লোকে লোকারণ্য গ্রামের মাঠ। সবাই হায় হায় করছে—এমন নিষ্ঠুর কাজ কেউ করতে পারে! নিরীহ একজন দিনমজুরকে কে এভাবে খুন করবে! বিশাল মাঠ। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে তাকালে ধোঁয়া ধোঁয়ামতো দেখা যায়। দূর থেকে মানুষকেও স্পষ্ট বোঝা যায় না। মনে হয় ছোট ছায়ার মতো কিছু একটা। অন্তহীন মাঠের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পাকা রাস্তা। দূরপাল্লার বাস-ট্রাক হর্ন বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। রাস্তার দুধার ঘেঁষে নানা গাছের সারি। এরই একটি বারোমাসি তালগাছের নিচে ঘাড় কেটে খুন করা হয়েছে আবুল হোসেনকে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে—তার নিজের দা দিয়েই তাকে খুন করা হয়েছে। পেছন থেকে কোপ দেওয়া হয়েছে ঘাড়ে। দাটা ঘাড়েই রয়ে গেছে। এমন ব্যস্ত রাস্তার পাশে কে এমন নৃশংস কাজ করল! তা ছাড়া আবুল হোসেন ছাপোষা মানুষ। কারও সাতেপাঁচে নেই। এ রকম মানুষকে এভাবে খুন! কারও মাথায় ঢুকছে না বিষয়টা। এদিকে স্বজনের কান্নায় চারদিক ভারী হয়ে যাচ্ছে। নানাজনে নানা কথা বলতে লাগল। কেউ বলল, লাশ তাড়াতাড়ি দাফনের ব্যবস্থা করা উচিত। আবার কেউ বলল, এ লাশ দাফন করা ঠিক হবে না। থানায় খবর দেওয়া উচিত। অবশেষে থানায় খবর দেওয়া হলো।
থানার বড় দারোগা গাড়ি নিয়ে হাজির। আবুল হোসেনের মৃত্যু নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড। গাঁয়ের মানুষ আলোচনার একটি বিষয় পেয়েছে। ছেলেপুলেদের সবাই ভিড় করেছে। তারা লাশের কাছে যায় আবার পুলিশ দেখে ভয়ে দৌড় দেয়। এটা যেন তাদের জন্য রোমাঞ্চের এক উপলক্ষ এনে দিয়েছে। পুলিশের দারোগা লাশের কাছে গেলেন। প্রথমে জানতে চাইলেন, ‘কে প্রথম দেখেছে?’ একজন ছমির গাওয়ালের নাম বললেন। ছমির গাওয়াল রকমারি জিনিস নিয়ে গ্রামে গ্রামে ফেরি করেন। তিনি এই রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় প্রথমে দেখতে পান। তার চিত্কার-চেঁচামেচিতেই প্রথমে মানুষ জড়ো হয়। তাকে ডাকা হলো। ছমির ভয়ে ভয়ে দারোগার কাছে এলেন। দারোগা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী দেখেছ?’ সে বলল, ‘স্যার,আমি দেখি আবুল হোসেন উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ঘাড় কাটা। রক্তে সবুজ ঘাস লাল হয়ে আছে। আমি ভয় পেয়ে চিত্কার দিই। আমার চিত্কারে মানুষ জড়ো হয়।’
‘গাছে তো কোনো তালই নেই!’ সোহরাব মাস্টার গাছের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটা বারোমাসি তালগাছ। সব সময় গাছে তাল থাকে। ভালো করে খুঁজে দেখুন, পাতার আড়ালে তাল লুকিয়ে আছে।’
‘আশপাশে কাউকে দেখেছ?’
‘না স্যার।’
‘সত্য করে বলো। নির্ভয়ে বলো।’
ছমির গাওয়াল বারবার একই কথা বললেন। তিনি কাউকে দেখেননি।
পুলিশ জেরা করে কিছু না পেয়ে লাশ গাড়িতে তুলতে বলল। ময়নাতদন্ত হবে। দারোগাবাবু আরেক গাড়িতে উঠে বসলেন। এমন সময় সোহরাব মাস্টার সেখানে হাজির। তিনি বৃদ্ধ মানুষ। তার ছায়ায় গ্রামের মানুষ শীতল হয়। যেকোনো বিপদে-আপদে মানুষ তার কাছে আসে। তিনি মানুষকে সুপরামর্শ দেন। আশপাশের গ্রাম থেকে সালিস-দরবার করার জন্য মানুষ তাকে নিতে আসে। ঘোড়ায় চড়ে চলাফেরা করেন তিনি। আবুল হোসেনের খুনের কথা শুনে পাশের গ্রাম থেকে ছুটে এসেছেন। ঘোড়া থেকে নামলেন সোহরাব মাস্টার। মানুষের মধ্যে একটা স্বস্তি ফিরে এল। তারা আশান্বিত হলো। যেহেতু মাস্টার সাহেব এসেছেন, একটা ব্যবস্থা হবেই।
তিনি পুরো বিষয়টি বুঝে নিলেন। যেখানে খুন হয়েছে সেখানে গেলেন। চারদিক ভালোভাবে দেখে নিলেন। হঠাৎ তিনি লক্ষ করলেন, উঁচু বাঁধ থেকে গড়িয়ে পড়া একটি তাল। তালটি কুড়িয়ে হাতে নিলেন সোহরাব মাস্টার। তালের একপাশ রক্তাক্ত। তাতে ছেনি দার পিঠের চিহ্ন লেগে আছে। তিনি উচ্চ স্বরে বললেন, ‘খুনি ধরা পড়েছে।’ মানুষের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল। তাকে মানুষ ঘিরে ধরল। তিনি পুলিশের গাড়ির সামনে গেলেন। দারোগা সাহেবকে বললেন, ‘এই হলো আততায়ী তাল। আমি নিশ্চিত এই তাল পড়েই সে মারা গেছে। এই যে দেখেন, তালের গায়ে রক্ত।’ দারোগা সাহেব গাড়ি থেকে নেমে এলেন। রক্তাক্ত তালটা দেখলেন, কিন্তু বুঝে উঠতে পারলেন না কীভাবে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। সোহরাব মাস্টার বুঝিয়ে বললেন, ‘আবুল হোসেন উদোম গায়ে পাট কাটছিলেন। তার গায়ে পাটের পাতা এবং অন্যান্য ময়লা এখনো লেগে আছে। তিনি তালগাছের নিচে বসে জিরোচ্ছিলেন। তার গা চুলকাচ্ছিল। হাতের দা দিয়ে ঘাড় চুলকাচ্ছিলেন আবুল হোসেন। এমন সময় গাছ থেকে তাল পড়ে ঠিক তার দার ওপর। এত ওপর থেকে তাল পড়েই ঘাড় কেটে গেছে আবুলের।’
দারোগা সাহেব গাছের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘গাছে তো কোনো তালই নেই!’
সোহরাব মাস্টার গাছের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটা বারোমাসি তালগাছ। সব সময় গাছে তাল থাকে। ভালো করে খুঁজে দেখুন, পাতার আড়ালে তাল লুকিয়ে আছে।’
বিষয়টি দারোগা সাহেবকে চিন্তায় ফেলে দিল। কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। এবার সোহরাব মাস্টার বললেন, ‘আপনারা পুলিশ। সবকিছুকে সন্দেহের চোখে দেখেন। আমার মনে হয় কোনো কিছুকে সহজভাবে দেখলেই ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। আর জটিলভাবে দেখলে জটিল হয়ে যায়।’ সোহরাব মাস্টারের কথায় সবাই সায় দিল। শেষে দারোগা সাহেব অপমৃত্যু মামলা দিয়ে লাশ রেখে চলে গেলেন।