আহসান হাবীবের ‘মিশন গাজীপুর’ (শেষ পর্ব)

অলংকরণ: মামুন হোসাইন

দেয়াল টপকাতে নাফিসের খুব একটা অসুবিধা হলো না, স্কাউট জাম্বুরিতে এ রকম অনেক কিছু টপকেছে তারা বিশেষ ধরনের দড়ির গিট্টু মারা মই দিয়ে। এসব কাজে সে ওস্তাদ। মন্টুর ঘরটা খুঁজে বের করতেও খুব অসুবিধা হলো না। তালা মারা। তালাটা টিপ তালা। হাতুড়ি দিয়ে একটা বাড়ি দিলেই ভেঙে যাবে। কিন্তু নাফিস সেদিকে গেল না, পকেট থেকে বের করল তার সেই বিখ্যাত স্কাউট ছুরিটা। এখানে একটা অপশন আছে মাস্টার কি নাইফ। ওটা তালায় ঢোকানোর আগে ফিসফিস করে ডাকল একবার, ‘মন্টু?’

মন্টু লাফ দিয়ে দরজার কাছে চলে এল।

কে?

আমি নাফিস

নাফিস? তু-তুই কীভাবে এখানে?

বিটুল ভাইয়ের সঙ্গে এসেছি আমরা।

সত্যি?

হ্যাঁ... দাঁড়া তালা খুলি... চুপ থাক।

আচ্ছা।

ছুরিটা তালার ফুটোয় ঢুকিয়ে চাপ দিল, কট করে একটা শব্দ করে খুলে গেল তালাটা। হাট করে খুলে গেল দরজা। মন্টু ঝাঁপিয়ে এসে জাপটে ধরল প্রিয় বন্ধু নাফিসকে। ‘কীভাবে ঢুকলি? ওরা কোথায়?’

শশশ, শব্দ করিস না। চল, পরে সব জানবি।

গেট খোলা। খোলা গেটের বাইরে বিটুল ভাই দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে দারোয়ান দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বাতাসে কোপ মারছে। আশপাশে সবাই হাসি চাপছে কষ্ট করে। খেলার নিয়ম অনুসারে দু হাত ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকবে। মাঝখানে কোপ মারবে দারোয়ান, বিটুল ভাই হাত সরিয়ে নিয়েছে। আর দারোয়ান উচ্চ স্বরে গুনে যাচ্ছে ... ৩৩  ৩৪  ৩৫  ৩৬  ৩৭  ৩৮  ...

বিটুল ভাই মুখে বলছে শাবাশ, দারুণ হচ্ছে। ১০০ পর্যন্ত পারলে পুরস্কার আছে। চালিয়ে যান, বিটুল ভাই অবশ্য অনেক আগেই তার  দুই হাত সরিয়ে নিয়েছে। দারোয়ান বেচারা একা একাই বাতাসে কোপ মেরে যাচ্ছে। খুবই হাস্যকর দৃশ্য। বিটুল ভাই চোখ দিয়ে ইশারা করে সবাইকে। মন্টু আর নাফিস সাবধানে গেট ফাঁক করে গিয়ে একটু দূরে রাখা গাড়িতে ওঠে। অন্যরাও ওঠে। বিটুল উঠে গাড়ি স্টার্ট দেয়। নোয়া গাড়িটা নতুন। প্রায় নিঃশব্দে বের হয়ে যায়। দারোয়ান টের পায় না। সে অন্ধের মতো তখনো বাতাসে কোপ মারতে থাকে ... ৬৭   ৬৮  ৬৯  ৭০  ৭১  ৭২  ...!

ওরা যখন মাইক্রোতে করে বাজারের মোড় ঘুরছে। তখন দেখা গেল চেয়ারম্যান সাহেবকে। হাতে গাদা বন্দুক। সঙ্গে দুটো লোক। তাদের একজনের হাতে কিছু মরা অতিথি পাখি। মন্টু ঝপ করে মাথা নিচু করে বসে পড়ল। তার মামা। বিটুল আস্তে করে গাড়িটা স্লো করল। বলল, ‘স্লামালিকুম চেয়ারম্যান সাহেব। ভালো আছেন?’

চেয়ারম্যান সাহেব অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন ওদের দিকে। কিছু বলার আগেই মানিক জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলল, আঙ্কেল আপনি অতিথি পাখি শিকার করলেন কেন? জানেন না অতিথি পাখি শিকার করা অপরাধ? ধরা পড়লে আপনার জেল হয়ে যাবে কিন্তু।

 রেগেমেগে চেয়ারম্যান সাহেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই তাদের আট সিটের নোয়া গাড়িটা হুঁশ করে বেরিয়ে গেল ধুলা উড়িয়ে।

বিটুল ভাই, তুমি যে গাড়ি চালাতে জানো, এটা তো জানতাম না, মন্টু বলে।

সবকিছুই আমি অল্প অল্প জানি। জ্যাক অব অল ট্রেডস...মাস্ট অব নান।  মন্টু তুই চট করে রাজপুত্রের ড্রেসটা পরে একটা রিহার্সেল দে। আমরা শুনতে শুনতে যাই।

মন্টু ড্রেস না পরেই মুখস্থ ডায়ালগ বলতে শুরু করে

‘...মহারাজা আমি যদি সত্যি রাজপুত্র হয়ে থাকি তাহলে এই রাজ্যের প্রতিটি প্রজার কাছে আমার একটাই চাওয়া, একটাই...’

ওদিকে চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ির সামনে আরেকটি খণ্ড নাটকের শেষ অঙ্ক অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। চেয়ারম্যান সাহেব গিয়ে দেখেন তার গেট খোলা, বাইরে দারোয়ান কিতাবুদ্দিন দুই চোখ বন্ধ করে এক হাতে বাতাসে কোপ দিয়ে যাচ্ছে আর মুখে চিৎকার করে বলছে... ৮৯ ৯০ ৯১ ৯২ ৯৩ ৯৪ ৯৫ ৯৬ ৯৭  ৯৮ ৯৯ ১০০... বলে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে তার সামনে রক্তচক্ষু মেলে তাকিয়ে আছে চেয়ারম্যান সাহেব আবদুল মোতালেব। চেয়ারম্যান সাহেব এবার গর্জন করে উঠলেন, ওই হারামজাদা কী গুনস? ঢোঁক গিলে কিতাবুদ্দিন।

কথা কস না ক্যা? কী গুনস? বাতাসে কোপ দেস কারে? গেট খোলা ক্যান?

বাকরুদ্ধ কিতাবুদ্দিন ডজন খানেক ঢোঁক গিলে আমতা আমতা করে ঘটনা খুলে বলে। চেয়ারম্যান সাহেব ততক্ষণে ভেতরে লোক পাঠিয়ে টের পেয়ে যান মন্টু নেই। বাজারের মোড়ের মাইক্রো আর মন্টুর উধাও হওয়া তিনি দুয়ে দুয়ে চার মেলান। ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে...টু লেট... বন্দুকের বুলেট অনেক আগেই বের হয়ে গেছে। তিনি মাথার টুপি খোলেন হয়তো চুল ছেঁড়ার জন্য কিন্তু সেখানে ছেঁড়ার মতো চুল খুব বেশি আর অবশিষ্ট ছিল না।

স্কুলে নাটক শুরু হবে সাতটায়। নাটকের নাম ‘সত্যি রাজপুত্র’। নাম ভূমিকায় মন্টু। গজেন্দ্র স্যারের মাথায় আগুন ধরে যাওয়ার অবস্থা। মন্টুর দেখা নেই। দু-একবার মন্টুর বাসায় ফোন করলেন কিন্তু ফোন ধরছে না। কোনো মানে হয়? প্রধান অতিথি ডিসি সাহেব চলে এসেছেন। গজেন্দ্র স্যার প্রাক্তন ছাত্র বিটুলকে ফোন দিলেন। এই বিটুল ফাজিলটাকে দায়িত্ব দেওয়াই ভুল হয়েছে মনে হচ্ছে। ফোনে পাওয়া গেল বিটুলকে।

বিটুল?

জি স্যার।

ফাজলামো পেয়েছিস তোরা? তোকে দায়িত্ব দেওয়াই ভুল হয়েছে। মন্টু কই?

স্যার কোনো চিন্তা করবেন না। ওকে নিয়ে আমি আসছি, আপনি মঞ্চের পর্দা তুলে দিন।

তুই বলছিস?

জি স্যার...

প্রথম সিনেই তো মন্টুর ডায়ালগ।

স্যার আমি স্কুলের গেটে।

কিন্তু ওর মেকআপ?

ওসব স্যার গাড়িতেই করে ফেলেছি।

গাড়িতে মানে?

মানে স্যার আপনাকে পরে বলব। এদিকে স্যার  স্কুলের বাইরে আরেক লোমহর্ষক নাটক হয়ে গেছে ... আপনি স্যার মঞ্চের পর্দা তুলে মিউজিক শুরু করুন। আমি মন্টুকে নিয়ে ঢুকছি।

মন্টু অসাধারণ অভিনয় করল। প্রধান অতিথি নিজে তাকে আলাদাভাবে পুরস্কার ঘোষণা করলেন। আর স্কুলের সেরা অভিনয়ের পুরস্কার তো আছেই। সেটাও মন্টুর হাতে। ওদিকে মন্টুর মা খবর পেয়ে গেছেন যে তার ছেলেকে এক দুষ্টচক্র (বিটুল অ্যান্ড গং) গাজীপুর থেকে ছিনিয়ে এনে স্কুলের নাটকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তিনি পড়িমরি করে ছুটে এসে হতভম্ব! তার ছেলের হাতে সেরা অভিনয়ের পুরস্কার আর ডিসি সাহেবের পাঁচ হাজার টাকার স্পেশাল চেক। তিনি দাঁত কিড়মিড় করে তাকালেন বিটুলের দিকে। স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে নাটকের নেপথ্যের অন্যতম কুশীলব বিটুল। বিটুল হাসিমুখে বলল, আন্টি আপনার জন্য সাত দিনের সাতজন ফকির ম্যানেজ হয়েছে। একদম অরিজিন্যাল ফকির। কোনো ভেজাল নেই!

হো হো করে কারা যেন একসঙ্গে হেসে উঠল। বিটুল তাকিয়ে দেখে মিশন গাজীপুরের সেই বিচ্ছুর দল। ঠিক তার পেছনে কখন এসে দাঁড়িয়েছে ফাজিলগুলো কে জানে।

(শেষ)