আহসান হাবীবের ‘মিশন গাজীপুর’ (তৃতীয় পর্ব)

অলংকরণ: মামুন হোসাইন

খাওয়াদাওয়া শেষ হলে পেটিসের বাক্স নিয়ে উঠে দাঁড়াল বিটুল ভাই। আমি কাল যাচ্ছি গাজীপুর রেকি করতে।

রেকি মানে?

মানে আগে গিয়ে ওর মামা লোকটা কেমন, বাসা কেমন, কীভাবে উদ্ধার করব—এসব বুঝতে যাচ্ছি। তারপর পরশু যাব ফাইনাল উদ্ধারকাজে।

ওর মামা লোকটা নাকি সুবিধার না।

তুই কীভাবে জানিস?

মন্টু একদিন বলেছিল।

আমিও যাব তোমার সঙ্গে। বলে সজল।

আমিও। হাত তোলে নাফিস।

আমিও।

আমিও।

এক এক করে সবাই হাত তোলে। আবার বসে পড়ে বিটুল ভাই। ‘উফ্ তোরা জ্বালালি... আমি কিন্তু পিকনিক করতে যাচ্ছি না। এটা ভয়ংকর কোনো অ্যাডভেঞ্চার হয়ে যেতে পারে শেষ পর্যন্ত।’

আমরা ভয়ংকর অ্যাডভেঞ্চার করতে চাই তোমার সঙ্গে। আমরা সবাই যাব তোমার সঙ্গে। বিকেলের মধ্যেই তো তোমার ফিরতে হবে। কারণ, স্কুলের নাটক কিন্তু সন্ধ্যায়।

তা তো ফিরতেই হবে। আমি ওর ড্রেসটা সঙ্গে নিয়েই যাব। ওকে উদ্ধার করে সোজা স্কুলে। নাটকের মঞ্চে। না হলে আমারও ইজ্জত থাকবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমিও যদ্দূর খবর পেয়েছি মন্টুর মামা লোকটা বদের হাড্ডি। এলাকার চেয়ারম্যান। ওর কাছ থেকে মন্টুকে উদ্ধার করা মুশকিল হবে। কাজটা কঠিন। তবে আমি একটা প্ল্যান করেছি।

কী প্ল্যান?

এখনই বলা যাচ্ছে না, আগে রেকি করে আসি। কাল বিকেলে তোরা এখানে আসতে পারবি?

পারব।

তাহলে তখনই সব ঠিক করা হবে।

আচ্ছা।

পরদিন আবার সেই আমতলা। আজ বিটুল ভাই গাজীপুর রেকি করে আসবে কিন্তু বিটুল ভাইয়ের দেখা নেই। চারটায় আসার কথা, এখন বাজে পৌনে পাঁচটা।

কে জানে কোনো বিপদ হলো না তো বিটুল ভাইয়ের?

হতেও পারে, মন্টুর মামাটা শুনেছি বদ।

ঠিকই শুনেছিস, মহা বদ। সবাই চমকে উঠল, কখন যে বিটুল ভাই পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, টেরও পায়নি তারা।

খবর কী? গাজীপুর গিয়েছিলে?

সেখান থেকেই এলাম। সবাই মনোযোগ দিয়ে শোন... টাইম শর্ট, আমাকে আবার মাইক্রো ভাড়া করতে যেতে হবে।

সবাই এগিয়ে এল। বিটুল ভাই মুখ খুললেন। গলা একটু নিচু। যদিও তার কোনো দরকার ছিল না। আশপাশে কেউ নেই। এই সময়টায় এখানে কেউ আসেও না।

...মন্টুর মামা ওই এলাকার চেয়ারম্যান। মহা বদ লোক। তবে বেশির ভাগ সময় সে বাসায় থাকে না। আমরা ওই সময়টাতেই যাব, যখন সে থাকবে না। বাসাটা আমি দেখে এসেছি। মোটামুটি দুর্ভেদ্য। লাল ইটের দোতলা বাসা, নিচতলায় একটা ঘরে ওকে আটকে রেখেছে। তবে সুবিধা হচ্ছে, মন্টুর দুই মামির কেউ এখন বাসায় নেই। লোকটার দুই বউ, কোনো ছেলেপুলে নেই। শুধু একটা দারোয়ান আছে। এই সুযোগ। এবার আমার প্ল্যানটা শোন...

সবাই আরও কাছে এগিয়ে আসে। বিটুল ভাই ওদের সামনে একটা ম্যাপ খুলে ধরে ফিসফিস করে বলে তার প্ল্যান...

সব শুনে সবাই একটু থমকে যায়, তারপর একসঙ্গে ‘ওয়াও’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে!

মন্টুর বাবা পেপার পড়ছিলেন। চা নিয়ে ঢুকলেন মন্টুর মা। মন্টুর বাবার মুখটা হাসি হাসি হলেও মন্টুর মায়ের মুখটা গম্ভীর।

তোমার চা।

কাজটা কি তুমি ঠিক করলে?। চা হাতে নিতে নিতে বলে মন্টুর বাবা।

কোন কাজটা?

এই যে মন্টুকে গাজীপুরে তোমার চেয়ারম্যান ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিলে।

ঠিকই করেছি, ওর শাস্তি হওয়া দরকার। কঠিন শাস্তি। কত বড় সাহস আমার বিশ্বাসটাকে কীভাবে নষ্ট করল। ওই পাড়ার বিটলেটাকে ফকির সাজিয়ে...

বিটলে না, ওর নাম বিটুল।

ওই হলো, বিটলে আর বিটুল একই কথা। আমার বিশ্বাসটা...

দেখো বিশ্বাস জিনিসটা আয়নার মতো, যা সন্দেহের ফ্রেমে বাঁধানো...বিশ্বাসের আয়নাটা ভেঙে গেলে...সন্দেহের...

রাখো তোমার দার্শনিক কথাবার্তা...আমি পারলে ওই বিটলেটাকে জেলে ঢোকাতাম।

কমও করোনি, পাড়াছাড়া করেছ।

এ সময় মন্টুর বোন মিলি ঢোকে। সেও মন্টুর মায়ের মতো কড়া টাইপ!

যতই বলো বাবা, কাজটা ওরা ভালো করেনি। এই বয়সে...এসব শিখলে...

কাজটা ভালো করেছে কি মন্দ করেছে সেটা পরে, আমার কিন্তু ঘটনাটা চিন্তা করে বেশ মজাই লেগেছে। ফকির সেজে একটা ভদ্রলোকের ছেলে দিব্যি খেয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন আমাদের বাসায়...হা হা হা... তা মেন্যু ভালো ছিল তো? ছেলেটা ভালোমন্দ খেয়েছিল তো?

মন্টুর মা মিসেস আফরোজা জামান অগ্নিদৃষ্টিতে তাকান জামান সাহেবের দিকে। জামান সাহেব পেপার দিয়ে মুখটা ঢেকে ফেলেন। তবে মা-মেয়ে দুজনই দেখলেন পেপারটা কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার।

আইডিয়াল ল্যাবরেটরি স্কুলের গেটে একটা সাদা মাইক্রো দাঁড়িয়ে আছে। ঘড়িতে সময় আটটা। আটটার মধ্যে সবার এসে পৌঁছানোর কথা। এখন বাজে আটটা ২০। ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে বিটুল। ঠিক আটটা পঁচিশে সবাই একসঙ্গে এসে হাজির হলো। শুধু মিতু আসতে পারল না, ওর মা নাকি ওকে শেষ মুহূর্তে আটকে দিয়েছে। কী আর করা, সবাই হইচই করে মাইক্রোতে উঠে রওনা দিল। মিশন গাজীপুর।

সোয়া দুই ঘণ্টার মধ্যে ওরা পৌঁছে গেল গাজীপুর। তারপর ঠিকানা খঁুজে যে বাড়িটার সামনে দাঁড়াল সেটাকে একটা দুর্গ বললে কম হয়। বাইরে লোহার বিশাল গেট, ভেতরে লাল ইটের দোতলা বাড়ি। মাইক্রো দেখে দারোয়ান টাইপের একটা লোক এগিয়ে এল।

কারে চান?

চেয়ারম্যান সাহেব আছেন?

জে না। উনি শিকারে গেছেন

শিকার?

হ, পাখি শিকারে গেছেন।

তাহলে আমরা উনার বৈঠকখানায় একটু বসি। উনার ভাগ্নে মন্টু এখানে আছে না?

হ আছে।

তার স্কুলের বন্ধুরা সব এসেছে ওর সঙ্গে দেখা করতে।

দেখা হইব না।

কেন?

নিষেধ আছে। চেয়ারম্যান সাবের করা নিষেধ। তার ভাইগনার শাস্তি চলছে। হেরে ঘরে আটকায়া রাখছে। তালা-চাবি মারা। চাবি চেয়ারম্যান সাবের পকেটে।

ঠিক আছে, আমরা না হয় উনার বৈঠকখানায় একটু বসি?

না, হইব না।

ক্যান?

উনার হুকুম ছাড়া এই গেট খোলা হয় না।

বিটুল ভাই আড়চোখে তাকিয়ে দেখে নাফিস নেই। গুড, এমনটাই কথা ছিল। ওরা দারোয়ানের সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে থাকে। প্ল্যান ছিল ওরা দারোয়ানের সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে থাকবে আর নাফিস চলে যাবে বাড়ির পেছনে।  নাফিস স্কুলের স্কাউট টিমের সদস্য। সে জানে কীভাবে দড়ির মই দিয়ে দেয়াল টপকাতে হয়। ওর সঙ্গে স্কাউটের গিট্টু মারা দড়ি আছে।

তাহলে দারোয়ান সাহেব আমরা এখানে চেয়ারম্যান সাবের জন্য একটু অপেক্ষা করি, কী বলেন?

হেইডা আপনের ইচ্ছা।

হুম। বিটুল মাথা নাড়ে। তাহলে আমরা সময় কাটাই কীভাবে বলো তো?

ওই খেলাটা খেলি।

কোনটা?

ওই যে তুমি দুই হাত ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকবে আর মাঝখানে আমি চোখ বন্ধ করে এক হাতে কোপ মারতে থাকব। দুই হাতের মাঝে তোমার হাতে লাগলেই আউট।

ঠিক ঠিক মজার খেলা। অন্যরাও সায় দিল।

শুরু হলো খেলা। বিটুল ভাই তার দুই হাত এক বিঘতসমান ফাঁক করে দাঁড়াল। আর মাঝখানে প্রথমে সজল চোখ বন্ধ করে কোপ মারতে থাকল। বিটুলের হাতে লাগলেই আউট। দারোয়ান বন্ধ গেটে দাঁড়িয়ে আগ্রহ নিয়ে খেলাটা দেখছে। তার চোখেমুখে কৌতূহল। কিছুক্ষণ ভালোই খেলল সজল, তারপর একসময় বিটুলের হাতে লেগে গেল...আউট। এবার মানিক।

সজল চোখ বন্ধ করে কোপ মারছে। ১ ২ ৩ ৪ ... বিটুল খেয়াল করল। দারোয়ান খুব আগ্রহ নিয়ে খেলাটা দেখছে, তার মুখটা হাসি হাসি।

এক এক করে সবাই আউট হয়ে গেল। বিটুল মুখে বিরক্তি প্রকাশ করল।

ধুত তোরা কেউ পারলি না?

এ সময় গেট খোলার শব্দ হয়, দারোয়ান লোকটা এগিয়ে আসছে। তার মুখটা এখনো হাসি হাসি। টোপ গিলেছে।

আমি পারুম।

সত্যি পারবেন?

চোখ বন্ধ কইরা আমি ডাব গাছে উঠতে পারি...আর এইডা তো মামুলি।

বেশ তাহলে হয়ে যাক।

বিটুলসহ সবার হার্টবিট বেড়ে গেছে। সবকিছুই ওদের প্ল্যানমতো এগোচ্ছে। ভেতরে নাফিস ঠিকঠাকমতো মন্টুকে বের করতে পারলে হয়। নাফিস কী করছে, কে জানে, দেয়াল টপকে ঢুকতে পেরেছে তো। দরজার তালাটা খুলতে পারবে তো?

আরও পড়ুন