অনেক অনেক আগের কথা। এক ছিল জেলে। সাগরে জাল ফেলে মাছ ধরত সে। মাছ বেচে দিন কাটাত। বউ আর শিশুপুত্র নিয়ে তার সংসার। আয়-রোজগার খারাপ ছিল না। কিন্তু মানুষের সব দিন তো আর সমান যায় না। একদিন খুব কঠিন অসুখে পড়ল জেলে। বাঁচার কোনো আশা নেই।
বউকে ডেকে জেলে বলল, ‘আমি যে জেলে, ছেলে বড় হলে তাকে এ কথা বলবে না। তাহলে সে বড় কিছু করতে চাইবে না।’
জেলে মারা যাওয়ার পর বউ তার জালটা ঘরের এক কোণে লুকিয়ে রাখল। পরের বাড়িতে কাজ করে ছেলেকে বড় করে তুলল সে। একসময় অসুখে ভুগে জেলের বউটাও মারা গেল।
দুনিয়ায় একেবারে একলা হয়ে গেল জেলেপুত্র জামাল। কেউ নেই, কিছু নেই। কী করে চলবে সে?
একদিন এমন অবস্থা, খাবার কেনার মতো একটি পয়সাও পকেটে নেই। ঘরের কিছু বিক্রি করে খাবার কেনা যায় কি না, ভাবল জামাল। কিন্তু অনেক খুঁজেও বেচার মতো ঘটিবাটি কিছু পেল না। শেষে ঘরের এক কোণ থেকে একটা জাল পাওয়া গেল। ভাবল, ‘যাই, সাগরে জাল ফেলে মাছ ধরা যায় কি না, দেখি।’
সাগরে জাল ফেলে দুটো মাছ ধরল জামাল। একটা মাছ বেচে কিছু টাকা পেল সে। তা দিয়ে ঘরের দরকারি কিছু জিনিস কিনে ফেলল। আরেকটা মাছ বাড়িতে নিয়ে রান্না করে খেল।
এভাবে মাছ ধরে দিন কাটাতে লাগল জামাল। একদিন তার জালে বেশ বড় একটা মাছ ধরা পড়ল। মাছটা অনেক সুন্দর। গোলাপি মুখ, নীল পাখনা, হলুদাভ শরীর, নীল পিঠ। মাছটা দেখে ভারি মায়া হলো জামালের। এমন সুন্দর মাছ বিক্রি করা যায়? আর রান্না করে খাওয়ার কথা তো ভাবাই যায় না। বাড়ি ফিরে বড় একটা কুয়ো খুঁড়ে মাছটাকে জিইয়ে রাখল সে।
সেদিন রাতে না খেয়েই কাটাল জামাল। পরদিন সকালে উঠেই জাল নিয়ে সাগরে গেল সে। আজ কিছু ছোট মাছ জুটল। তা থেকে কয়েকটা মাছ বেচে দিল। বাকিগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরল সে।
উঠানে পা দিয়ে খুব অবাক হয়ে গেল জামাল। মনে হলো, কেউ এসেছিল বাড়িতে। উঠানে ভেজা পায়ের ছাপ। ঘরে ঢুকে আরও অবাক সে। এলোমেলো যা কিছু ছিল, সব পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। কার কাজ? হয়তো পাড়াপড়শি কেউ এসে করে গেছে। মানুষের জন্য তো মানুষই করে। জামাল মনে মনে বলল, যিনি এ কাজ করেছেন, খোদা তার ভালো করুন।
পরদিন জামাল কুয়োর ভেতর উঁকি দিয়ে দেখে, ভালোই আছে মাছটা। ওটাকে কিছু খাবার দিল সে। তারপর নিজে কিছু খেয়ে জাল নিয়ে বেরোল মাছ ধরতে।
আজ বেশ কয়েকটা বড় মাছ জালে আটকাল। জামাল মহাখুশি। নিজের জন্য একটা রেখে বাকি মাছগুলো বেচে দিল সে। অনেক টাকা এল তার হাতে। ট্যাঁকে টাকা গুঁজে মাছটা নিয়ে খুশিমনে বাড়ি ফিরল সে।
মনে মনে ভয়ানক চটে গেলেন বাদশাহ। সামান্য জেলের বাচ্চার কত বড় সাহস! তার মুখের ওপর মাফ চেয়ে বসল। প্রাসাদ গড়ার রহস্য ফাঁস করল না! দাঁড়া, মজা এবার টের পাবি ভালো করে
উঠানটা আজও সুন্দরভাবে গোছানো সবকিছু। এমনভাবে গোছানো, যেন খুব আপন কেউ সাজিয়ে দিয়ে গেছে। কে সে?
রাতে খাওয়ার পর জামাল ভাবল, যাই, বাইরে একটু ঘুরে আসি। কাছেই এক বাজার। সেখানে খেটে খাওয়া লোকজন সন্ধ্যার পর আড্ডা জমায়। জামাল হাঁটতে হাঁটতে সেখানে গিয়ে হাজির।
সবাই যে যার মতো গল্পগুজবে মশগুল। জামাল একটা বেঞ্চির শেষ মাথায় চুপচাপ বসে রইল। তার এক বন্ধু এল বাজারে। সে দেখে, উদাস হয়ে কী যেন ভাবছে জামাল। কাছে গিয়ে সে বলল, ‘কী রে, কী ভাবছিস! কী হয়েছে তোর?’
জামাল বলল, ‘আমি যখন মাছ ধরতে যাই, কে যেন আসে আমার বাড়ি।’
‘চুরি করে নিয়েছে কিছু?’
‘না, বরং সে খুব যত্ন করে ঘর সাজিয়ে যায়।’
‘তোর সঙ্গে তো কেউ থাকে না। তাহলে কে করবে ঘরের কাজ?’
‘সেটাই তো প্রশ্ন।’
জামালের কানে কানে একটা বুদ্ধি দিল তার বন্ধু। বুদ্ধিটা মনে ধরল তার।
পরদিন সকালে জামাল জাল নিয়ে বের হলো ঠিকই, কিন্তু সাগরে গেল না। বেড়ার এক ফুটোয় চোখ রেখে অপেক্ষায় রইল—কে আসে দেখবে আজ।
একটু পরই কুয়োর সেই রঙিন মাছটা লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল। মাছের খোলস ফেলে বেরিয়ে এল এক রূপবতী। মেয়েটির সাজপোশাকও ঝলমলে।
মেয়েটি পায়ে পায়ে ঢুকল ঘরের ভেতর।
জামাল একদৌড়ে কুয়োর ধারে গিয়ে তুলে নিল মাছের খোলস। তারপর সেটা পুড়িয়ে ফেলল। ঘর থেকে ছুটে এল মেয়েটা। বলল, ‘এটা কী করলে! এখন তো আমি আর মাছের রূপ ধরতে পারব না। আড়ালেও থাকা হবে না।’
জামাল হেসে বলল, ‘দরকার নেই আর আড়ালে থাকার। এবার বলো, তোমার আসল পরিচয় কী?’
‘আমি মত্স্যকন্যা। সাগর রাজার মেয়ে। নাম সাগরিকা। তোমাকে ভালো লেগেছে বলে তোমার জালে ধরা দিয়েছি।’
জামাল তাকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করল।
মত্স্যকন্যার কথা শিগগিরই চারদিকে রটে গেল। আশপাশের সবাই এসে দেখতে লাগল তাকে। দূরদূরান্ত থেকেও লোকজন আসতে লাগল। সবার এক কথা—জেলের ছেলেটার কপাল বটে! এমন পরমা সুন্দরী বাদশাহর মহলেও নেই।
মত্স্যকন্যার কথা শিগগিরই বাদশাহর কানে গিয়ে পৌঁছাল। উজিরকে আদেশ করলেন তাকে প্রাসাদে নিয়ে আসতে। সঙ্গে সঙ্গে হুকুম তামিল। মত্স্যকন্যার রূপ দেখে রাজার চোখে পলক পড়ে না। কিন্তু এই মেয়ে তো জেলেপুত্রের জালে ধরা দিয়েছে। তাকে তিনি বেগম করবেন কীভাবে? আটকেই–বা রাখবেন কোন ছুতায়। ছেড়ে দিলেন মত্স্যকন্যাকে।
বাদশাহ শেষে এক ফন্দি আঁটলেন। জেলেপুত্রকে ডেকে এনে বললেন, ‘হ্যাঁ, মত্স্যকন্যা তোমার বউ হবে, তবে এক শর্তে।’
‘বলুন, জাহাঁপনা।’
‘তোমাকে ৪০ দিনের মধ্যে সাগরের মাঝখানে আমার জন্য একটা প্রাসাদ গড়ে দিতে হবে। মণিমুক্তাখচিত প্রাসাদ!’
মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরে এল জামাল। হাপুস নয়নে কাঁদতে বসে গেল। এমন অসম্ভব কাজ শুধু জাদুকরের পক্ষেই সম্ভব। এখন সাগরিকাকে হারালে সে বাঁচবে কী নিয়ে?
জামালকে কাঁদতে দেখে সাগরিকারও চোখে পানি এসে গেল। সে জানতে চাইল এই কান্নার কারণ। জামাল খুলে বলল সব।
সাগরিকা ধবধবে একটা সাদা পাথর নিয়ে এসে জামালকে বলল, ‘সাগরের যেখানটায় জাল ফেলে আমাকে পেয়েছিলে, এই পাথরটা নিয়ে যাবে সেখানে। তারপর ছুড়ে মারবে সাগরে। বিদ্ঘুটে চেহারার একজন উঠে আসবে সাগর থেকে। কিন্তু ভয় পাবে না। তার কাছে একটা রুপার থালা চাইবে। ওই থালাটা সাগরে ছুড়ে দিলেই একটা মণিমুক্তাখচিত প্রাসাদ তৈরি হয়ে যাবে।’
সাদা পাথরটা নিয়ে সাগরতীরে গেল জামাল। সাগরিকার কথামতো পাথরটা ছুড়ে দিল সাগরে।
সাগরের গর্জন ছাপিয়ে বজ্রের মতো একটা শব্দ হলো। সাগরজলে বিশাল এক ঘূর্ণি তৈরি হলো। সেই ঘূর্ণি থেকে উঠে এল বিশালদেহী একজন। বিকট-দর্শন এই চিজ মানব না দানব কে জানে? পানির ওপর দিয়ে হেঁটে আসতে লাগল সে।
একদৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করল জামালের। কিন্তু সাহস হারাল না। দাঁড়িয়েই রইল। বিকট কায়া এসে মাথা নিচু করে সালাম দিল জামালকে। বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘বলুন, জনাব, আপনার জন্য কী করতে পারি?’
‘আমার একটা রুপার থালা চাই।’
‘এই নিন থালা।’
বিটকেলে কায়া হাত বাড়াতেই বিশাল এক রুপার থালা হাজির।
থালাটা জামালের হাতে তুলে দিয়ে পানিতে নেমে গেল সে।
থালাটা এবার সাগরে ভাসিয়ে দিল জামাল। ভাসতে ভাসতে থালাটা এক জায়গায় গিয়ে স্থির। চোখের পলকে সেখানে গড়ে উঠল এক সুরম্য প্রাসাদ। পুরোটা প্রাসাদে মণিমুক্তার ঝিলিক। চোখ ধাঁধিয়ে গেল জামালের। খানিকক্ষণ থ মেরে থাকার পর খেয়াল হলো—এখন কী করতে হবে।
ছুটতে ছুটতে বাদশাহর দরবারে হাজির জামাল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘জাহাঁপনা, আপনার কথামতো সাগরে মণিমুক্তাখচিত প্রাসাদ গড়ে এসেছি। চলুন, দেখবেন।’
জেলেপুত্রের কথা শুনে অবাক বাদশাহ। দরবারে উপস্থিত আমির-ওমরাহ হেসেই খুন। নির্ঘাত মাথা খারাপ হয়েছে জেলের ছেলেটার। এ–ও কি সম্ভব!
কিন্তু বলছে যখন যেতে তো হবে। মস্ত এক হাতির পিঠে চড়ে বেশ শানশওকতের সঙ্গে সাগরতীরে গেলেন বাদশাহ। জেলেপুত্র মোটেও মিছে বলেনি। সত্যিই এক সুরম্য প্রাসাদ সাগরে ভাসছে। মণিমুক্তার জ্যোতিতে বাদশাহর ভিরমি লাগার জোগাড়। মানুষ যতটা কল্পনা করতে পারে, এর চেয়েও অনেক সুন্দর এ প্রাসাদ।
বাদশাহ জেলেপুত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করে গড়লে এই প্রাসাদ?’
সে হাতজোড় করে বলল, ‘মাফ করবেন, জাহাঁপনা। এ আমি বলতে পারব না। আপনি যা চেয়েছেন, তা আপনাকে দিয়েছি। এবার অনুমতি দিলে বাড়ি ফিরে যাই।’
মনে মনে ভয়ানক চটে গেলেন বাদশাহ। সামান্য জেলের বাচ্চার কত বড় সাহস! তার মুখের ওপর মাফ চেয়ে বসল। প্রাসাদ গড়ার রহস্য ফাঁস করল না! দাঁড়া, মজা এবার টের পাবি ভালো করে।
বাদশাহ বললেন, ‘এত শিগগিরই বাড়ি যাবে কীভাবে? ওই প্রাসাদে আমি যাব কী করে? একটা সেতু করে দিতে হবে না?’
‘সেতু!’ কপালে ঘাম ছুটে গেল জামালের।
‘হ্যাঁ, স্বচ্ছ স্ফটিকের একটা সেতু চাই আমার। সময় ২০ দিন। এর মধ্যে শর্ত পূরণ না করতে পারলে মত্স্যকন্যাকে আর পাবে না।’
জেলেপুত্র বিমর্ষ মনে বাড়ি ফিরে গেল। তার মন খারাপের কারণ জানতে চাইল সাগরিকা। জামাল খুলে বলল সব। সাগরিকা আবার একটা সাদা পাথর নিয়ে এল। জামালকে বলল, ‘সেই একই জায়গায় গিয়ে এই পাথরটা ছুড়ে মারবে। সেই একই চেহারার দেখা মিলবে। এবার একটা লম্বা দড়ি চাইবে তার কাছে। ওই দড়িটা সাগরে ছুড়ে দিলেই স্ফটিকের সেতু হয়ে যাবে।’
বাদশাহ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে চিত্কার শুরু করলেন, ‘ও রে, হাঁ করে দেখছিস কী তোরা! এই হতচ্ছাড়া পিচ্চিটাকে এখনই তাড়া!’
সাগরিকার কথামতো সবই করল জামাল। শিগগিরই সাগরের প্রাসাদ থেকে তীর পর্যন্ত সুন্দর একটা স্ফটিকের সেতু তৈরি হলো। বাদশাহ তা দেখে আবার তাজ্জব। কিন্তু সাগরের প্রাসাদে গিয়ে মন ভরল না তার। মনজুড়ে এখন একটাই চিন্তা—জেলের ছেলে এই জাদুর কেরামতি পেল কোথায়?
জেলের ছেলেকে বিপদে ফেলার জন্য এবার আরও কঠিন শর্ত দিলেন বাদশাহ। বললেন, ‘যাও, এমন একটা ডিম নিয়ে এসো, যা থেকে একটা খচ্চর জন্ম নেবে।’
আবার মন খারাপ করে বাড়ি ফিরল জামাল। সাগরিকা আবার পথ দেখাল। এবার সেই ভয়াল-দর্শনের কাছ থেকে একটা ডিম নিয়ে এল সে।
ডিমটা প্রাসাদে নিয়ে গেল জামাল। বাদশাহর সামনে সজোরে একটা আছাড় মারতেই একটা বড়সড় খচ্চর বেরিয়ে এল। বেরিয়েই সেটা পেছনের পা দুটো তুলে সজোরে চাঁটি মেরে বসল। অল্পের জন্য নাকটা রক্ষা পেল বাদশাহর। তিনি কটমট করে তাকালেন জেলেপুত্রের দিকে।
জামাল বোকার মতো হেসে বলল, ‘খচ্চর ভারি বদ জানোয়ার, জাহাঁপনা! আপনি গাধা চাইলেই পারতেন। তাহলে এমন বেয়াদবি করার সাহস পেত না।’
বাদশাহ হুংকার ছেড়ে খচ্চরটাকে পাকড়াও করার আদেশ দিলেন। কিন্তু সেপাইরা সে সুযোগ পেল না। খচ্চরটা একদৌড়ে সাগরে গিয়ে নামল।
জামাল এবার খুশিমনে বাড়ি ফিরতে যাবে, এমন সময় বাদশাহ তাকে নতুন শর্ত দিলেন। বললেন, ‘এটাই শেষ। এবার তুমি এক দিন বয়সী এমন ছেলেকে নিয়ে আসবে, যে হাঁটতে এবং কথা বলতে পারে।’
সাগরিকা এবারও জামালকে বাদশাহর শর্ত পূরণের পথ দেখিয়ে দিল। জামাল সাগরতীরে গিয়ে আবার একটা সাদা পাথর ছুড়ে অপেক্ষা করতে লাগল। শিগগিরই এল সেই বিকট কায়া। বলল, ‘বলুন, জনাব, এবার কী আদেশ।’
‘আমাকে এক দিন বয়সী এমন এক শিশু এনে দিতে হবে, যে হাঁটতে এবং কথা বলতে পারে।’
নিমেষে হাজির এক শিশু। শিশুটিকে জামালের কোলে তুলে দিয়ে বিকট-দর্শন বলল, ‘ওর বয়স এক দিনের একটু কম হবে। সাংঘাতিক বিচ্ছু, জনাব! একটু সমঝে চলবেন।’
শিশুটাকে নিয়ে প্রাসাদের দিকে দ্রুত পায়ে এগোল জামাল। শিশুর আদর লাগা মুখে টুপুস করে একটা চুমু খেল সে। অমনি শিশুটা রা রা করে উঠল, ‘এসব কী! মুখ না ধুয়ে চুমু খাচ্ছ কেন? আর তোমার গায়ে এমন মাছ মাছ গন্ধ কেন? কী করো তুমি?’
এত্তটুকুন শিশুর মুখে পাকা বুড়োর মতো কথা শুনে থ বনে গেল জেলেপুত্র। জবাব দেবে কী!
শিশুটা জেলেপুত্রের নাকের ডগায় চটাক করে তুড়ি বাজিয়ে বলল, ‘হাঁ করে আছ কেন? মুখের ভেতর মাছি ঢুকবে তো!’
এরপরও জেলেপুত্রের মুখে কোনো কথা জোগায় না। শিশুটা বলে, ‘কথা বলছ না কেন? আমার কথায় কিছু মনে করলে নাকি, চাচ্চু? আচ্ছা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘বাদশাহর দরবারে। তিনি তোমাকে দেখতে চেয়েছেন।’
‘ও, এই কথা! সেখানে আমি হেঁটেই যেতে পারব।’
এই বলে জামালের কোল থেকে নেমে গেল শিশুটা। তারপর হনহনিয়ে প্রাসাদের দিকে রওনা। তার পেছনে ছুটতে ছুটতে জামালের হাঁপ ধরে গেল। কিন্তু শিশুটা নির্বিকার।
বাদশাহর দরবারে ঢুকেই শিশুটা দৌড়ে গেল সিংহাসনে বসা বাদশাহর দিকে। বাদশাহর তো চোখ উল্টে পড়ে যাওয়ার জোগাড়। এটা কীভাবে সম্ভব! এত্তটুকুন এক পিচ্চি দৌড়ে আসছে।
শিশুটা সোজা গিয়ে এক লাফে বাদশাহর কোলে চড়ে বসল। বসেই তার গালে একটা ঠোকনা মেরে বলল, ‘এই যে ভদ্দর নোক, তুমি নাকি আমাকে দেখতে চেয়েছ?’
বাদশাহর বিস্ময়ের ঘোর তখনো কাটেনি। কাজেই মুখে কোনো কথা জোগাল না।
শিশুর মিহি কণ্ঠে এবার তেজ ফুটে উঠল, ‘এই যে আহম্মকের বাদশাহ, তুমি যে সাগরে মণিমুক্তা দিয়ে প্রাসাদ বানাতে বললে, ৪০ দিনে এমন কাজ কেউ করতে পারে? কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব?’
বলেই দুম করে বাদশাহর গালে একটা ঘুষি মেরে বসল শিশুটা। ঘুষি তো নয় যেন সাত মণি একটা বস্তা এসে পড়ল তার গালে। চরকির পাক শুরু হলো মাথায়।
শিশুটা আবার ঝাঁজিয়ে উঠল, ‘মাত্র ২০ দিনে কেউ স্ফটিকের সেতু বানাতে পারে? এটা সম্ভব?’
এই বলে বাদশাহর আরেকটা গালে ঢিসুম! এবার একটার জায়গায় দুটো করে জিনিস দেখতে লাগলেন বাদশাহ।
শিশুটাকে থামাবে কে? সে বাদশাহর কানে মোচড় দিয়ে বলল, ‘ডিম থেকে কখনো খচ্চর বের হয় রে, গর্দভ?’
বাদশাহ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে চিত্কার শুরু করলেন, ‘ও রে, হাঁ করে দেখছিস কী তোরা! এই হতচ্ছাড়া পিচ্চিটাকে এখনই তাড়া!’
শিশুটার কোমল চেহারাটা এবার ভয়ংকর হয়ে উঠল। চোখ পাকিয়ে বলল, ‘এক দিন বয়সী শিশুকে এত দূর হাঁটিয়ে এনে কথা বলাতে চাস, তোর সাহস তো কম নয়! একটা শিশুর কী শক্তি—দেখ ভালো করে!’
এই বলে বাদশাহর কপালে শেষ ঘুষিটা মারল শিশু। ঘুষি খেয়ে চিতপটাং বাদশাহ। একেবারে দাঁতকপাটি! শিশুটা এবার আগের মতোই হনহনিয়ে হেঁটে নেমে গেল সাগরে।
ব্যস, জেলেপুত্র আর মত্স্যকন্যার বিয়ে এখন আটকায় কে? সাত দিন, সাত রাত মহাধুমধামে উত্সব হলো সাগরে ভাসা সেই মণিমুক্তাখচিত প্রাসাদে। তারপর দুজন সুখে–শান্তিতে দিন কাটাতে লাগল।