্যাপারটি পরীক্ষার পাশাপাশি পারসেভারেন্সের পরিপূরক হিসেবেও কাজ করবে ইনজেনুইটি।

তবে এখনো অনেক বাধা আছে। পারসেভারেন্সের সংগৃহীত নমুনা হাতে এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সময় লেগে যাবে আরও প্রায় ১০ বছর। কিন্তু বিজ্ঞানীরা ধৈর্য ধরতে জানেন। তাঁদের দীর্ঘ পরিশ্রম ও সাধনা, অধ্যবসায়ে ভর করেই আজ আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এত দূর এগিয়েছি। মঙ্গলে প্রাণের সন্ধান আসলে পাওয়া যাবে কি না, মানুষ আসলেই নিকট ভবিষ্যতে মঙ্গলে যেতে পারবে কি না, তাঁরাও জানেন না। কিন্তু সেই সুদূরে চোখ রেখে তাঁরা ঠিকই কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। পারসেভারেন্স অ্যাকাউন্টের সেই ছোট্ট টুইটের কথা মনে করা যায়। অধ্যবসায় আপনাকে যেকোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে।

নিকট ভবিষ্যতে না হলেও মানুষ নিশ্চয়ই একদিন মঙ্গলে যাবে। সেদিন পারসেভারেন্স ও ইনজেনুইটি—এই দুই মানিকজোড় এবং এই অভিযানের নেপথ্যের বিজ্ঞানীদের মানুষ স্মরণ করবে পরম শ্রদ্ধায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

তথ্যসূত্র: বিবিসি, নাসা

আরও পড়ুন