স্টার কোয়েস্ট ২ (প্রথম পর্ব)

অলংকরণ: তুলি

এক

শুক্রবারের বিকেল। উইকএন্ডের আগের দিন। ক্লাস টিচার ক্লারা ডেনিম বেশ উঁচু স্বরে ঘোষণা করলেন ছবিটা বাজারে ছাড়ার আগেই প্রিভিউ করার জন্য তাঁর থার্ড গ্রেড ক্লাসকে ২৫টি টিকিট ফ্রি দেওয়া হয়েছে। ক্লাসের আর সবার মতো এ খবরে চমকিত হলো না তিন কন্যা। শুধু মুখ টিপে হাসল। ওরা আগে থেকেই জানে।

‘আমার এক বন্ধু পাসগুলো জোগাড় করেছেন,’ মিস ক্লারা বললেন। ‘তোমরা উত্তেজিত না হয়ে চুপচাপ বসো। আমি টিকিটগুলো বিতরণ করছি।’

নিজেকে গম্ভীর রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন তিনি। মেয়েদের কাণ্ড দেখে হেসে ফেললেন। তাঁর ছাত্ররা কোনোমতেই উত্তেজনা কমিয়ে চুপচাপ বসা কিংবা ফিসফিসানি বন্ধ করতে পারছে না।

বাতাসে হাত নাড়ল রুবেলা জনসন। ‘মিস, বাড়তি আরেকটা টিকিট হবে, আমার কাজিন জুলির জন্য? উইকএন্ডে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবে। স্টার কোয়েস্টের অন্ধ ভক্ত।’

মাথা নাড়লেন মিস ক্লারা। ‘আমার ক্লাসের প্রতি ছাত্রের প্রতিজনের জন্য গুনে গুনে একটা করে টিকিটই দেওয়া হয়েছে। আমি দুঃখিত, রুবি।’

স্কুল ছুটির ঘণ্টা বাজল।

‘লাইন ধরে আসো, যাতে টিকিটগুলো ঠিকমতো দিতে পারি,’ মিস ক্লারা বললেন। ‘আর মনে রাখবে, রোববার বিকেল ঠিক চারটে তিরিশ মিনিটে রিচমন্ডভিল সিনেমা হলে শুরু হবে ছবি।’ জানালা দিয়ে বাইরে চোখ পড়ল তার। ‘আরে, এরই মধ্যে মেঘ জমে গেছে! ঝড় হবে! সারাটা দিন এত রোদ গেল, ভাবাই যায়নি আজ বৃষ্টি হবে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও।’

সারি দিয়ে ক্লাস থেকে বেরোতে লাগল ছাত্ররা। প্রত্যেকের হাতে একটা করে টিকিট ধরিয়ে দিলেন মিস ক্লারা। টিকিটগুলো ছোট আকারের আয়তাকার কাগজের টুকরো। চারপাশে গোলাপি বর্ডার। গোলাপি বর্ডারের প্রতি মনে হয় বিশেষ আকর্ষণ আছে ফ্যান্টমল্যান্ড কোম্পানির।

বাইরে বেরিয়ে লরার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল জারা আর সারা। লরা বেরোলে ছাত্রদের স্রোতে গা মিশিয়ে দিয়ে জোরে হেঁটে চলল তিনজনে।

‘স্টার কোয়েস্ট ২ দেখার জন্য আর তর সইছে না আমার,’ সারা বলল। ‘ইশ্, আজ, এখনি যদি রোববার বিকেল হয়ে যেত!’

‘আমারও একই অবস্থা,’ জারা বলল। ‘প্রথম ছবিটা তো ভীষণ ভালো লেগেছে আমার। সিডিতে কতবার যে দেখেছি।’

‘নতুন ছবিটা যদি তার অর্ধেক ভালোও হয়, দেখে মজা পাব,’ লরা বলল। ‘আরেকটা কথা ভাবতে ভালো লাগছে, আমরা দেখব প্রিভিউ—সাধারণ দর্শকদের এক সপ্তাহ আগেই আমরা দেখে ফেলব।’

ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে স্কুল বিল্ডিংটা থেকে বেরিয়ে এল তিন কন্যা। স্কুল চত্বর দিয়ে এগোল। শুক্রবারের বিকেলে সব সময়ই হট্টগোল বেশি হয়। ছুটির আনন্দে সবাই খুশি, হাসাহাসি, হইচই, কথাবার্তাও বেশি।

জারা তার টিকিটটা ভালো করে দেখল। ‘এই শোনো, একটা জিনিস লক্ষ করেছ? টিকিটটা অবিকল স্টার কোয়েস্টের ট্রেডিং কার্ডের মতো। পেছনে স্টার-ফাইটার জাইলের ছবি আঁকা।’

‘আমারটাতে রোবট ডগ আরএফএফ,’ লরা বলল।

‘বাহ্!’ সারা বলল। ‘জারা তো ঠিকই বলেছে—স্টার কোয়েস্টের ট্রেডিং কার্ড, তবে কাগজটা পাতলা। শুধু তা-ই নয়, আমারটাতে আঁকা আমার প্রিয় চরিত্র কেমা দা অ্যান্ড্রয়েড!’

‘উফ্!’ লরা বলল, ‘ঠান্ডাটা কী পড়েছে, দেখেছ!’ লাল সোয়েট শার্টের তলায় কেঁপে উঠল তার দেহটা।

‘হ্যাঁ!’ হাঁটা থামিয়ে জ্যাকেটের বোতাম লাগাতে শুরু করল সারা। দমকা বাতাস পাক খেয়ে ঝাপটা দিয়ে গেল ওদের।

‘হায় হায়! আমার টিকিট!’ চিৎকার করে উঠল সারা।

ঝোড়ো বাতাস যেন টান দিয়ে তার হাত থেকে কার্ডটা কেড়ে নিল। তাড়াতাড়ি নিজের টিকিটটা পকেটে ঢুকিয়ে সারার টিকিটটার পেছনে দৌড় দিল জারা। লরাও দৌড়াল। সারা নিজেও দৌড়াতে লাগল। ছুটতে ছুটতে স্কুল চত্বর পেরিয়ে এল ওরা। প্রতিবারেই টিকিটটা মুহূর্তের জন্য থামলে তোলার জন্য যেই হাত বাড়ায়, নতুনভাবে বাতাস এসে ঝাপটা দিয়ে আবার সরিয়ে নিয়ে যায়।

‘আরে, বাতাস দেখি রসিকতা শুরু করল আমাদের সঙ্গে!’ জারা বলল। ‘বৃষ্টিও তো পড়া শুরু হলো!’

প্রথমে বড় বড় একটা দুটো করে ফোঁটা। তারপর ঘন। যেকোনো মুহূর্তে মুষলধারে শুরু হতে পারে। চত্বরের ছেলেমেয়েরা একেকজন একেক দিকে দৌড় দিল। দৌড়ে গিয়ে স্কুল বিল্ডিংটাতে উঠল আবার কিছু।

সারার টিকিটটা ধরার জন্য ছুটছে লরা। হঠাৎ থাবা দিয়ে ধরে ফেলে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ধরেছি! ধরেছি!’

জারা বলল, ‘বৃষ্টি থেকে বাঁচা দরকার। চলো স্কুল ক্যান্ডিতে ঢুকে পড়ি।’

স্কুল চত্বরের পাশে একটা ছোট দোকান, ‘স্কুল ক্যান্ডি’ ওটার নাম। সেদিকে আরও অনেকের সঙ্গে দৌড় দিল তিন কন্যা।

দোকানের উইন্ডোতে রাখা নানা জিনিস। স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকদের কাজে ব্যবহৃত হয় এমন জিনিসই বেশি। যেমন বই, খাতা, কাগজ, নোটবুক, ডায়েরি, কলম, পেনসিল। এ ছাড়া আছে খেলনা আর নানা ধরনের বাহারি জিনিস। আছে প্রচুর ক্যান্ডি। দোকানের দরজার ওপর লাল, সাদা আর নীল রঙে বড় বড় অক্ষরে লেখা নাম: দ্য স্কুল ক্যান্ডি।

হালকা বাদামি চুল, সরু ফ্রেমের চশমা পরা একজন লোক দরজাটা খুলে ধরে রাখলেন। দোকানের মালিক তিনি। তাঁর নাম ক্যান্ডারসন হুয়াম। কিন্তু ছোট-বড় সবাই ডাকে ক্যান্ডি। তাতে তিনি কিছু মনে করেন না। বরং মজাই পান।

‘এসো এসো, সবাই এসো!’ সুর করে মাথা দুলিয়ে বললেন তিনি। ‘ভেজা মেঝে পিছলে পড়ো।’ পরক্ষণেই হেসে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, ‘আরে না না, রসিকতা করলাম! সাবধান থাকো, যেন পিছলে না পড়ো।’ কাপড় ভেজা ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে নিজের স্কুলজীবনের কথা মনে করেই যেন মজা পেয়ে মিটিমিটি হাসছে তাঁর নীল চোখ।

বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দোকানে ঢোকা ছেলেমেয়েদের ভিড় ঠেলে ঢুকল তিন কন্যা। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওরাও হাসাহাসি করতে লাগল।

চারপাশে তাকাল জারা। কাউন্টার আর তাকগুলো গাঢ় রঙের কাঠ দিয়ে তৈরি। চকচকে পালিশ করা কাঠের মেঝে। পুরোনো আমলের একটা ফ্যান ঝুলছে মাথার ওপর। ক্যান্ডি তো বটেই, তাঁর বাবাও ছোটবেলায় এখানে নিয়মিত ঢুকতেন, এই স্কুলে পড়তেন। দোকানটার আদি মালিক ক্যান্ডির দাদা। ভাবতে কেমন অদ্ভুত লাগে, জারার মনে হলো। দাদার দোকানে ক্যান্ডি এখন বাবার বয়সী হয়ে মাল বিক্রি করছে।

‘বৃষ্টি আরও হয়েছে, তবে এত ছেলেমেয়ে একসঙ্গে এখানে কমই দেখেছি,’ সারা-লরার দিকে কাত হয়ে এলেন তিনি। ‘এত ঠাসাঠাসি—মনে হচ্ছে না টিনে ভরা সার্ডিন মাছ?’

‘মাছ?’ লরাও পাল্টা রসিকতা করল। ‘তুলনা দেওয়ার জন্য আর কিছু পেলেন না? বয়ামভরা ক্যান্ডির মতো গাদাগাদি বললেও মিষ্টি লাগত!’

‘বাহ্, ভালো বলেছ!’ হা হা করে হাসতে লাগলেন ক্যান্ডি।

শরীর মুচড়ে ক্যাশ রেজিস্টারটার কাছ থেকে সরে এল তিন কন্যা। কনুইয়ের গুঁতো মেরে, ঠেলে-ধাক্কিয়ে এগোতে থাকল, যতক্ষণ না কিছুটা ফাঁকার মধ্যে আসতে পারল। একটা ডিসপ্লে র্যাকের সামনে। তাকে সাজানো রয়েছে ক্লিপ, টেপ, রঙিন পেনসিল, মার্কার, নোটবুক ইত্যাদি। আর বেশি এগোনো যাবে না। অনেক বেশি ভিড়।

‘উফ্, আমার পায়ের আঙুলগুলো একেবারে ভর্তা করে দিলে!’ চেঁচিয়ে উঠল ডিসপ্লে র্যাকের কাছে দাঁড়ানো পিটার জোনস নামের একটা ছেলে।

‘ইচ্ছে করে তো আর মাড়াইনি!’ পাল্টা ফুঁসে উঠে লরা জবাব দিল। ‘তুমিই বা আমার পায়ের নিচে পা দিলে কেন?’

ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল জারা। কপালে এসে পড়া ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে সরাল। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে সিনেমার টিকিটটা বের করল। ‘এহেহ, ভিজে তো একেবারে যা তা!’

‘আমারটার অবস্থা দেখো,’ ভেজা, ময়লা লাগা টিকিটটা তুলে ধরল সারা। ‘ভর্তা!’

‘হুঁ!’ মাথা ঝাঁকাল লরা। ‘তবু মন্দের ভালো যে বাতাসে উড়ে যায়নি।’

‘ফ্রি পাস যেন আমাদের জন্য কুফা! পেলেই একটা না একটা ঝামেলা বাধে!’ জারা বলল। ‘দেখি, আমারটা নোটবুকের ভেতর ভরে রাখি। শুকিয়ে সমান হয়ে যাবে।’ ব্যাকপ্যাকটা পিঠ থেকে খুলে নিয়ে জিপার খুলল সে। ভেতর থেকে টেনে বের করল চকচকে নীল কভার লাগানো তার বিখ্যাত নোটবুকটা। জারার জন্মদিনে বাবা তাকে নোটবুকটা উপহার দিয়েছেন। কোনো রহস্যের তদন্তের সময় এটাতে সে সন্দেহভাজনদের নামধাম, সূত্র ইত্যাদি লিখে রাখে।

‘সঙ্গে রেখেছ কেন?’ সারা বলল। ‘কোনো কেস তো নেই।’

‘রেখেছিলাম, আর বের করা হয়নি। ভালোই হলো। টিকিটটা রাখতে পারলাম,’ জবাব দিল জারা।

নিজের টিকিটটা বাড়িয়ে দিল সারা। ‘আমারটাও রাখো।’

‘আমারটাও,’ লরা বলল।

সারা-লরা দুজনের দুটো ভেজা টিকিট ওদের দুটোও নিল জারা। নোটবুকে ভরে রাখল।

ব্যঙ্গ করল পিটার, ‘বাহ্, সেরা গোয়েন্দার সেরা নোটবুক।’

‘সেরাই তো, তাতে কি কোনো সন্দেহ আছে?’ ঝাঁজিয়ে উঠল লরা। ‘পারলে একটা কেস সমাধান করে দেখাও।’

‘তা-ই দেখাব!’ চ্যালেঞ্জটা নিয়ে নিল পিটার। ‘জারার চেয়ে ভালো করব আমি। সেরা ডিটেকটিভ।’

অলংকরণ: তুলি

আরেকজন সহপাঠী নিনা বার্ড যোগ দিল তর্কে, ‘শুধু গোয়েন্দারাই রহস্য সমাধান করে না। এই যে, আমার মতো পত্রিকার রিপোর্টাররাও অহরহ রহস্যের সমাধান করছে।’

এই বয়সেই নিজের পত্রিকা আছে, নাম দ্য বার্ড নিউজ। তাতে নিজে লেখে, নিজে স্কুলে বিলি করে। নিনার বাবার পত্রিকা ছাপার প্রেস আছে। নিনাকে পত্রিকা বের করতে সব রকমে সাহায্য করেন। বাড়িতে কম্পিউটারে টাইপ করে পত্রিকার লেখাগুলো লেখে নিনা।

‘সবাই যদি এত বড় বড় গোয়েন্দা হয়ে থাকো, তাহলে আমাকে একটা সাহায্য করো না,’ বলল রুবেলা জনসন। ‘স্টার কোয়েস্ট ২-এর আরেকটা টিকিট খুঁজছি আমি। দাও এনে আমাকে একটা টিকিট। নইলে ছবিটা দেখা হবে না আমার।’ রুবির খাটো করে ছাঁটা কালো চুলগুলো বৃষ্টিতে ভিজে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। এমনকি চোখের পাপড়ি বেয়েও ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে। মনমরা হয়ে আছে।

‘কেন?’ জারা জিজ্ঞেস করল। ‘তোমার টিকিটটা কোথায়?’

রুবি বলল, ‘ক্লাসেই তো বললাম, আমার কাজিন জুলি শিকাগো থেকে বেড়াতে আসছে,’ রুবি বলল। ‘জন্মদিনটা আমাদের বাড়িতে উদ্যাপন করবে। আর সেদিনই সিনেমা দেখা। তাই আমার মা কোনোমতেই জুলিকে বাড়িতে রেখে একা আমাকে সিনেমা দেখতে দেবে না।’

‘এই তো রহস্য পেয়ে গেলে,’ জারাকে বলে উঠল জোনাথন। ‘তুমি যদি এতই সুপার-ডুপার ডিটেকটিভ হয়ে থাকো, করে ফেলো এই রহস্যের সমাধান। বলো, কী বলবে? দশ সেকেন্ড সময় দিলাম।’

হেসে উঠল পিটার। বুড়ো আঙুল তুলে সমর্থন জানাল জোনাথনকে। মাথা দুলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, করে ফেলো।’

মনে মনে রাগ হলেও মুখে কিছু বলল না জারা। শুধু কাঁধ ঝাঁকাল। ‘তোমার দশ সেকেন্ড আমার দরকার নেই, জোনাথন, কারণ এটা কোনো রহস্য নয়। কোনটা রহস্য, আর কোনটা অন্য সমস্যা, আগে সেটা বোঝার চেষ্টা করো, তারপর গোয়েন্দাগিরি করতে এসো। আরও একটা কথা জানিয়ে দিচ্ছি, গোয়েন্দাগিরি তোমার বেসবল খেলা নয়।’

‘কী, বেসবল সহজ? খেলে দেখাও না,’ জোনাথন বলল।

‘না, আমি পারব না,’ জারা বলল, ‘আগেই হার স্বীকার করে নিচ্ছি। আমি বেসবল চর্চা করি না, কাজেই খেলতেও পারব না।’

‘তবে আমি তর্ক করব,’ পিটার বলল। ‘আমি বেসবলও খেলতে পারি, রহস্য পেলে সেটার সমাধান করে দিতে পারব। আর এমনভাবেই করব, আমি হব সেরা গোয়েন্দা।’

‘ঘোড়ার ডিম হবে!’ ভুরু নাচাল লরা।

‘হব! হব! হব! যত কেরামতি নীল নোটবুকের। ওটা আমাকে দাও, দেখবে পারি কি না,’ বলতে বলতে জারার হাত থেকে নোটবুকটা কেড়ে নিল পিটার।

থাবা মেরে আবার নোটবুকটা ফেরত নিল জারা। নিজের ব্যাকপ্যাকের জিপার খুলে তার ভেতর ঢুকিয়ে ফেলল নোটবুকটা।

ঠিক এই সময় বিদ্যুৎ চমকাল। তীব্র নীলচে আলো ঝিলিক দিয়ে গেল। জানালার কাচের ভেতর দিয়ে দেখা গেল সেই আলো। মনে হলো যেন দোকানের জানালাতেই বাজটা পড়েছে। প্রচণ্ড শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠল বাড়িটা।

কারেন্ট চলে গেল। দপ করে নিভে গেল সমস্ত আলো!

দুই

‘উফ্!’ আমার কান টানল কে?’ ভিড়ের মধ্যে চেঁচিয়ে উঠল একজন।

‘সরি, আমি একটা কিছু ধরে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,’ জবাব দিল আরেকজন। ‘চোখে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না।’

শেষ বিকেলের রোদের আলো মুছে দিয়েছে ঝোড়ো মেঘের অন্ধকার। আকাশটা কালো। তার ওপর বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় দোকানের ভেতরেও রাতের মতো অন্ধকার।

‘বাচ্চারা, তোমরা ভয় পেয়ো না,’ শোনা গেল ক্যান্ডি হুয়ামের ভরাট কণ্ঠ। ‘যে যেখানে আছ, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো। যেকোনো মুহূর্তে বাতি চলে আসবে...তাড়াতাড়ি এলেই খুশি হই!’

‘অ্যাই, ধাক্কা মারলে কে?’ অন্ধকারে জারার কণ্ঠ শোনা গেল। ‘লরা, তুমি নাকি?’

‘না, আমি,’ জবাব দিল একটা মেয়ে। ‘এ আবার কে ধাক্কা মারল? এই, পিটার নাকি?’

‘আমার বুকে এভাবে কনুই মারছ কেন?’ চেঁচিয়ে উঠল পিটার। ‘আর ইচ্ছে করে তো ধাক্কা মারিনি। কে যেন পেছন থেকে আমাকে ঠেলছে...’

‘সরি,’ রুবি বলল। ‘এই যে, আমি সরে যাচ্ছি।’

‘বেশি সোরো না!’ চেঁচিয়ে উঠল জারা। ‘ওখানে একটা ডিসপ্লে স্ট্যান্ড...’

তবে সাবধান করতে দেরি করে ফেলেছে জারা।

ধাতব কিছু মেঝেতে পড়ার বিকট শব্দ হলো।

বদ্ধ ঘরে শব্দটা এতই বেশি শোনাল, মনে হলো যেন ছোটখাটো বাজ পড়ল আরেকবার।

‘উফ্, মরে গেলাম!’ শোনা গেল সারার চিৎকার। ‘আমার ওপর পড়েছে...’

এরপর শুরু হলো যেন নরক গুলজার। হই-হট্টগোল। এলোমেলো চিৎকারে কে যে চেঁচাচ্ছে, সেটা বোঝাই কঠিন। সামনে এগোতে গিয়ে কার পায়ে যেন হোঁচট খেল জারা। দুই হাত ছুড়ে দিয়ে কিছু ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করল, পারল না, উপুড় হয়ে পড়ল—অর্ধেক শরীর কাঠের মেঝেতে, বাকি অর্ধেক কারও গায়ের ওপর।

‘এই, কেউ ব্যথা পেয়েছ?’ শোনা গেল ক্যান্ডির চিৎকার। ‘প্লিজ, সবাই চুপ করো, যাতে আমি বুঝতে পারি কেউ ব্যথা পেল কি না।’

কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। ডান হাতে খুঁজল জারা, তার কাছাকাছি কে রয়েছে। হাতে ঠেকল একজনের কাঁধ, একটা ব্যাকপ্যাক, ছড়িয়ে পড়া পেপার ক্লিপ, অসংখ্য নোটবুক, আর কয়েকটা পেনসিল।

আবার চিৎকার করে বললেন ক্যান্ডি, ‘সবাই শান্ত থাকো, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো। আলো আসার আগে পর্যন্ত বরফ হয়ে গেছ মনে করো।’ নিজের রসিকতায় নিজেই হাসলেন, ‘হাহ্ হাহ্ হাহ্!’

জারার বাঁ পাশ থেকে বলে উঠল একজন, ‘বরফ হতে পারব না। তবে ভেজা পাথর হতে পারব!’ সে-ও তার নিজের রসিকতায় হা-হা করে হাসল, আর কেউ হাসল না।

‘আমার গায়ের নিচে কে?’ জারা জিজ্ঞেস করল।

‘আমি,’ লরা জবাব দিল।

‘উফ্! এই লাথি মারল কে?’ চেঁচিয়ে উঠল সারা। ‘পিটার...’

‘লাথি মারিনি,’ পিটার জবাব দিল। ‘উঠে বসার চেষ্টা করছি তো, পা লেগে গেছে...’

হঠাৎ বাতি জ্বলে উঠল।

‘উহ্, বাঁচা গেল!’ ক্যান্ডি বললেন। তাড়াহুড়ো করে এগোলেন পড়ে যাওয়া ডিসপ্লেটার দিকে। সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন, ঘরের ভেতর কতখানি ঝড় বওয়ানো হয়েছে।

কে কোথায় আছে দেখল জারা। রুবি, নিনা, পিটার, লরা আর সারা উঠে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের কাপড় ঝাড়ল। তারপর মেঝেতে পড়ে যাওয়া জিনিসপত্র তুলতে লাগল।

সামনের দরজার ঘণ্টা বেজে উঠল।

‘এই, জারা আছে এখানে?’ দরজার কাছ থেকে বলে উঠল একটা কণ্ঠ।

ঘুরে তাকিয়ে হাত নাড়ল জারা। ‘কোরি আন্টি! আমি এখানে।’

জারার দিকে কয়েক পা এগোলেন মিসেস কোরি। ‘হায় হায়! এ কী কাণ্ড?’

‘হ্যাঁ, পুরোটাই জঞ্জাল হয়ে গেছে,’ ক্যান্ডি বললেন। ‘তবে কেউ জখম হয়নি। বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। তারপর একটা ডিসপ্লে র‌্যাক উল্টে পড়েছিল।’

‘বৃষ্টি দেখে আমি তোমাকে খুঁজতে বেরোই,’ জারাকে বললেন কোরি। ‘মনে হলো এখানেই পাওয়া যাবে।’

জারা-সারা-লরাকে ওদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে সাহায্য করলেন কোরি। ডিসপ্লে র‌্যাকটা তুলতে ক্যান্ডিকে সহযোগিতা করল কয়েকটা ছেলেমেয়ে। বাকিরা মেঝেতে ছড়িয়ে পড়া জিনিসপত্র তুলে দিতে লাগল।

‘আমি তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দেব,’ লরা-সারাকে বললেন কোরি। ‘তাড়াতাড়ি করো। পার্কিং প্লেস না পেয়ে রাস্তার ওপর গাড়ি রেখেছি।’

‘আমার ব্যাকপ্যাকটা খুঁজে পাচ্ছি না,’ জারা বলল।

‘এটা না?’ বেগুনি রঙের একটা ব্যাগ বাড়িয়ে দিল নিনা।

‘হ্যাঁ,’ ব্যাগটা নিল জারা।

ভিড়ের মধ্য দিয়ে পথ করে করে দরজার দিকে এগোলেন কোরি। পেছন পেছন এল তিন কন্যা। ‘জলদি চলো। এতক্ষণে হয়তো আমার গাড়ির কারণে ট্রাফিক জ্যাম হয়ে গেছে।’

অলংকরণ: তুলি

ডিসপ্লে র‌্যাক থেকে মেঝেতে পড়ে যাওয়া জিনিসগুলোর দিকে ফিরে তাকাল জারা। ক্যান্ডিকে বলল, ‘আপনাকে সত্যিই ঝামেলায় ফেললাম।’

‘না না, কিসের ঝামেলা?’ হেসে বললেন ক্যান্ডি। ‘এর থেকে যদি আবহাওয়া রিপোর্টে বলে তোমাদের স্কুল ছুটির সময় বৃষ্টির আশঙ্কা আছে, দোকানের জিনিসপত্র সব সরিয়ে রাখব, যাতে তোমরা দাঁড়ানোর জায়গা পাও।’

লরা-সারাকে যার যার বাড়ি পৌঁছে দিলেন মিসেস কোরি। তারপর জারাকে নিয়ে বাড়ি এলেন।

‘তাড়াতাড়ি গিয়ে ভেজা জামাকাপড়গুলো খুলে ফেলো,’ কোরি বললেন। ‘নইলে সর্দি লাগবে। গরম পানিতে গোসল করে নাও, আরাম পাবে।’

‘এক মগ গরম কোকো পেলে আরও আরাম হয় না?’ হেসে বলল জারা।

কোরিও হাসলেন। ‘তুমি গোসল করে বেরোও, টেবিলে কোকো রেডি পাবে।’

গোসল সেরে, কোকো খেয়ে, লাইব্রেরি থেকে আনা একটা বই পড়তে লাগল জারা, যতক্ষণ না তার বাবা বাড়ি ফিরলেন। তারপর মেয়েকে নিয়ে ডিনারে বসলেন।

‘বেবি শার্লক, তোমার খবর কী?’ জিজ্ঞেস করলেন মি. আজিজ। মেয়েকে আদর করে নানা নামে ডাকেন তিনি। এই যেমন আপেল বেবি, আপেল কুঁড়ি, শিউলি ফুল। তবে বেবি শার্লক ডাকেন মজা করে, মেয়ে বড় গোয়েন্দা, এটা প্রচার হয়ে যাওয়ার পর। ‘শুনলাম, খুব নাকি ভিজেছিলে?’

খিলখিল করে হাসল জারা। ‘ভিজেছি, তবে তুমি যে ভঙ্গিতে বলছ, তেমন কিছু নয়।’ তারপর স্কুল থেকে বেরোনোর পর কীভাবে হঠাৎ ঝড় এসে গিয়েছিল, কীভাবে ক্যান্ডির দোকানে ঢুকে বেকায়দায় পড়েছিল, বাবাকে জানাল সে। এমনকি স্টার কোয়েস্ট ২ ছবিটা দেখার জন্য ফ্রি টিকিট পাওয়ার কথাও জানাল।

‘হুম্ম্! রোববার বিকেল সাড়ে চারটা!’ গম্ভীর হওয়ার ভান করলেন মি. আজিজ। ‘ওই সময় তোমার আর মিসেস কোরির না আলমারি পরিষ্কার করার কথা?’

বাবার রসিকতা বুঝে ফেলে জারাও গম্ভীর হওয়ার ভান করল। ‘এই ছবিটা আমি কোনো কিছুর বিনিময়েই মিস করতে রাজি নই। বিশেষ করে, আলমারি পরিষ্কারের মতো সাধারণ একটা কাজের জন্য।’

খাবার টেবিলে বাবা-মেয়ের এমন রসিকতা আর কথাবার্তা প্রায়ই হয়। মিসেস কোরি সামনে থাকলে বিষয়টা খুব উপভোগ করেন।

খাওয়ার পর জারা যখন টেবিল মুছছে, লরা ফোন করল।

‘কাল সকালে ইন-লাইন স্কেটিং করার জন্য আসছ তো?’ লরা জিজ্ঞেস করল। আগে থেকেই দুজনের মধ্যে কথা হয়েছিল, ইন-লাইন স্কেটিংয়ের সময় কীভাবে ডানে-বাঁয়ে ঘুরতে হয়, জারাকে  শেখাবে লরা।

‘আসব, সকাল ঠিক দশটায়,’ জারা জবাব দিল। ‘সারাও আসছে নাকি?’

‘নাহ্!’ লরা জানাল। ‘জানোই তো, ইন-লাইন স্কেটিং তার পছন্দ না, তার পছন্দ আইস স্কেটিং।’ তারপর লরা জিজ্ঞেস করল, ‘সিনেমার টিকিটগুলো ঠিকঠাকমতো আছে তো?’

‘থাকারই তো কথা,’ জারা বলল। ‘তোমাদের সামনেই তো নোটবুকে ভরে ব্যাকপ্যাকে রেখেছি।’

‘হ্যাঁ, দেখলাম তো,’ লরা বলল। ‘আমি এমনি জিজ্ঞেস করলাম, কোনো কিছু ভেবে করিনি।’

‘আছে, চিন্তা কোরো না,’ জারা বলল। ‘এতক্ষণে নিশ্চয় শুকিয়ে ঝরঝরে হয়ে গেছে। এখনই গিয়ে দেখব।’

কথা শেষ করে রিসিভার রেখে দিল জারা। ভিজে যাওয়ার কারণে বারান্দার মেঝেতে ফেলে রেখেছে ব্যাকপ্যাকটা। সেটার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসল। জিপার খুলে ভেতরে হাত ঢুকিয়েই ধড়াস করে উঠল বুক। ব্যাগের খোলা মুখটা উপুড় করে জোরে ঝাঁকি দিল। ভেতরের সমস্ত জিনিস বেরিয়ে মেঝেতে পড়ল।

দম আটকে যেতে চাইল তার। সব আছে, শুধু নোটবুকটা ছাড়া!

চলবে...

আরও পড়ুন